ছবি: পিটিআই।
ভারতে কোভিড-সংক্রমণে মৃত চিকিৎসকের সংখ্যা একশত ছাড়াইল, চিকিৎসক সংগঠনের হিসাবে জুলাইয়ের গোড়ায় এমনই চিত্র মিলিতেছে। এই রাজ্যে সরকারের তরফে অবশ্য আক্রান্ত চিকিৎসক, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা জানা যায় নাই, কেন্দ্রীয় সরকারও দুই-এক বার কিছু সম্ভাব্য পরিসংখ্যান দিয়া নীরব হইয়াছে। তাই ভারতে কত চিকিৎসক করোনাভাইরাস সংক্রমণে অসুস্থ হইয়াছেন বা প্রাণ হারাইয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গেই বা চিকিৎসকদের বিপন্নতার চিত্র কী, তাহার সরকারি সংখ্যা জানা নাই। অথচ সমস্যাটি যে গুরুতর আকার ধারণ করিতেছে, তাহার ইঙ্গিত সর্বত্র। নানা সূত্রে রোজই চিকিৎসকদের সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির খবর আসিতেছে, আঘাত হানিতেছে মৃত্যুসংবাদও। বেদনা তীব্রতর এই তথ্যে যে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে কোভিড-মৃত্যুর গড় বয়সের তুলনায় কোভিড-যুদ্ধের শহিদ চিকিৎসকেরা নবীনতর। আক্ষেপ: চিকিৎসকদের মৃত্যু কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ছিল না। চিন, ইটালি, স্পেনে চিকিৎসকদের মধ্যে কী রূপে সংক্রমণ ছড়াইয়াছে, তাহার মোকাবিলায় কী ধরনের পদ্ধতি কার্যকর হইয়াছে, এই বিষয়গুলি আগাম জানিবার সুযোগ ভারত পাইয়াছিল। অতএব কর্তব্য লইয়া বিভ্রান্তি ছিল না। কার্যক্ষেত্রে সেই সকল সতর্কবার্তা উপেক্ষিত হইল। যথেষ্ট চিকিৎসক মিলিল না, যথেষ্ট সুরক্ষা-সরঞ্জাম জোগানো হইল না, যাহা মিলিল তাহার মান লইয়া প্রশ্ন আছে। সংক্রমণ এড়াইবার যথাযথ পদ্ধতির প্রশিক্ষণে ফাঁক থাকিল, তাহার অনুসরণের উপযোগী ব্যবস্থা হাসপাতালে জোগানো হইল না। ফলে দেশব্যাপী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সচেতন থাকিলেও বিপদ আটকানো যাইতেছে না।
নানা রাজ্যে দেখা যাইতেছে, চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ নিষ্ক্রিয় থাকিয়া দায়িত্ব এড়াইতেছেন। সরকার জনস্বার্থে তাঁহাদের কর্তব্যে নিয়োজিত করিতে পারে নাই। ফলে অল্প কিছু চিকিৎসককে অনেকের কাজ করিতে হইতেছে। সরকারি বা বেসরকারি, উভয় ক্ষেত্রের হাসপাতালে দেখা গিয়াছে, একই সুরক্ষাবর্মে আপাদমস্তক আচ্ছাদিত অবস্থায় ছয় ঘণ্টার জায়গায় আট-নয় ঘণ্টা টানা কাজ করিতেছেন ডাক্তাররা। অনেক ক্ষেত্রে সাত দিন কাজ ও সাত দিন বিচ্ছিন্ন-বাসের নিয়মও লঙ্ঘিত হইতেছে। ইহা কেবল কষ্টসাধ্যই নহে, ইহাতে সুরক্ষার নিয়মবিধি লঙ্ঘিত হইতেছে, সংক্রমণের সুযোগ বাড়িতেছে। বহু ক্ষেত্রে সহযোগী কর্মী ও সরঞ্জামও যথেষ্ট নাই, তাই স্টেথোস্কোপ বা রক্তচাপ মাপিবার যন্ত্র সংক্রমণমুক্ত করিবার অবকাশ নাই। এই দেশের হাসপাতালগুলি প্রায়শই উপযুক্ত নকশা মানিয়া নির্মিত হয় না, তাই সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজ দৈনন্দিন কাজের ছন্দে ঘটিয়া যায় না। তাহার জন্য বিশেষ কসরত করিতে হয়। স্বভাবতই, রোগীর ভিড় বাড়িলে তাহা উপেক্ষিত হইতে চায়। এই সকল ছোট ছোট ত্রুটির ফল অতিমারির সময়ে বৃহৎ হইয়া ওঠে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন বিপন্ন হয়।
কোভিডের সহিত চিকিৎসকের যুদ্ধ সহজে থামিবার নহে। অতএব কোনও মতে জোড়াতালি দিয়া চালাইবার মনোভাব ত্যাগ করা জরুরি। কর্তব্য-উপেক্ষারত চিকিৎসকদের চিহ্নিত করিয়া এখনই কাজে আনিতে হইবে, যাহাতে কর্তব্যপরায়ণ চিকিৎসকের সংক্রমণ-ঝুঁকি কমিতে পারে। যথেষ্ট পরিমাণে, এবং যথাযথ মানের পিপিই, স্যানিটাইজ়ার ও অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করিতে হইবে। উপযুক্ত উপদেষ্টার দ্বারা সুরক্ষাবিধি প্রণয়ন করিতে, তাহার অনুসরণ নিশ্চিত করিতে চিকিৎসক, নার্স-সহ হাসপাতালের সকল স্তরের কর্মীদের নিরন্তর প্রশিক্ষণ চালু রাখিতে হইবে। যাঁহারা প্রাণ বিপন্ন করিতেছেন, তাঁহাদের প্রাণরক্ষায় সামান্য ত্রুটিও যেন না থাকিয়া যায়। দেশ তাঁহাদেরই মুখের দিকে চাহিয়া।