সংঘর্ষের ধাক্কা: পড়ুয়াদের সঙ্গে সংঘর্ষে এ দিন একাধিক পুলিশও জখম হয়েছে। তার মধ্যে এক মহিলা পুলিশের মাথা ফেটে যায়। নিজস্ব চিত্র
আইনি কাঠামো বা প্রশাসন বা সরকারের উপরে আস্থার অভাব কোন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছলে এই রকম অবস্থা হয়, তা ভেবে দেখব আর কবে! ইসলামপুর একটা দুঃস্বপ্নের সাক্ষী হল যেন। সত্যিই যদি দুঃস্বপ্ন হত, তা হলে বরং অনেক ভাল হত। কারণ সে ক্ষেত্রে ঘুম ভাঙলে অন্তত দেখা যেত যে, কিছুই হারায়নি আমাদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। একটা তরতাজা প্রাণ অকারণে খুইয়ে ফেলেছি আমরা ইতিমধ্যেই। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন আরও কেউ কেউ। প্রশাসনিক পদক্ষেপের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা অবশিষ্ট থাকলে এ ভাবে রক্তাক্ত হতাম না আমরা।
কী নিয়ে অশান্তি? অশান্তি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে। নতুন শিক্ষক হিসেবে যাঁদের পাঠানো হয়েছে স্কুলে, তাঁদের প্রয়োজনীয়তাই নেই। যে সব বিষয়ে শিক্ষক প্রয়োজন, সেই সব বিষয়ের শিক্ষক দেওয়া হোক— এলাকায় দাবি ছিল সে রকমই। অগ্নিগর্ভ ইসলামপুরের একটি অংশ থেকে অন্তত তেমনই দাবি করা হচ্ছে।
কিন্তু বিবাদের কারণ যদি এই হয়, তা হলে কি ঘটনা এত দূর গড়িয়ে যাওয়া উচিত ছিল! স্কুলে কার নিয়োগ হবে, কার নিয়োগ হবে না, তা নিয়ে বিতণ্ডা মৃত্যু পর্যন্ত গড়িয়ে যাবে! বিক্ষোভ সংঘর্ষের রূপ নেবে, সংঘর্ষের মাঝে কেউ চিরতরে লুটিয়ে পড়বেন!
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ভয়াবহ ছবি উঠে এসেছে উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর থেকে। দৌড়ঝাঁপ, আতঙ্ক, বিস্ফোরণের শব্দ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, আর্তনাদ, রক্তপাত, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া, হাহাকারের শব্দ ভেসে আসা। কার ভুলে এ রকম হল? কেউ না কেউ তো সীমা লঙ্ঘন করেছেনই। না হলে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত অসন্তোষ এত দূর গড়িয়ে যেতে পারে না।
আরও পড়ুন: শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে রণক্ষেত্র স্কুল, ইসলামপুরে গুলিতে মৃত ১ ছাত্র
যদি আশেপাশে না তাকিয়ে, অগ্র-পশ্চাৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধুমাত্র ইসলামপুরের এই ঘটনাটির দিকে তাকানো যায়, তা হলে দোষারোপ প্রাথমিক ভাবে করতে হবে বিক্ষোভকারীদেরই। কোনও সরকারি স্কুলে বা সরকার পোষিত স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাদের পাঠানো হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী সরকার বা প্রশাসনই। সেই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের অধিকার সাধারণ জনতার নেই। স্থানীয় বাসিন্দা বা সংশ্লিষ্ট স্কুলের পড়ুয়া বা প্রাক্তন পড়ুয়াদের মতামত নিয়ে স্থির করতে হবে যে কাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে, আর কাকে নিয়োগ করা যাবে না, বিষয়টা এমন নয় মোটেই। গণতান্ত্রিক প্রশাসন জনতার মতামতের উপরে ভিত্তি করেই চলে, সে কথা ঠিক। কিন্তু জনমতের প্রতিফলন সুনিশ্চিত করার সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক অবকাশ রয়েছে। প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করা জনমতের কাজ নয়, তার সংস্থানও কোথাও নেই। স্কুলে নতুন শিক্ষক হিসেবে যাঁদের পাঠানো হয়েছে, তাঁদের প্রয়োজনীয়তা হয়তো নেই। তা নিয়ে অসন্তোষও তৈরি হতে পারে। কিন্তু সে অসন্তোষ ব্যক্ত করার অন্য অবকাশ রয়েছে, অন্য পন্থা-পদ্ধতি রয়েছে। আইন হাতে তুলে নিয়ে স্কুল ঘিরে অবরোধ তৈরি করার অধিকার সাধারণ নাগরিককে সংবিধান দেয়নি।
এটা ছিল দৃষ্টিভঙ্গির একটা পৃষ্ঠ। দৃষ্টিভঙ্গির অন্য একটা পৃষ্ঠও রয়েছে। সেই পৃষ্ঠদেশে দাঁড়িয়ে ইসলামপুরের দিকে তাকালে একটা প্রশ্নচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। সরকার বা প্রশাসনের উপরে আস্থা কতটা হারিয়ে ফেললে নাগরিকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় এ ভাবে হ্স্তক্ষেপ করেন? আইন-কানুন মেনে বা সংবিধান নির্দিষ্ট পথে প্রতিবাদ করলে বা অসন্তোষ ব্যক্ত করলে যে লাভ খুব একটা হবে না, সে বিষয়ে সম্ভবত নিশ্চিত ছিলেন ইসলামপুরের ওই অশান্ত হয়ে ওঠা প্রান্তের মানুষজন। নিশ্চিত ছিলেন বলেই বিহিত করার দায়িত্ব নিজেরাই নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
রাজ্য প্রশাসন কি কোনও শিক্ষা নিল ইসলামপুরের এই ঘটনা থেকে? প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আঁচ এই রকম হিংসাত্মক হয়ে ওঠার নমুনা আমরা এই প্রথম পেলাম, এমন নয়। এর আগেও রাজ্যের বেশ কয়েকটি প্রান্তে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের চেহারা হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে। ইসলামপুর আপাতত সেই তালিকায় একটি সংযোজন মাত্র। প্রশাসনকে সত্যিই নিরাপদ এবং নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে চালান না গেলে জনগণের মধ্যে অনাস্থা আরও বাড়বে, আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে।
আরও পড়ুন: ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় অপসারিত ডিআই, আজ উত্তর দিনাজপুরে বিজেপির বন্ধ
এখনও সময় রয়েছে। অবিলম্বে সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত প্রশাসনিক কর্তাদের। শাসক ছাড়া আর কারও কথা রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তারা ভাববেন না— এই ধারণা যদি আরও চারিয়ে যায় জনমানসে, পরিস্থিতি কিন্তু আরও উত্তপ্ত হতে পারে। রাজ্যের আরও অনেক প্রান্ত কিন্তু ইসলামপুরের চেহারা নিতে পারে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছে ইসলামপুরে। উপযুক্ত শিক্ষকের দাবিতে আন্দোলন এই রকম রক্তাক্ত পরিণতি পাবে! ভাবাই যায় না। ক্ষোভ আর কোথায় কোথায় এই রকম বারুদের স্তূপের চেহারা নিয়ে রয়েছে, আমাদের অনেকেরই তা জানা নেই। অতএব, প্রতিটি পদক্ষেপের আগে প্রশাসনিক কর্তাদের ভেবে দেখা উচিত, পদক্ষেপটা সত্যিই বৃহত্তর জনস্বার্থে করছেন কি না। আস্থার ভিত যেভাবে টলেছে বলে ইঙ্গিত মিলছে, তা খুব একটা স্বস্তিদায়ক বিষয় নয় কারও পক্ষেই।