Kanhaiya Kumar

অপব্যবহার

রাষ্ট্র নিজেকে অত্যন্ত ঠুনকো ভাবিলেই এই আপত্তি ও প্রশ্নের সামনে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িতে পারে। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share:

চার বৎসর আগে ফেব্রুয়ারি মাসেই দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির ছাত্রেরা আয়োজন করিতে চাহিয়াছিল একটি কবিতাপাঠ বৈঠকের। একটি সুপরিচিত কবিতার নামে রাখা হইয়াছিল বৈঠকের নাম: ‘যে দেশে ডাকঘর নাই।’ বৈঠকের অন্যতম উপলক্ষ ছিল, ভারতীয় সংসদ-হানায় অভিযুক্ত এক কাশ্মীরি যুবা আফজ়ল গুরুর মৃত্যুদণ্ডের তৃতীয় বার্ষিকী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট অনুমতি না পাইয়া ছেলেমেয়েরা সেখানে প্রতিবাদ মিছিল শুরু করে, যেখানে এবিভিপি ও আরএসএস তাহাদের আক্রমণ করিলে বড় ধরনের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়, যে সংঘর্ষের মধ্যে নাকি আজাদি ইত্যাদি স্লোগান শোনা গিয়াছিল অনেকের মুখে। কানহাইয়া কুমার সেই ‘অনেক’-এর এক জন বলিয়া কথিত। দিল্লি পুলিশ তাঁহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে। অনেক দূর গড়াইবার পরও আদালতে বিষয়টি আগাইতে পারে নাই, কেননা রাজ্য সরকারের অনুমোদন ব্যতীত তাহা সম্ভব নহে। আপ সরকার গত বৎসরের মাঝামাঝি পর্যন্ত নানা অজুহাতে সেই অনুমোদন দেয় নাই। এই বার ২০২০ সালে দ্বিতীয় বার নির্বাচনে জিতিয়া আসিয়া আবারও এক ফেব্রুয়ারির শেষে, আপ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবাল অবশেষে কানহাইয়া কুমারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সেই বিজেপি-প্রত্যাশিত অনুমোদনটি দিলেন।

Advertisement

ঘটনাটি অতীব দুর্ভাগ্যজনক। প্রথমত, বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণ বলিতেছে যে, অভিযোগটি আদৌ সত্য নহে। পুলিশ যে ভিডিয়ো দেখাইয়াছে, তাহা নকল। নকল বলিয়াই দিল্লি সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর যে আইনজীবীদের পরামর্শ লহিয়াছিল, তাঁহারা রাজ্য সরকারকে ‘সায়’ দিতে বারণ করেন। কানহাইয়া কুমারের নিজের মুখে একটিও স্লোগান নাকি শোনা যায় নাই। দ্বিতীয়ত, আজাদি ইত্যাদি স্লোগান যখন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে গোটা দেশে দাবানলের মতো ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তখন এই অভিযোগকে এত গুরুত্বসহকারে নতুন করিয়া সামনে আনিবার যুক্তিই নাই। ‘আজাদি’ যে রাষ্ট্র হইতে আলাদা হইতে চাওয়ার বদলে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অন্যায়ের শাসন হইতে মুক্তিও বুঝাইতে পারে, বিশেষত একটি প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মুখে— গণতান্ত্রিক দেশে ইহা ভাবা অস্বাভাবিক কঠিন নহে। প্রসঙ্গত, আফজ়ল গুরুর ফাঁসি লইয়া নানা পদ্ধতিগত ও আদর্শগত আপত্তি বহু স্তরেই আলোচিত, চর্চিত হইয়াছে গত কয়েক বৎসরে। কানহাইয়া কুমাররাই একমাত্র প্রশ্নকারী বা আপত্তি প্রদর্শনকারী নহেন। বাস্তবিক, রাষ্ট্র নিজেকে অত্যন্ত ঠুনকো ভাবিলেই এই আপত্তি ও প্রশ্নের সামনে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িতে পারে।

মূল সঙ্কট রাষ্ট্রদ্রোহের আইনটি লইয়াই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ইহার সাহায্যে সাধারণ মানুষকে তৎকালীন রাষ্ট্র দমাইয়া রাখিত। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতীয় রাষ্ট্রও কি নাগরিকের প্রতি সেই রকম ব্যবহার করিতে চাহে? অথচ ইহা যে সর্বতো ভাবে অন্যায়, এবং নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী, প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুই তাহা বলিয়াছিলেন। কঠোর সমালোচনা করিয়াছিলেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রবিরোধিতার ক্ষেত্রের জন্য তুলিয়া রাখিবার বদলে যে কোনও ক্ষেত্রে নাগরিকের মৌলিক বাক্‌স্বাধীনতা হরণ করিয়া তাহাকে দমনপীড়নের জন্য ‘সিডিশন’ আইন ব্রহ্মাস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হইতেছে। অরবিন্দ কেজরীবাল একা নহেন। এনডিএ-ও একা নহে। ইউপিএ আমলেও রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল হয় নাই। দশকের পর দশক ধরিয়া দেখা গিয়াছে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটির ক্ষেত্রে সব দলেরই এক রা, এক নিস্পৃহতা। যে পায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা, সে-ই বুঝিয়া লয় রাষ্ট্রদ্রোহ নামক জুজুর অসীম মাহাত্ম্য। সামান্য কারণ বা অকারণেও সেই জুজু ব্যবহার করিয়া নাগরিককে শায়েস্তা রাখিবার পথটি সকল শাসকেরই অতিশয় প্রিয়। এবং গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত একটি পরিহাসে পরিণত।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement