পণ্য ও পরিষেবা করের ক্ষেত্রে যাহা হয় নাই, সেই কথাটি গোড়ায় স্পষ্ট করিয়া লওয়া ভাল। এই পরোক্ষ করব্যবস্থায় কোনও নীতিগত পরিবর্তন হয় নাই। কিছু পণ্যকে এক করের হার হইতে নিম্নতর হারে লইয়া আসা হইয়াছে। ইহাকে সংস্কার না বলিয়া অদলবদল হিসাবে দেখাই বিধেয়। দ্বিতীয় কথা, অদলবদলটিও সম্ভবত সম্পূর্ণ হয় নাই। ২৮% করের হার হইতে বহুবিধ পণ্যকে সরাইয়া লওয়া হইলেও সিমেন্ট কেন সেই হারেই থাকিয়া গেল, অর্থ মন্ত্রক জানায় নাই। ক্রমশ হয়তো এমন উদাহরণ আরও মিলিবে। কাজেই, অদলবদলের প্রক্রিয়াটি সম্ভবত এইখানেই ফুরাইবে না। তৃতীয়ত, করের হারের এই পরিবর্তনে সাধারণ ভাবে ব্যবসায়ীরা লাভবান হইবেন। বিভিন্ন পণ্যের করের হারে রদবদলে স্পষ্ট, গোড়ায় ভুল হইয়াছিল। সেই ভুল শুধরাইয়া লইলে যদি ব্যবসায়ীদের অসুবিধা কমে, তাঁহারা যদি বিনিয়োগের প্রণোদনা পান, তাহাতে অর্থনীতির লাভ বই ক্ষতি নাই। এবং, অনুমান করা চলে, জিএসটি চালু হইবার পরেও কর প্রদানের হার তেমন ভাবে না বাড়ায়, বস্তুত বেশ কিছু রাজ্যে নগদে লেনদেন বাড়িয়া যাওয়ায়, কেন্দ্রীয় সরকার চিন্তায় পড়িয়াছে। করের হার কমিলে যদি কর আদায় বাড়ে, তবে হয়তো রাজকোষ ঘাটতির দিকটিতেও খানিক সুবিধা হইবে— হার কমিবার ফলে রাজস্বের পরিমাণহ্রাসেরও একটা সুরাহা হইবে। তবে, সিদ্ধান্তটি কেন গুজরাতে নির্বাচনের প্রাক্কালেই হইল, স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিতেছে। সিদ্ধান্তটির পিছনে এই নির্বাচনের কোনও ভূমিকা নাই, এমন দাবি নিখাদ ভক্তরাও করিবেন বলিয়া বোধহয় না। কিন্তু অন্য দিকে, শুধুমাত্র নির্বাচনের প্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্তটিকে বিচার করিলেও তাহা ভুল হইবে।
বিভিন্ন পণ্যের উপর প্রযোজ্য করের হার কমাইয়া আনিবার মধ্যে একটি স্বীকারোক্তি আছে— সরকার স্বীকার করিয়া লইতেছে, গোড়ায় ভুল হইয়াছিল। বর্তমান জমানায় এহেন স্বীকারোক্তি সুলভ নহে। দ্বিতীয়ত, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ভুল শুধরাইয়া লইবার চেষ্টাটিকেও স্বীকৃতি দেওয়া বিধেয়। বিশেষত, যদি নোটবাতিলের অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রাখা হয়। সেই নীতির ক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ ভুলকেও যে ভঙ্গিতে কুযুক্তির দ্বারা ‘ঠিক’ প্রমাণ করা হইতেছে, সেই তুলনায় জিএসটি-র এই সংশোধন সত্যই ব্যতিক্রম। নিছক নির্বাচনী রাজনীতির তাগিদও যদি সরকারকে ঠিক পথে চালিত করিতে পারে, তাহাকে স্বাগত না জানাইবার কোনও কারণ নাই।
ভুল যে হইয়াছিল, তাহাতে সংশয় নাই। তাহার অন্যতম কারণ, ব্যস্ততা। কেন্দ্রীয় সরকার যে গতিতে কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই জিএসটি চালু করিয়া দিল, তাহাতে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। সেই দায় প্রধানত কেন্দ্রীয় সরকারের উপরই বর্তায়। কিন্তু আজ যাঁহারা জিএসটি-র হার বিষয়ে খড়্গহস্ত, তাঁহারাও কি দোষ এড়াইতে পারেন? জিএসটি কাউন্সিলে রাজ্যগুলির প্রতিনিধি আছেন। করের হার যখন ধার্য হইতেছিল, বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবাকে বিভিন্ন ধাপে রাখা হইতেছিল, তখন বিরোধীরা আপত্তি করেন নাই কেন? কেন্দ্রীয় সরকার, অথবা বিজেপি, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়া নিজেদের ইচ্ছায় চলিতে পারিত, সত্য, কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের আপত্তিটুকু পেশ করিয়া রাখাও যে জরুরি কাজ, বিরোধীরা জানিতেন না? পরিষদের বৈঠকে যদি তাঁহাদের কথা অগ্রাহ্য করা হইত, এমনকী বৈঠকের বিবরণী হইতেও যদি সেই আপত্তি ছাঁটিয়া ফেলা হইত, তবুও গণপরিসরে তাঁহারা নিজেদের আপত্তি স্পষ্ট ভাবে জানাইলে সেই কথা থাকিয়া যাইত। আজ তাঁহাদের আপত্তি করিবার নৈতিক অধিকারও থাকিত। কিন্তু, তাঁহারা সেই কাজটি করিয়া উঠিতে পারেন নাই। অতএব, এখনকার আপত্তিটি বড় বেশি রাজনৈতিক ঠেকিতেছে।