কলকাতায় গাঁধীর প্রথম পা, কিছু অভিজ্ঞতা

সেই ক্ষতবিক্ষত সময়ে তাঁর কলকাতায় পা দেওয়া, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েন দেশের আনাচ কানাচে, মোহনদাস তখনও মহাত্মা হয়ে ওঠেননি, লিখছেন রাজনারায়ণ পালশহর কলকাতা থেকে এ বিদায় মহাত্মার শেষ বিদায়। দিনটা ছিল ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর।

Advertisement

রাজনারায়ণ পাল

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৫:৪১
Share:

দাঙ্গা-বিধ্বস্ত নোয়াখালি থেকে ফিরে কলকাতা হয়ে গাঁধীজি চলেছেন দিল্লির পথে। দিল্লিগামী ট্রেন ধরতে হাওড়া স্টেশন যাওয়া দরকার। কিন্তু বেলেঘাটার হায়দার মঞ্জিল থেকে গাঁধীকে নিয়ে আর হাওড়া যাওয়া হল না। গোয়েন্দা দফতরের খবর অনুযায়ী কলেজ স্ট্রিট ও বড়বাজারে গাঁধীজীর গাড়ির উপরে উগ্র হিন্দুদের আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। তাই গোপনে বিটি রোড দিয়ে দক্ষিণেশ্বর হয়ে বেলুড় স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দিল্লিগামী ট্রেন থামিয়ে গাঁধীজিকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হল। প্ল্যাটফর্মে তখন অন্য অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে একদা মহাত্মার পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ হুসেন শাহিদ সুরাবর্দি। যিনি কিছু দিন আগেই হায়দার মঞ্জিলে গাঁধীর সঙ্গে অনশনে বসেছিলেন দাঙ্গার দাগ লেগে থাকা কলকাতার ক্ষত নিরাময়ে। তাঁর চোখে জল। বিদায়ের সেই যাত্রীকালে সুরাবর্দি বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বিলাপ করেছিলেন এই বলে, ‘‘এই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে এ ভাবে লুকিয়ে বাংমলা থেকে যেতে হল।’’

Advertisement

শহর কলকাতা থেকে এ বিদায় মহাত্মার শেষ বিদায়। দিনটা ছিল ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর।

তবে শেষের শুরুটা অবশ্য অন্য রকম ছিল। তখনও গাঁধীজি মহাত্মা হয়ে ওঠেননি। যদিও তার পিছনে সক্রিয় থেকে মোহনদাস হয়ে ওঠার এক কাহিনি ছিল বটে ব্যরিস্টার হওয়ার পরে সেই জীবন-জীবিকার সন্ধানে চলেছেন সাগর পাড়ের দেশে—দক্ষিণ আফ্রিকা। সেটা ১৮৯০ সালের এপ্রিল মাসের কথা। লামু-মোম্বালা-জাঞ্জিবার-মোজাম্বিক হয়ে অবশেষে পৌঁছলেন নাটাল, অখ্যাত থেকে খ্যাতির আলোয় নিয়ে যাওয়ার কর্মভূমিতে।

Advertisement

দক্ষিণ আফ্রিকার দাদা আবদুল্লা কোম্পানীর সঙ্গে তখন চল্লিশ হাজার পাউন্ডের দাবির আইনি লড়াই চলছে তারই আত্মীয় তায়েব শেঠের সঙ্গে ট্রান্সভালের রাজধানী প্রিটারিয়ার আদালতে। এই মামলায় ইউরোপীয় আইজীবী ও কোম্পানীর মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী আইনজীবীর ভূমিকা নিতে সুদূর ভারত হতে মাত্র এক বছরের জন্য তাঁর এখানে আসা। কিছু দিনের মধ্যেই সে মামলা আদালতের বাইরে দু’পক্ষকে সামনে বসিয়ে মিটিয়ে দিলেন। সুবিধা ছিল যে, বিবাদমান দু’পক্ষই পরস্পরের আত্মীয়। মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় গাঁধীর দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেল। এমনি সময় এমন ঘটনা ঘটল, যা শুধু তার দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকেই বিলম্বিতই করল না,জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে দিল। এক সাধারণ ব্যরিস্টার থেকে তিনি হয়ে উঠে জগৎজোড়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ঘটনাটি হল—এ সময়ে নাটাল আইন সভা ভারতীয়দের ভোটাধিকার রদ করার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। এ আইন গৃহীত হলে নাটালে ভারতীয়দের অবস্থা শোচনীয় হবে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দক্ষি আফ্রিকার ভারতীয়রা প্রতিবাদে শামিল হন। গাঁধীজিকে তারা নেতৃত্ব দিতে আহ্বান জানালে না করতে পারেননি তিনি। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রাম। প্রতিষ্ঠিত করলেন নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস। এর কিছু দিনের মধ্যেই শ্বেতাঙ্গ সরকারের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা, যারা গিরমিটিয়া নামে পরিচিত ছিল। নাটাল সরকার তাদের দেশ থেকে তাড়াবার উদ্যোগ নিয়ে বছরে পঁচিশ পাউন্ড কর ধার্য করলেন। অন্যথায় দেশত্যাগ করতে হবে। আসল উদ্দেশ্যে বানিজ্যিক ক্ষেত্রে এই গিরমিটিয়ারা ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলেছিল, তার অবসান ঘটানো। গাঁধীর নেতৃত্বে নাটাল কংগ্রেস এই অন্যায় করের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। ফলও মিলল হাতেনাতে। সরকার চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়া গিরমিটিয়াদের উপরে এককালীন করের বোঝা কমিয়ে তিন পাউন্ড ধার্য় করল এবং তাদের বসবাসের অধিকার মেনে নিলেন।

এ দিকে দেখতে দেখতে দক্ষিণ আফ্রিকায় গাঁধীজির তিন বছর কেটে গেল। আইন ব্যবসাও জমে উঠেছে। তিনি বুঝলেন যে ভাবে সে দেশে ভারতীয়দের সমস্যা ও আইন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন, তাতে আরও কিছুকাল তাকে সেখানে কাটাতে হবে। তাই একবার দেশ থেকে ঘুরে আসা .দরকার। আত্মীয়-স্বজন স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ছ’মাসের ছুটি নিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিলেন।

তাঁর জাহাজ এসএস পিঙ্গলা সমুদ্র পেরিয়ে যথন হুগলি নদীতে এসে পড়ল, চারদিকের প্রকৃতি তখন তার সৌন্দর্য মেলে ধরেছে। ভোরের হুগলির দু’কূলের জলছবি দেখে গাঁধীজি মুগ্ধ হলেন, স্বচক্ষে দেখলেন ছোট ছোট দ্বীপে পাখ-পাখালির সমাবেশ। হরেক রকমের পাখিরা সব পরমানন্দে গুগলি-শামুক খুঁটে খাচ্ছে। মনে মনে ভাবলেন, এ যেন ভারতেরই এক প্রতীক। বহু ভাষাভাষীদের একত্র মহামিলন। খিদিরপুর ডকে তার জাহাজ ভিড়ল। গাঁধীজি স্পর্শ করলেন কলকাতাকে। সেই প্রথম দিনটা ছিল ৫ জুন, ১৮৯৬। বাংলা ও বাঙালি তখনও তাঁর কাছে অপরিচিত। সে দিনই রেলযাত্রা করলেন মুম্বাইয়ের পথে। উদ্দেশ্য রাজকোটে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন। যদিও মাস তিনেক পর আমার ফিরলেন এ শহরে।

রাজকোটে বসে মাস খানেকের মধ্যেই একখানা পুস্তিকা লিখে ফেললেন। নাম দিলেন—দ্য গ্রিভ্যান্সেস অব দ্য ব্রিটিশ ইন্ডিয়ানস্ ইন সাউথ আফ্রিকা —দক্ষিণ আফ্রিকায় বারতীয়দের অবস্থা থুড়ি দুরবস্থার চালচিত্র। এর মলাট সবুজ হওয়ায় বইটি পরে গ্রিন প্যামফ্লেট নামে প্রসিদ্ধ হয়। দশ হাজার কপি ছাপা হল। বারতের সমস্ত সংবাদপত্র ও বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে না পাঠালেন। কিন্তু সে সব পুস্তিকা মুড়ে ডাকে ফেলার জন্য তো শ্রমের প্রয়োজন। গাঁধীজির পক্ষে একার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। তাই এ ব্যাপারে সাহায়্যের জন্য পাড়ার ছেলেদের দ্বরস্থ হলেন। তাদের বললেন, ‘‘যে দিন স্কুল না থাকে, সে দিন যদি সকালে দু’ঘণ্টা পুস্তিকা মোড়ার কাজে শ্রম নিয়োগ করে, তবে তিনি তাঁর যা পুরনো ডাকটিকিট সংগ্রহ সব তাদের দেবেন। এতে উৎসাহিত হয়ে ছেলের দল কাজে লেগে পড়ল। খেলাচ্ছলে কাজ উঠেও গেল। ছেলেদের স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরীক্ষায় এ ছিল তাঁর প্রথম পদক্ষেপ। রাজকোটে থাকাকালে গাঁধীজি আরও একটা সিদ্ধান্ত নিলেন—বড় বড় শহরগুলিতে সভা আহ্বান করে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের অবস্থা সম্পর্কে এ দেশে দনমত গঠন করবেন। সেই সূত্রে মুম্বাই, পুণে, মাদ্রাজ হয়ে যখন কলকাতায় এলেন, তখন অক্টোবর মাস, ১৮৯৬ সাল।

শিক্ষক এবং গাঁধী-গবেষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement