সম্পাদকীয়

সর্ব নাশের পথে

পরিবেশ আন্দোলনকে যে দ্রুততায় তিনি সম্মুখবর্তী করিয়াছেন, তাহার তুলনা মেলা ভার। সম্প্রতি ওই কিশোরী নূতন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন। বলা যায়, তিনি নিজেকে বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং, ব্রিটিশ যুবরাজ উইলিয়াম হ্যারি এবং আমেরিকান অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি-র উত্তরসূরি প্রতিপন্ন করিয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০০
Share:

গ্রেটা থুনবার্গ। —ফাইল চিত্র

সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ সংবাদের শিরোনামে। বিশ্বজোড়া পরিবেশ আন্দোলনের মানবীয় মুখ এই তনয়া। পরিবেশ নষ্টের, প্রকৃতিকে বিপন্ন করিবার অপকর্মের মূল হোতা যে রাষ্ট্রনায়কগণ, সেই সত্যটি তাঁহার মতো আর কেহ প্রতিষ্ঠিত করেন নাই। তাঁহাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মস্তকে তুলিয়াছে। পরিবেশ আন্দোলনকে যে দ্রুততায় তিনি সম্মুখবর্তী করিয়াছেন, তাহার তুলনা মেলা ভার। সম্প্রতি ওই কিশোরী নূতন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন। বলা যায়, তিনি নিজেকে বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং, ব্রিটিশ যুবরাজ উইলিয়াম হ্যারি এবং আমেরিকান অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি-র উত্তরসূরি প্রতিপন্ন করিয়াছেন। ইতিপূর্বে ওই সব বিশিষ্ট ব্যক্তি বিবিসি রেডিয়ো কর্তৃক আমন্ত্রিত হইয়া উক্ত বেতারকেন্দ্রের প্রসিদ্ধ ‘টুডে’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়াছেন। এই বৎসর বিবিসি রেডিয়োর আমন্ত্রণ মোতাবেক গ্রেটা ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতেছেন অতিথি সম্পাদক হিসাবে। পরিবেশ সম্পর্কে উদ্বেগ যে তাঁহার সম্প্রচারের প্রধান লক্ষ্য, বলাই বাহুল্য। বিবিসি রেডিয়ো জানাইয়াছে, ‘টুডে’ অনুষ্ঠানে গ্রেটা মুখোমুখি হইবেন প্রথম সারির কতিপয় পরিবেশকর্মীর। সতত পরিবেশ নিধনে এই সুজলা-সুফলা ধরিত্রী কী পরিমাণে বিপন্ন, তাহাই আলোচিত হইবে।

Advertisement

অন্য দিকে পরিবেশবাদীদের উৎসাহে বারি সিঞ্চনের লোকের অভাব নাই। এক দিকে গ্রেটা যখন বিবিসি রেডিয়োর স্টুডিয়োয় অনুষ্ঠানে বসিবেন, তখনই অন্য দিকে পৃথিবীর শেষ বৃহত্তম কয়লাখনি হইতে সম্পদ আহরণ শুরু হইবে। ভাণ্ডারটি আফ্রিকা মহাদেশের বৎসোয়ানা রাষ্ট্রে অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিকেরা ওই সব ভাণ্ডারের সন্ধান পান ১৯৬০-এর দশকে। তথাপি অদ্যাবধি ভাণ্ডারগুলিতে মানুষের হাত পড়ে নাই। কারণ দুই। একে তো দেশটিতে জনসংখ্যা সামান্য, অন্য দিকে অনুন্নত বলিয়া বৎসোয়ানার রফতানি পরিকাঠামোও তেমন নাই। পরিস্থিতির পরিবর্তন আসন্ন। বৎসোয়ানার প্রশাসন এই সত্য অনুধাবন করিয়া আহ্লাদিত হইয়াছেন যে, তাঁহারা অমূল্য সম্পদের মালিক। সুতরাং জাতীয় আয় বাড়াইবার লক্ষ্যে অন্য দেশকে কয়লা বিক্রি এক সহজ পথ। দক্ষিণ আফ্রিকাকে কয়লা বিক্রি করিয়া বৎসোয়ানা যে ব্যবসা শুরু করিয়াছে, তাহা অচিরেই বহু দূর বিস্তৃত হইবে। কী পরিমাণ কয়লা মজুত আছে বৎসোয়ানার ভূগর্ভে? ২০১২ খ্রিস্টাব্দের সমীক্ষা অনুযায়ী, ভাণ্ডারের পরিমাণ ২,৮৫০ কোটি টন। এই হিসাব অনুযায়ী, অদ্যাবধি অনিষ্কাশিত ভাণ্ডারে বৎসোয়ানা বিশ্বে প্রথম পাঁচটি দেশের অন্যতম। অথচ, গত বৎসর পর্যন্ত ওই দেশে সরকার-পরিচালিত একটি খনি ব্যতিরেকে অন্য কোথাও কয়লা উত্তোলন চালু ছিল না। এখন সরকারকে পিছনে ফেলিয়া হাজির কতিপয় বহুজাতিক সংস্থা। যাহারা বৎসোয়ানার বিভিন্ন স্থানের খনি হইতে কয়লা নিষ্কাশন করিবে। ফলে উত্তোলনের বার্ষিক পরিমাণ পাঁচ লক্ষ টন (যাহা বৎসোয়ানার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হইত) হইতে বাড়িয়া ১২ লক্ষ টনে পৌঁছাইবে। এখনও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা পর্দার আড়ালে অপেক্ষমাণ। তাহারা মাঠে নামিলে কোথাকার জল যে কোথায় গড়াইবে, তাহা কেহ অনুমান করিতে পারে না।

বৎসোয়ানার মাটিতে আসন্ন রাজসূয় যজ্ঞের কথা ভাবিয়া পরিবেশবাদীরা যারপরনাই আতঙ্কিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত করিতে না পারিলে ঘোর বিপদ আসন্ন। বৎসোয়ানার খনিগুলি হইতে নিষ্কাশিত কয়লা পুড়াইলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বাড়তি ৮,৪০০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস মিশিবে। ফল মারাত্মক। বৎসোয়ানার খনি হইতে নিষ্কাশিত কয়লার প্রধান ক্রেতা অবশ্যই দক্ষিণ আফ্রিকা। যাহার নিজস্ব তৈলভাণ্ডার ফুরাইয়া আসিতেছে বলিয়াই দেশটি এক্ষণে পরদেশ হইতে কয়লা আমদানিতে আগ্রহী। বৎসোয়ানার চাই বিদেশি মুদ্রা। দক্ষিণ আফ্রিকার চাই কলকারখানা সচল রাখিবার জন্য বিদ্যুৎ। সুতরাং, দুইয়ে দুইয়ে চার। চুলায় যাউক পরিবেশ। পরিবেশবিদদিগের আর্তনাদ শুনিয়া বৎসোয়ানার খনিতে কয়লা উত্তোলনে উদ্যত এক বেসরকারি কোম্পানির কর্তা যাহা বলিয়াছেন, তাহা পরিবেশ প্রশ্নে পুরাতন ধনী-দরিদ্র, উন্নত-অনুন্নত বিতর্কটিকেই পুনরায় উস্কাইয়া দিয়াছে। তাঁহার যুক্তি, ধনী রাষ্ট্রগুলি তো এত দিন ধনসম্পদ বাড়াইয়া গিয়াছে পরিবেশের বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকিয়া। তাহা হইলে, একটি অনুন্নত রাষ্ট্র উন্নত হইবার চেষ্টা করিলে এত শোরগোল কেন? গ্রেটা থুনবার্গ, আপনার যুদ্ধ সহজ নহে।

Advertisement

যৎকিঞ্চিত

বিজেপির এক নেতা বললেন, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় দু’বছর বন্ধ করে, তার পর নাম পাল্টে নেতাজির নামে করে দিলেই, সব সমস্যা মিটে যাবে। সত্যি, কত নায়ক-নায়িকা তো নাম পাল্টে সিনেমায় নেমে ভাগ্য ফিরিয়ে ফেললেন। আচ্ছা, গরু-র নাম পাল্টে ছাগল করে দিলে কি হিন্দুরা তার মাংস আর নিষিদ্ধ মনে করবেন না? বাগুইআটির নাম পাল্টে বার্লিন করলে তা বেশি বাসযোগ্য হবে? আর নাথুরাম গডসে-র নাম ‘রাম গড’ করলেই, তাঁকে দেশভক্ত বলাটা মান্যতা পেয়ে যাবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement