গুজরাতের মসনদ পর্যন্ত এ বারও পৌঁছে গেল বিজেপি। ছবি: পিটিআই।
এই কথাগুলো লিখছি অমদাবাদে বসে। যখন এ লেখা লিখছি, তখন চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ঢাক-ঢোলের শব্দ, দেখতে পাচ্ছি বাজির রোশনাই, শুনতে পাচ্ছি বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের উল্লাসের শব্দ। দীর্ঘ বাইশ বছর ক্ষমতাসীন থাকা একটা দলের বিরুদ্ধে যতখানি ক্ষোভ-উষ্মা থাকা স্বাভাবিক সাধারণের, ততখানিই থাকা সত্ত্বেও আরও একটা জয় বিজেপির। কর্মী-সমর্থকদের উল্লাস অত্যন্ত স্বাভাবিক। নিঃসন্দেহে তাঁরা প্রশান্তি নিয়েই ঘুমাতে যাবেন রাতে। কিন্তু বিজেপি নেতারা? তাঁরাও কি ঘুমাতে যাবেন মুখমণ্ডলে হাসির রেশ নিয়েই? নাকি তাঁরা বুঝতে পারছেন যে, একটা গুরুতর সতর্কবার্তা দিয়ে গেল গুজরাত?
আসনসংখ্যা অনেকটাই কমে গেল বিজেপি-র। কোথায় হল লোকসান? ফল বলছে, কৃষিপ্রধান গুজরাতে সবচেয়ে ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। অপ্রত্যাশিত কোনও ধাক্কা কিন্তু নয় এ। নরেন্দ্র মোদীর সরকার বা বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার যে কৃষক-দরদী সরকার হিসেবে নিজের পরিচয় নথিবদ্ধ করতে পারেনি, সে কথা অস্বীকার করা কঠিন। অতএব কোনও একটা সন্ধিক্ষণে পৌঁছে কৃষকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ প্রত্যাশিতই ছিল। সেই ক্ষোভকে কোনওক্রমে পাশ কাটিয়ে গুজরাতের মসনদ পর্যন্ত এ বারও পৌঁছে যেতে পারল বিজেপি, সে কথা ঠিকই। কিন্তু আসন্ন সময়টা যে আরও কঠিন হবে বিজেপি-র জন্য, সে ইঙ্গিতটাও স্পষ্ট ভাবে পাওয়া গেল।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
কর্নাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ে নির্বাচন আসন্ন। প্রতিটি রাজ্যই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় রাজনীতির নিরিখে। কৃষক শ্রেণি এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে ওই চার রাজ্যের নির্বাচনে। কর্নাটকে ‘জনমোহিনী’ হয়ে ওঠার চেষ্টায় রত কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপি কতটা সফল হতে পারবে, সে এক বড় প্রশ্ন। আদিবাসী প্রধান এবং পিছিয়ে থাকা ছত্তীসগঢ়ে আরও একবার নিজেদের সরকার টিকিয়ে নিতে বিজেপি কতখানি প্রস্তুত, তাও দেখার বিষয়। রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশের লড়াই আরও কঠিন। গুজরাতের ধাঁচেই কৃষক বিক্ষোভ দেখছে রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ বেশ কিছু দিন ধরে। গুজরাতি কৃষকের ক্ষোভ যে ভাবে ধসিয়ে দিল বিজেপির দীর্ঘ দিনের গড় সৌরাষ্ট্র, সে ভাবেই কি রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশেও বিজেপি-কে ধাক্কা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষক? এই প্রশ্নটা তুলে দিল গুজরাত। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অবিলম্বে এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করতে হবে বিজেপি-কে। না হলে ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি-র ঔজ্জ্বল্যের সম্ভাবনা এখন থেকেই ক্ষীণ হতে শুরু করবে।
আরও পড়ুন: গুজরাতে শেষ হাসি হাসলেন মোদী, অক্সিজেন পেলেন রাহুল
মনে রাখা দরকার, গুজরাতে সরকারের বিরুদ্ধে জমে ওঠা যাবতীয় ক্ষোভকে কংগ্রেসের পালে হাওয়া টানার কাজে অত্যন্ত সফল ভাবে ব্যবহার করেছেন রাহুল গাঁধী। অতএব, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে সে চেষ্টা তিনি আরও জোর দিয়ে চালাবেন। মনে রাখা দরকার, হার্দিক পটেল, অল্পেশ ঠাকোর, জিগ্নেশ মেবাণীর মতো তিন নেতা, যাঁদের পারস্পরিক স্বার্থের মধ্যে অনিবার্য সঙ্ঘাত রয়েছে, গুজরাতে তাঁদেরও এক ছাউনির নীচে হাজির করেছেন রাহুল গাঁধী। সুতরাং, সেই পথে হেঁটেই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি বিরোধী সব শক্তিকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা রাহুল গাঁধী চালাবেন। গুজরাতের কান-ঘেঁষা জয় তাই যত না স্বস্তির বিষয়, তার চেয়ে অনেক বেশি করে শিক্ষা নেওয়ার অবকাশ বিজেপি-র জন্য।
নির্বাচনে জয় নিশ্চয়ই শ্লাঘার বিষয়। গুজরাত ধরে রাখা এবং হিমাচল দখলে আনার জন্য অভিনন্দনও প্রাপ্য বিজেপির। কিন্তু ২০১৭-র শেষ লগ্নের এই বিধানসভা নির্বাচন বুঝিয়ে দিয়ে গেল, প্রশান্তি বা সন্তুষ্টির সময় অতীত। বিপদঘণ্টা যে বেজে গিয়েছে, তা বুঝে নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপগুলো করতে হবে বিজেপি-কে।