Editorial News

আর কতগুলো প্রাণের মূল্যে এই অপ্রস্তুত দশা কাটবে?

মৃত্যুর মিছিল বেরিয়ে এল ১০ ঘণ্টা জলে ডুবে থাকা বাসটার ভিতর থেকে যেন। কতটা ভয়াবহ, কতটা যন্ত্রণাদায়ক ভাবে হানা দিয়েছে মৃত্যু, গোটা দৃশ্যপট তার সাক্ষ্য বহন করছিল।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৮
Share:

দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই বাস। নিজস্ব চিত্র।

মর্মন্তুদ! ভয়াবহ! ওই ভয়ঙ্কর মৃত্যু মানস দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে যত বার, তত বারই শিউরে উঠতে হচ্ছে।

Advertisement

মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ থেকে সাংঘাতিক দুঃসংবাদটা হানা দিয়েছিল সাতসকালেই। তার পর দিনভর সংবাদমাধ্যমে ভেসে উঠেছে দুর্ঘটনাস্থলের নানা ছবি, উদ্ধারকাজের বিভিন্ন মুহূর্তের দৃশ্য। উৎকণ্ঠা নিয়ে নজর রাখছিলেন প্রত্যেকেই। কিন্তু সেতুর রেলিং ভেঙে জলে পড়ে যাওয়া বাসটাকে যখনই তুলে আনা হল জলের উপরে, আর চোখ রাখা গেল না সে দিকে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটার প্রত্যেকটা কোণ থেকে দেখা দিচ্ছিল শব, একের পর এক নিথর শব।

মৃত্যুর মিছিল বেরিয়ে এল ১০ ঘণ্টা জলে ডুবে থাকা বাসটার ভিতর থেকে যেন। কতটা ভয়াবহ, কতটা যন্ত্রণাদায়ক ভাবে হানা দিয়েছে মৃত্যু, গোটা দৃশ্যপট তার সাক্ষ্য বহন করছিল।

Advertisement

অত্যন্ত দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু ছুঁয়ে গেল যে সব পরিবারকে, তাদের জন্য কোনও সমবেদনাই যথেষ্ট নয়। রাজ্য সরকার পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেছে। সরকারের এই সহানুভূতিশীল পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু গোটা ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকালে একটা সাংঘাতিক প্রশাসনিক স্থবিরতার ছবি ফুটে উঠছে। কোনও আকস্মিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় আমরা আজও কতটা অপ্রস্তুত, তার নিদারুণ নিদর্শন যেন আর্তনাদ করে উঠছে।

যতক্ষণ না সক্রিয় হল নবান্ন, যতক্ষণ না রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ মহল বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ময়দানে নামল, ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধারকাজ যেন এগোতেই চাইল না।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

দুর্ঘটনার পরে দীর্ঘক্ষণ কোনও প্রশাসনিক তৎপরতাই দেখা যায়নি উদ্ধারের জন্য। বেশ কিছু ক্ষণ কেটে যাওয়ার পর দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল পুলিশ। তবে শুধুই পুলিশ, কোনও উদ্ধারকারী দল নয়। স্বাভাবিক কারণেই আছড়ে পড়ে জনরোষ, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়, আগুন নেভাতে এসে দমকলও আক্রান্ত হয়, পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে গুলিও ছুড়তে হয়। কোনও দুর্ঘটনাস্থলের দৃশ্যপট কি আদৌ এই রকম হওয়া উচিত?

দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় যে বলে-কয়ে আসে না, সে কথা কারও অজানা নয়। আকস্মিক পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিশেষ দলকে তাই সব সময়ই প্রস্তুত রাখা জরুরি। রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি মহল্লায়, প্রত্যেকটি রাস্তার ধারে নিয়ত প্রস্তুত থাকবে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, তেমনটা হয়তো এ দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় এখনও সম্ভব নয়। কিন্তু বিপর্যয় ঘটলে যত দ্রুত সম্ভব সাড়া দেওয়ার জন্য স্থানীয় স্তরে সুসংহত ব্যবস্থাপনা থাকবে, সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ থাকবে, এমনটা তো আশা করা যেতেই পারে। কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে সর্বাগ্রে বিপর্যয় মোকাবিলা দলের কাছেই খবরটা পৌঁছবে, এটুকু তো অন্তত নিশ্চিত করতেই পারে প্রশাসন। যে কোনও ধরনের বিপর্যয়ের মোকাবিলার জন্য সুবৃহত্ এবং সুসম্পূর্ণ পরিকাঠামো সব স্তরে না থাক, একেবারে বুনিয়াদি স্তরের বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থাটা তো পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যেতেই পারে। এই ব্যবস্থাপনা বা এই পরিকাঠামোর কোনও সুনির্দিষ্ট রূপরেখা রয়েছে কি না, সাধারণের তা জানা নেই। কোথায় কতটুকু পরিকাঠামো রয়েছে, কোন ধরনের বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে কোন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার ইত্যাদি সম্পর্কে সাধারণের কোনও স্পষ্ট ধারণাই নেই। অতএব, দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ যতটা ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত, ততটাই হয়ে গেল। বিপর্যয়ের অভিঘাত একটুও কমিয়ে আনা গেল না। বিপর্যয় মোকাবিলা সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয়তা বা তত্পরতা আর কিছুটা বেশি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি কিয়ত্ কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারত হয়তো।

আরও পড়ুন: সেতু ভেঙে বাস জলে, মৃত ৩৬, উদ্ধার ঘিরে বিক্ষোভ, আগুন

আরও পড়ুন: ঝাপসা কাচে লেখা ‘ইমার্জেন্সি এক্সিট’, ও পারে নিথর শাঁখা-পলা

একটা করে বিপর্যয় আসে, একটা করে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করে যায় আমাদের সামনে। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে সব দৃষ্টান্ত থেকে আদৌ কি কোনও শিক্ষা নিই আমরা? সম্ভবত শিক্ষা নিই না, নিতে পারি না। যদি শিক্ষা নিতে পারতাম, আপত্কালীন ব্যবস্থাপনায় এত অব্যবস্থা ধরা পড়ত না তা হলে। দৌলতাবাদের এই দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক কথা হবে, চর্চা হবে, আলোচনা চলবে, চুলচেরা বিশ্লেষণ উঠে আসবে। আপত্কালীন ব্যবস্থাপনা ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়েও অনেক প্রস্তাব ঘোরাফেরা করবে। কিন্তু আদৌ কাজের কাজ কিছু হবে কি না, হলফ করে তা কেউই সম্ভবত বলতে পারবেন না। এই পরিস্থিতির বদল ঘটা দরকার সর্বাগ্রে। বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা বিপর্যয়ের সাগরে আর যাতে খাবি না খায়, সেটুকু অন্তত নিশ্চিত করা হোক। এতগুলি প্রাণের বিনিময়ে সেই হুঁশটুকুও না ফিরলে আরও দুর্ভাগ্যজনক দেখাবে দৃশ্যপটটাকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement