—ফাইল চিত্র
জলাজমি হইতে এমন জীবাণুর খোঁজ মিলিয়াছে, যাহা প্লাস্টিক পচাইয়া মাটির সহিত মিশাইতে পারে। দিল্লির উপকণ্ঠে শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে সুখবর। ভারতের জমি-জলাশয়ে বৎসরে দেড় কোটি টনেরও অধিক প্লাস্টিক দ্রব্য পরিত্যক্ত হইতেছে। এই বিপুল বর্জ্য মাটিতে মিশাইতে ওই জীবাণু কতটা কার্যকর হইবে, সময়ই তাহা বলিবে। কিন্তু হতাশার কৃষ্ণমেঘে ওই আবিষ্কারের সংবাদটিই একমাত্র রুপালি রেখা। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণের কঠিন কর্তব্য এড়াইয়াছে। ২০২২ সালের মধ্যে দেশকে প্লাস্টিকমুক্ত করিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি স্বাধীনতা দিবসে প্লাস্টিক ব্যবহার কমাইতে আবেদন করিয়া, গাঁধীজয়ন্তীতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা করিবার আশ্বাস দেন। সরকারি দফতর হইতে ইঙ্গিত মিলিয়াছিল, অন্তত ছয়টি প্লাস্টিক দ্রব্যের নির্মাণ, মজুত এবং আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হইবে। তাহাই হইবে প্লাস্টিকমুক্তির সূচনা। অক্টোবরের দ্বিতীয় দিবসে প্রধানমন্ত্রী নীরব রহিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কেবল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করিয়া, প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাপড়ের ব্যাগ লইয়া বাজার করিবার পরামর্শ দিয়াছেন মহিলাদের। ইহাই সরকারের কাজ বটে। যাঁহাদের উপর আইন করিবার ভার ন্যস্ত করা হইয়াছে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত লইবার দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছে, তাঁহারা নাগরিকের বিবেকের নিকট আবেদন করিয়া কর্তব্য সারিতেছেন। এমন আবেদন যে বহু রাজ্যের বহু পুরসভা নাগরিকের নিকট করিয়াছে, এবং তাহাতে প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে সাফল্য মেলে নাই, তাহা কি কেন্দ্রের অজানা? যাহা সুলভ, তাহার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য। উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্লাস্টিক দুর্লভ হইলে লোকে বিকল্পের ব্যবহারে অচিরেই অভ্যস্ত হইয়া উঠিত।
তাহা হইলে প্লাস্টিক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে সরকারের এই দ্বিধা কেন? ঔষধ-সহ অপর কয়েকটি অতি-জরুরি পণ্যের মোড়ক উৎপাদনে প্লাস্টিকের ব্যবহারের অনুমোদন রাখিতে পারিত সরকার, অন্তত প্রথম পর্যায়ে। এখনই নিষিদ্ধ করিবার মতো একটিও প্লাস্টিক পণ্যও কি সরকার খুঁজিয়া পায় নাই? তাহাতে একটি সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছাইত যে প্লাস্টিক পণ্যের দিন শেষ। বিকল্পের সন্ধান শুরু হইত। সংবাদে প্রকাশ, জনগণের অসুবিধা নহে, বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির কথা ভাবিয়াই পিছাইয়াছে সরকার। অধিকাংশ পণ্য প্লাস্টিকে মোড়কবন্দি হয়। উৎপাদন বন্ধ করিলে ব্যবসা মার খাইবে, অর্থনীতি চোট খাইবে। এই মন্দার বাজারে সরকার সেই ঝুঁকি লইতে রাজি নহে। এই যুক্তিটি বিচারের প্রয়োজন আছে। ব্যবসার সুরক্ষা সরকারের কর্তব্য, সন্দেহ নাই। কিন্তু পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাও কি সরকারের কর্তব্য নহে? প্লাস্টিক বর্জ্য যে কী বিপুল সঙ্কট তৈরি করিয়াছে, তাহা কাহারও অজানা নহে। মোদীর নিয়ত-প্রচারিত ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘স্মার্ট সিটি’, ‘নমামি গঙ্গে’ প্রভৃতি প্রকল্পকে প্রহসনে পরিণত করিতেছে প্লাস্টিক বর্জ্য। প্লাস্টিক বর্জ্য-নির্গত রাসায়নিক শরীরে প্রবেশ করিয়া মারণরোগের জন্ম দিতেছে। মহাসাগরে মরিতেছে মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মূল্যে অর্থনীতিকে বাঁচাইতে হইবে, ইহা কেমন নীতি?
ইহা সত্য যে, সাধারণ নাগরিক তাহাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে অনেক কুপ্রথা বদলাইতে পারে। ব্রিটেনে তরুণ প্রজন্ম প্লাস্টিক-বন্দি দুধ বর্জন করিতেছে, কাচের বোতলে দুধ বাড়ি বাড়ি সরবরাহের প্রথা ফিরিতেছে। ভারতেও ক্রেতাদের এমন চেতনা জরুরি। তাহার জন্য পরিবেশ সুরক্ষা ও ক্রেতা অধিকার আন্দোলনকে আরও তৎপর হইতে হইবে। কিন্তু নাগরিক পথ দেখাইবে, ইহাই কি সরকারের প্রত্যাশা? কঠোর সিদ্ধান্ত এড়াইয়া কেবল জনমোহিনী ঘোষণা দেশবাসীর সহিত প্রতারণা।