লোকসভা ভোটে আপাতদৃষ্টিতে বাংলায় হিন্দুত্বের ঝড় বয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কবিতাতেও এই মেরুকরণের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ। তবে পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে একটু অন্য রকম লাগতে পারে। ২০১৪’র তুলনায় বাংলার ভোটারের শতকরা বাড়তি ২৩ জন এ বার অন্য দল ছেড়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু চিত্র সর্বত্র সমান নয়। কলকাতা ও আশেপাশের শহরাঞ্চলে, যেখানে শেষ দফায় ভোট হয়েছে, গড়টা ১৩%। মালদহ আর মুর্শিদাবাদ, কংগ্রেসের ঘাঁটি, সেখানেও ১৩%। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের বাকি জায়গায়, হুগলি, দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, আর জঙ্গলমহলে বিজেপির নতুন ভোটার ১০০’তে ৩৩ জন। অন্য দিকে, তৃণমূলের ভোট সারা বাংলায় বেড়েছে ৪ শতাংশের মতো। গ্রামীণ হুগলি, দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া আর জঙ্গলমহলে ৫% কমেছে ভোট, তার মধ্যে অধিকারী সাম্রাজ্যও আছে। উত্তরবঙ্গে ভোট বেড়েছে গড়ে প্রায় ৫%, তবু সব আসনে হারতে হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভোট বেড়েছে শেষ দফায়, প্রায় ৯ শতাংশ। তৃণমূলের এই ভোটবৃদ্ধির কতটা মেরুকরণের ফল, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
বামেদের হাল ভয়াবহ। গত লোকসভা ভোটের প্রতি চার জন বাম ভোটারের তিন জন এ বার অন্য কোথাও ভোট দিয়েছে, মূলত বিজেপিতে, খানিক তৃণমূলে। তুলনায় কংগ্রেসের ক্ষরণ কম। ২০১৪’তে মালদহ আর মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের ভোট ছিল ৩৭ শতাংশ, এ বার ৩০। কংগ্রেসের ঘর ভাঙতে তৃণমূল প্রাণপণ চেষ্টা না করলে হয়তো এটুকুও হত না, মালদহ উত্তর আসন বিজেপি পেত না।
দু’টি দল মিলে পুরো রাজ্যের মোট ভোটের ৮৪% পেয়েছে। বাংলার এই মেরুকরণ কি পুরোটা ধর্মীয়? তথ্য দেখলে আর তলিয়ে ভাবলে দেখা যায় রাজ্যের শাসকের প্রতি ক্ষোভ আর দেশের শাসকের প্রতি ভয়ের মেরুকরণ, যেখানে যেটা বেশি। যে সব গ্রামীণ এলাকায় সংখ্যালঘু মানুষ বেশি, সেখানে সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলে সংহত হয়েছে বিপদের আশঙ্কায়। কলকাতা ও শহরাঞ্চলে তৃণমূলের ভোট খানিকটা বেড়েছে, কারণ শহুরে মানুষের একাংশ আগুনের থেকে তপ্ত চাটুকে শ্রেয় মনে করেছেন। শেষ দফা বাদ দিলে তৃণমূলের আসন এসেছে ৩৩-এর মধ্যে ১৩টি, তাই শেষ দফায় ৯টি আসনের সব ক’টায় জয়ে একটু অন্য রকম ছবি ধরা দেয়।
গ্রামবাংলার একটা বড় অংশে শাসকের প্রতি ক্ষোভ একজোট হয়ে তছনছ করে দিয়েছে উন্নয়নের সাজানো বাগান। এই ক্ষোভ পঞ্চায়েতে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ না করতে পারার ক্ষোভ, উন্নয়নের সঙ্গে তোলাবাজির সহাবস্থানের ক্ষোভ, স্থানীয় স্তরে অত্যাচার ও দুর্নীতির ক্ষোভ। পুরোটাই নেগেটিভ ভোটের মেরুকরণ। বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ করার পণ থেকে যে ভাবে বিরোধীদের দুরমুশ করার প্রয়াস চলেছে গত কয়েক বছরে, তাতে খাল কেটে কুমির আবাহনের পথ অতি যত্নে তৈরি হয়েছে। যে কোনও শাসকের কৌশল থাকে বিরোধিতার একাধিক মুখ খুলে রাখার, যাতে মানুষের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা প্রকাশের জায়গা পায়। বামেদের শাপান্ত করে এখন তো লাভ নেই, টুঁটি চিপে তাকে আগেই রক্তশূন্য করে দেওয়া হয়েছে, ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়েছে গেরুয়া-ঝড়।
কিন্তু বামেরা? গত ভোটেও তাদের ৩০% ভোট ছিল, সব ভূতের ফাঁকি হয়ে গেল? বিজেপি আর তৃণমূলের সেটিংয়ের কথা বলে, আর সমদূরত্বের থিয়োরি খাড়া করে তারাই দূরে বিলীন হয়েছে, কারণ এই মেরুকরণের পরিবেশে তারা নিজেদের জন্য কোনও জনগ্রাহ্য জায়গা তৈরি করতে পারেনি। শাসনক্ষমতা না থাকলে কী ভাবে নিজেদের সংগঠন ধরে রাখতে বা তৈরি করতে হয়, সে ব্যাপারে কোনও ভরসা বামকর্মীরা তাঁদের নেতৃত্বের থেকে পাননি। ফলে, শাসক দলের আগ্রাসনের সামনে নিজেকে বাঁচাতে গেরুয়া পতাকার তলায় আশ্রয় নিয়েছেন দলে দলে। এর কতটা রামভক্তি থেকে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি বিপদ কতটা, সেটা বুদ্ধবাবু বিবৃতি দিয়েও বোঝাতে পারেননি।
এ বারের নির্ণায়ক ভোটের আবহে, জেতা সম্ভব এমন ছবি প্রায় কোনও বামপ্রার্থী তুলে ধরতে পারেননি, তাই বামেদের থেকে বেরিয়ে ভোট চলে গিয়েছে অন্য অভিমুখে। কিন্তু তৃণমূলের আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়েও কংগ্রেসের প্রার্থী যে জিততে পারেন, এই ভরসাটা একটা বড় সংখ্যক মানুষ এই বাজারেও করেছেন। এইখানটায় বামেদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। ৩০% ভোট পাওয়া একটা দল মিডিয়া থেকে যে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল, সেটা কি মিডিয়ার সামাজিক দায়িত্ব? না কি একটা দলকে জানতে হবে আজকের দিনে কী ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছতে হয়। আসলে বামেদের নেতৃত্বের ভাবনার চলন ভোটারের মনের থেকে কয়েক যোজন দূরে চলে গিয়েছে।
সব মিলিয়ে বাংলার দশা চিঁড়েচ্যাপ্টা, অনেকটা দেশের মানচিত্রে রাজ্যের ম্যাপটার মতো। ডান দিক থেকে উগ্র ইসলামি শক্তি অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে, শোনা যায় অর্থেরও প্রবেশ ঘটছে। শাসক দল সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে আর ভোট সংহত করার চেষ্টা করছে মাদ্রাসার বিস্তার, ইমামের ভাতা আর নমাজের পোস্টারে মন দিয়ে— মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির উদ্যোগ গৌণ। কয়েকটি ছেলের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির প্ররোচনা উপেক্ষা করতে না পেরে উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখানো— সেই ফাঁদটাকেই প্রতিষ্ঠা দেয়। আজ চাপে পড়ে অন্য উদ্যোগ নিলেও তা মেকি দেখাবে। অন্য দিকে, বাঁ দিক থেকে আসছে উগ্র হিন্দুত্বের ঢেউ— রামনবমীর তরোয়াল ও গদার আস্ফালন ঢুকতে চাইছে বাংলার সংস্কৃতির মূলস্রোতে। গোবলয়ের সেই শক্তি মনীষী আর দেবদেবীর প্রভেদ বোঝে না, তাই বিদ্যাসাগরের পঞ্চধাতুর বিগ্রহ বানিয়ে তুষ্ট করতে চায়।
মনে হয় রাজ্যের ভবিষ্যৎ দুই মেরুর আবর্তেই ঘুরপাক খাবে। কিন্তু বাঙালিত্বের নিজস্ব পরিসর আজও আছে। আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির কাছে তার নিজের সংস্কৃতি তার পরম আপন, ধর্ম যেখানে প্রধানত সামাজিক উৎসব। চিকেন রোল খেতে খেতে দেবীদর্শন, বা দেবীকে বাড়ির মেয়ের আদর, এ সবই বাংলার নিজস্ব। তেমনই, এ রাজ্যের অধিকাংশ মুসলমান আগে বাঙালি, তার পরে মুসলমান। চিন্তা বা আদর্শে সামাজিক সাম্যের আকুতি বাঙালিকে আজও স্বভাব-বামপন্থী করে রেখেছে। শতাংশের হিসাব যা-ই হোক, বাংলায় তৃণমূল বা বিজেপির কোনও স্থায়ী ভোটব্যাঙ্ক নেই, সবাই পরিস্থিতির ভোটার। তাই এই পরিসরটা শুধু অপেক্ষা করছে কোনও এক নেতৃত্বের জন্যে।