ফাইল ছবি
বার্লিন শহরে একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন হইয়াছে। শিরোনাম: লন্ডন ১৯৩৮। ইহার পিছনে রহিয়াছে আর এক প্রদর্শনীর ইতিহাস। ১৯৩৮ সালে লন্ডন শহরে ৬৪ জন জার্মান শিল্পীর আঁকা তিন শত ছবির এক সম্ভার দর্শকদের সম্মুখে পেশ করা হইয়াছিল। সেই শিল্পীদের অনেকেই তখন হিটলারের তাড়নায় দেশ ছাড়িয়া অন্যত্র আশ্রয় লইয়াছেন। তিন শত ছবির মধ্যে বেশ কিছু স্বদেশের বিভিন্ন সংগ্রহশালা হইতে সরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। নাৎসি শাসকদের মতে, ওই সব শিল্পকর্ম অবক্ষয়ের প্রতীক, ওই শিল্পীরা অপসংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এই পরিস্থিতিতেই ওই শিল্পীরা এবং তাঁহাদের শুভার্থীরা প্রদর্শনীটি সাজাইয়াছিলেন, যাহা দেখিয়া বাহিরের পৃথিবী জানিবেন, নাৎসিরা কী ভাবে শিল্পসৃষ্টির পথ রোধ করিতেছে। রীতিমতো সাড়া জাগিয়াছিল সেই আয়োজনে, নাগরিকদের পাশাপাশি ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধারা ছবি দেখিয়াছিলেন, দর্শকতালিকায় ছিল ভার্জিনিয়া উলফ এবং পাবলো পিকাসোর নাম। সমালোচকরা শিল্পকৃতির গুণমান লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, কিন্তু উদ্যোগের রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল প্রশ্নাতীত। নাৎসি জমানার প্রকৃত চেহারা ও চরিত্র তখনও, অন্তত দেশের বাহিরে, সম্পূর্ণ প্রকট হয় নাই, কিন্তু লক্ষণগুলি স্পষ্ট হইতেছে। এই প্রদর্শনী তাহাদের স্পষ্টতর করিয়াছিল, বিচক্ষণ দর্শকরা দেওয়ালের লিখন পড়িয়া লইয়াছিলেন। সেই পাঠ ব্যর্থ হয় নাই। প্রদর্শনীতে যাঁহাদের শিল্পকৃতি ছিল, তাঁহাদের অনেকেই পরবর্তী অধ্যায়ে প্রবল নিপীড়নের শিকার হন, বন্দিশিবিরে কত জনের মৃত্যুও হয়।
আট দশক পূর্বের সেই উদ্যোগটির স্মরণে বার্লিনের বর্তমান প্রদর্শনীটিতে সেই সম্ভারের ত্রিশটি ছবি স্থান পাইয়াছে। সঙ্গে রহিয়াছে ত্রিশের দশকের সেই উদ্যোগের বিশদ পরিচিতি। প্রদর্শনীর সম্পূর্ণ নাম, লন্ডন ১৯৩৮: ‘অবক্ষয়ী’ জার্মান শিল্পের সমর্থনে। ভাবনায় এবং নামকরণে উদ্যোক্তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট। এই উদ্যোগ নিছক স্মৃতিচারণা নহে, জার্মানি তথা ইউরোপের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সহিত ইহার গভীর সংযোগ রহিয়াছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী কয়েক দশক ধরিয়া জার্মানির মানুষ হিটলার ও নাৎসি বাহিনীর পৈশাচিক তাণ্ডবের বিভীষিকা হইতে মানসিক মুক্তি খুঁজিয়াছেন। প্রতিক্রিয়ার শক্তি অন্তর্হিত হয় নাই, নব্য-নাৎসিদের মাথা চাড়া দিবার চেষ্টা মাঝে মাঝেই দেখা গিয়াছে, কিন্তু বৃহত্তর সমাজ ও রাজনীতির প্রবল বিরোধিতার সম্মুখে সেই অপশক্তি অনেক দিন অবধি পিছু হটিতে বাধ্য হইয়াছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে গোটা ইউরোপ জুড়িয়া উগ্র ও অসহিষ্ণু অতিজাতীয়তার যে আগ্রাসী অভিযান উত্তরোত্তর প্রবল হইতে প্রবলতর, জার্মানিও তাহা হইতে রেহাই পায় নাই। দক্ষিণপন্থী এএফডি-র অভূতপূর্ব নির্বাচনী সাফল্য তাহার প্রমাণ। চান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল এখনও গড় রক্ষা করিতেছেন, কিন্তু তিনি ভিতরে বাহিরে পর্যুদস্ত, তাঁহার রাজনৈতিক পরমায়ুর ভরসা তাঁহার অনুরাগীদেরও বিশেষ নাই।
এই পরিপ্রেক্ষিতে নাৎসি-বিরোধী প্রদর্শনীটি মনে করাইয়া দিতেছে, স্বৈরাচারের দাপটে উদার গণতন্ত্রের মানসলোক কী ভাবে বিপন্ন হয়, কী ভাবে তাহার কোপ নামিয়া আসে সাংস্কৃতিক সৃষ্টি ও স্রষ্টার উপর। নানা দেশের ইতিহাসে এই প্রবণতা বারংবার দেখা গিয়াছে। তাহা অনিবার্য। যথার্থ শিল্প সতত সার্বভৌম। শিল্পী তাঁহার সৃষ্টির ভুবনে দাবি করেন নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। ক্ষমতাবানের হুকুম মানিয়া তিনি কাব্য রচনা করিতে পারেন না, ছবি আঁকিতে পারে না, ভাস্কর্য রচনা করিতে পারেন না, গান বাঁধিতে পারেন না। সুতরাং ক্ষমতা যথার্থ শিল্প ও শিল্পীকে সহ্য করিতে পারে না। হিটলার-মুসোলিনি-স্তালিনরা যখন স্বাধীনচেতা শিল্পীদের কাজকে অবক্ষয়ী অথবা প্রতিক্রিয়াশীল বলিয়া দাগাইয়া দেন এবং সেই অপরাধে তাঁহাদের উপর নিপীড়ন চালান, তখন তাঁহাদের প্রকৃত নিশানা ব্যক্তিস্বাধীনতা। বার্লিনের প্রদর্শনীটি এই মৌলিক সত্যের স্মারক। এই সত্য সমকালীন দুনিয়ার বহু দেশেই বিশেষ প্রাসঙ্গিক। ভারতেও। যাঁহারা নিজের কথা নিজের মতো করিয়া বলিতে চাহেন, ক্ষমতাবানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলিতে চাহেন, তাঁহাদের উপর কী ভাবে ক্ষমতার দাপট নামিয়া আসিত পারে, ভারত তাহা গত সাড়ে চার বছরে ভয়াবহ রূপে দেখিয়াছে। যাঁহারা এই বিপদের স্বরূপ দেখিয়াও দেখিতে নারাজ, কোনও প্রদর্শনীই অবশ্য তাঁহাদের ঘুম ভাঙাইতে পারিবে না।
যৎকিঞ্চিৎ
হাতের লেখা খারাপ হওয়ায় মোল্লা নাসিরউদ্দিন বলেছিলেন, ‘‘চিঠি লিখতে পারব না, আমার পায়ে ব্যথা।’’ হায়, এ দেশের ডাক্তাররা আর পায়ে ব্যথার অজুহাতে প্রেসক্রিপশন লেখা বন্ধ করতে পারবেন না! নীতি আয়োগের ঢালাও নির্দেশ, প্রেসক্রিপশন পড়ার মতো হতেই হবে, ডাক্তারদের হাতের লেখা যেন খারাপ না হয়! হাতের লেখার উন্নতি না করা গেলে টাইপ করে ওষুধ লিখতে হবে। দিনকাল যা মন্দ, কে জানে, ডাক্তারি পাশ করতে এ বার হয়তো হাতের লেখার পরীক্ষাও শুরু হবে।