আর্থিক বৃদ্ধি হলেই তার প্রসাদ টুপটাপ করে চুইয়ে পড়বে গরিবগুর্বোদের ওপরে, বাজার অর্থনীতির এই রূপকথায় যাঁরা বিশ্বাস করেন না, তাঁরা উন্নয়ন-নীতির ভাবধারায় প্রগতিশীল শিবিরে পড়েন। তাঁদের মধ্যেও কিন্তু একটা পুরনো ঝগড়া আছে। তাঁরা সকলেই মনে করেন, সরকারের দায় আছে দারিদ্র-দূরীকরণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেওয়ার। কিন্তু, কী ভাবে এই ভূমিকা পালন করা হবে, তাঁরা সেই ব্যাপারে এক পথের সমর্থক নন। এই মতভেদের অনেক দিক আছে, তার একটা দিক হল পিডিএস বা গণবণ্টন ব্যবস্থা বনাম ক্যাশ ট্রান্সফার বা প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তর ব্যবস্থার আপেক্ষিক ভূমিকা।
উন্নয়ন অর্থনীতির ময়দানে গত প্রায় দুই দশক ধরে এই যে তর্ক চলছে— পিডিএস বা গণবণ্টন ব্যবস্থা বনাম ক্যাশ ট্রান্সফার বা প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তর— সেটা এতটাই জোরদার যে দু’পক্ষের নামই হয়ে গিয়েছে যথাক্রমে পিডিএস-ওয়ালা আর ক্যাশ-ওয়ালা! বড় কোনও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে পুরনো অনেক ঝগড়া অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। সেই রকম অতিমারি, লকডাউন আর তার ফলে তৈরি হওয়া আর্থিক সঙ্কট একটা কথা বুঝিয়ে দিয়েছে— এত দিন যে তর্ক চলছিল, অন্তত এই মুহূর্তে তা নিতান্তই অবান্তর! পিডিএস-ওয়ালা আর ক্যাশ-ওয়ালাদের মধ্যে কোনও ‘বনাম’ নেই— উন্নয়নের দুটি নীতি একটি অন্যটির বিকল্প নয়, বরং সম্পূরক।
শুধু যে ভাত-ডালে জীবন চলে না, আরও অনেক কিছু প্রয়োজন হয়, এই কথাটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। জামাকাপড় চাই, যাতায়াতের টাকা চাই, ঘর ভাঙলে তা সারাইয়ের পয়সা চাই, অসুস্থ হলে ওষুধ চাই, সন্তানের স্কুলে মাইনে না লাগলেও খাতা-কলম কেনার পয়সা চাই। এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। গণবণ্টন ব্যবস্থাকেই যাঁরা যথেষ্ট মনে করেন, তাঁদের একটা পূর্বানুমান থাকে— মানুষ যে রোজগার করেন, সেই টাকা দিয়েই তাঁরা এই প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারেন। স্বাভাবিক অবস্থায় এই অনুমানটা যে ভুল, তা বলা যাবে না। কিন্তু, অতিমারির ধাক্কায় অর্থনীতির চাকা থমকে যাওয়ায় বহু কোটি মানুষের সেই রোজগারের জায়গাটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। যাঁরা কাজ হারিয়ে, ভুখা পেটে হাজার কিলোমিটার হেঁটে, ট্রাকে চড়ে, অথবা শেষ অবধি সরকারের দেওয়া অবহেলার ট্রেনে পানীয় জলটুকুও না পেয়ে ঘরে ফিরে এলেন, তাঁদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। তার বাইরেও চাকরি হারালেন বহু মানুষ। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল বিকিকিনির অভাবে। আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন গভীর অনিশ্চয়তার সামনে। চাকরি থাকবে কি না, রোজগারের কোনও পথ বাঁচবে কি না, তাঁরা জানেন না।
এই অনিশ্চয়তার ধাক্কা সবচেয়ে জোরে লাগে গরিব মানুষের গায়েই। তার একটা কারণ হল, অসংগঠিত ক্ষেত্রে তুলনায় গরিব মানুষের ভিড়। দ্বিতীয় কারণ হল, যাঁরা অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন, কয়েক মাসের ধাক্কা সামলানোর মতো রেস্ত তাঁদের অনেকেরই থাকে। কিন্তু গরিব মানুষ মূলত সঞ্চয়হীন। ফলে, কাজ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যয় করার মতো টাকাও আর তাঁদের হাতে থাকে না। অতএব, তাঁরা যদি রেশনে চাল-ডাল-ছোলা পানও, বাকি প্রয়োজনগুলো মেটাতে না পারলে তাঁদের ভাল থাকার ওপর মস্ত প্রভাব পড়ে, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা একটু কমে। এই দিক থেকে দেখলে, ত্রাণ বা সাহায্যের সার্বিক যে প্যাকেজ, তার একটা অংশ প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তর করার পক্ষে যুক্তি অকাট্য।
তা হলে কি ক্যাশ-ওয়ালারাই ঠিক বলেন যে মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া হোক— তাঁরা বুঝে নেবেন সেই টাকা কী ভাবে খরচ করলে সবচেয়ে বেশি উপকার হয়? হরেক সমীক্ষা ও গবেষণার ফলাফল বলছে— যার মধ্যে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজও আছে— নগদ হস্তান্তরে সত্যিই লাভ হয়, এমনকি নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে দরিদ্র মানুষের কাজ করার প্রবণতাও বাড়ে। কিন্তু, এখানেও গোলমাল— লকডাউনের ফলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় পণ্যের জোগানও বেশ রকম ধাক্কা খেয়েছে। পরিস্থিতি ক্রমে স্বাভাবিক হচ্ছে, কিন্তু মাসখানেক আগের কথা ভাবলেও মনে পড়বে, দোকানে দোকানে হরেক পণ্যের ভাল রকম অভাব তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, এমন দেশব্যাপী বিপর্যয় স্তব্ধ করে দিতে পারে পণ্যের সাপ্লাই চেনকে। সেই ক্ষেত্রে, হাতে টাকা থাকলেই বা কী, দোকানে যদি সেই টাকা দিয়ে জিনিসপত্র না কেনা যায়, তবে খিদে পেটেই ঘুমোতে বাধ্য হবেন মানুষ। তাই শুধু নগদ টাকা দিয়ে হবে না, ত্রাণ বা সাহায্যের সার্বিক প্যাকেজে পিডিএসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
নগদ বনাম গণবণ্টন নিয়ে স্বাভাবিক সময়ে একটা তুল্যমূল্য বিচার করাই যায়, এবং বলাই যায় যে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থাই সর্বোত্তম নীতি। যেমন নগরাঞ্চলে, যেখানে নগদ হস্তান্তর করার যে আর্থিক পরিকাঠামো এবং তা খরচ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে, সেখানে নগদ, এবং গ্রামাঞ্চলে গণবণ্টন— এই ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আরও ভাল হয়, যদি প্রাপকের পছন্দের ওপরেই সিদ্ধান্তটা ছেড়ে দেওয়া হয়। আর একটা বড় চিন্তা হল— যাঁরা দরিদ্র নন এবং সরকারি সাহায্য পাওয়ার যোগ্য নন, সে রকম লোকে অন্যায় ভাবে এই ব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন; না কি যাঁরা দরিদ্র এবং সরকারি সাহায্য পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু পাচ্ছেন না— এই দুটো সমস্যার মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? নগদ না গণবণ্টন ব্যবস্থা শ্রেয়, সেটা এর ওপরেও নির্ভর করবে।
কিন্তু গণস্বাস্থ্য ও আর্থিক ব্যবস্থা যখন বিপর্যস্ত, এবং অভাবের তাড়নায় বহু মানুষ বিপন্ন, তখন এ ভাবে ভাবা যায় না। তখন একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রাণরক্ষা। এই পরিস্থিতিতে কিছু লোক অন্যায্য ভাবে সরকারি সাহায্য পেলে তা-ও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু। যে হেতু দুই ব্যবস্থারই কাঠামো এবং প্রয়োগে নানা সমস্যা আছে, এবং তুলনামূলক ভাবে সেগুলো কোথায় বেশি বা কম জানা সোজা নয়, তাই ত্রাণ বা সাহায্যের প্যাকেজে দুটোই রাখা উচিত। এই সময়ে নগদ বনাম গণবণ্টন, এই দুটি নীতি একটি অন্যটির বিকল্প নয়, বরং সম্পূরক— আমাদের এই বক্তব্যের পক্ষে এটা আর একটা যুক্তি।
গত তিন মাসে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছনোর কিছু চেষ্টা ভারতে হয়েছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার বরাদ্দ বেড়েছে; মহিলা ও বয়স্কদের জন্য প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের ব্যবস্থা হয়েছে— কিন্তু, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। তার থেকেও বড় কথা, সেই টাকাটা সবার জন্য নয়। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, নভেম্বর অবধি রেশনে বাড়তি বরাদ্দ মিলবে। সেটাও সম্ভবত যথেষ্ট নয়। এই মুহূর্তে একই সঙ্গে জোর দিতে হবে সর্বজনীন গণবণ্টনে, আর প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরে। অন্তত, যত দিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, এ ছাড়া উপায় নেই।
ঘটনা হল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতেও এই ব্যবস্থাগুলোর গুরুত্ব বিপুল। প্রথমত, অর্থনীতি যখন বিপাকে পড়ে, মোট সম্পদ সঙ্কুচিত হতে থাকে, তখন তার ভাগ পাওয়ার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠেন। তার ফলে যে সামাজিক অব্যবস্থা তৈরি হয়, সেটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার পথে মস্ত বাধা। কাজেই, সবার প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি মেটানোর দায়িত্ব অস্বীকার করলে সমাজের, এবং অর্থনীতির, ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯’এর কবলে পড়ার আগেই ভারতীয় অর্থনীতি ধুঁকছিল— মূলত চাহিদার অভাবে। বাজারে চাহিদা ফিরিয়ে আনা হল এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র পথ। মানুষের হাতে খরচ করার মতো টাকার জোগান দেওয়া গেলেই সেই চাহিদা ফিরবে। দ্বিতীয় কোনও পথ নেই।
এই মুহূর্তে সরকার একই সঙ্গে পিডিএস-ওয়ালা আর ক্যাশ-ওয়ালাদের পরামর্শ শুনে চললে অর্থনীতি বাঁচবে।
মৈত্রীশ ঘটক লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এ অর্থনীতির অধ্যাপক