গত ২৬ নভেম্বর বামপন্থীদের ডাকা দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘটের দিন সকালের ঘটনা। বাজারে পরিচিত মাছওয়ালা সবেমাত্র মাছগুলো কেটে ব্যাগে ভরার আয়োজন করছেন, এমন সময় তুমুল হল্লা। লাল পতাকা কাঁধে একটা দল ‘দোকান বন্ধ কর, সবাই দোকান বন্ধ কর’ বলে শাসাতে শাসাতে বাজারময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের উদ্যত তর্জনীর সামনে ঝপাঝপ ডালার উপর বস্তা ফেলে দিচ্ছেন সব্জিওয়ালারা। দেখতে দেখতে দলটা এসে পড়ল মাছের দোকানের সামনে। এক জন আমার হাত থেকে মাছভর্তি ব্যাগটা কেড়ে মাছওয়ালার দিকে ছুড়ে বলল, “কেনাকাটি বন্ধ দাদা, বেরিয়ে যান।”
না, বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। প্রতিবাদ অবশ্যই করেছিলাম, কিন্তু সে অন্য গল্প। আপাতত গোটা পৃথিবীর টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে এক ধর্মঘটের সকালের একটা ছোট্ট ঘটনাকে স্থাপন করতে চাইছি। বিগত কয়েক দশকে বিশ্ব-রাজনীতির আঙিনায় স্বৈরতন্ত্রের যে দাপাদাপি দেখা যাচ্ছিল, যাকে পাঁচ বছর আগেও দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিলেন দুনিয়াজোড়া ভোটদাতা— বিভিন্ন নির্বাচনের ফল বলছে, তাকে নিয়ে আজ তাঁরা দ্বিধায় ভুগছেন। যে কোনও রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, তথা কট্টর সমর্থকদের বাইরে যে বিপুলসংখ্যক দলমতবিহীন মানুষ থাকেন, তাঁরাই সচরাচর একটা দেশ বা রাজ্যের শাসকের ভাগ্যনির্ধারক হয়ে থাকেন। এঁরা আজ স্পষ্টতই সংশয়ে। তার প্রকাশ ঘটছে ভোটবাক্সে।
এই সংশয় যে আসলে গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ এবং ভোটারদের ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠার লক্ষণ, সেটা মেনে নিতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ তথা বিশ্লেষকদের অসুবিধা হচ্ছে। মানুষ পথ খুঁজছেন, ভাল-মন্দের তুল্যমূল্য বিচার করছেন, ভুল এবং সংশোধনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছেন— এটাই সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথ। এবং সেই পথের কোনও ‘ইজ়ম’ নেই। মানুষের নিজের ভালমন্দ নিজে বুঝে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে বামপন্থা বা দক্ষিণপন্থার জয় অথবা পরাজয় দিয়ে দেগে দেওয়ার মধ্যে একটা মারাত্মক ভুল আছে। বস্তুত, পৃথিবীর রাজনীতিতে আজ কোনও মতাদর্শ অবশিষ্ট নেই। সেটা এক রকম ভাল। যাবতীয় তত্ত্বের মোড়ক খুলে মানুষ তার ভিতরের দ্রব্যটিকে আস্বাদন করে দেখে নিচ্ছে, তার মধ্যে কতটুকু মিষ্টত্ব আছে। আর মোড়কটির স্থান হচ্ছে আঁস্তাকুড়ে। মনে রাখা ভাল, তত্ত্ব হিসেবে বামপন্থা ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে বিপুল পার্থক্য থাকলেও প্রায়োগিক রাজনীতির প্রশ্নে উভয়ের মধ্যে খুব একটা ইতরবিশেষ নেই।
আমাদের দেশ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পরীক্ষাগার। দীর্ঘ সত্তর বছর পেরিয়ে সে গণতন্ত্র আজ অনেকটাই সাবালক। ভারতীয় গণতন্ত্র ছুটছে তার নিজস্ব ছন্দে, আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাঁদের মতাদর্শের চশমা দিয়ে তাকে মাপছেন আর নানাবিধ তত্ত্ব আওড়ে চলেছেন। ফলে কখনও ইলেকশন মেশিনারি, কখনও রিগিং বা ছাপ্পা, কখনও বা ইভিএম কারচুপি— যখন যার ঘাড়ে সম্ভব, হারজিতের দায় চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছেন। ঠিক যেমন বিহারের সাম্প্রতিক ফলাফল দেখে অনেকেই বামপন্থার উত্থানে উল্লসিত হচ্ছেন। হাস্যকর। পৃথিবীর মতো ভারতের রাজনীতিতেও কোনও পন্থাই আর অবশিষ্ট নেই। জনগণ এখন শুধু নিজের ভালটা বুঝে নেয়। বিজলি-সড়ক-পানির বদলে দেশপ্রেম বা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে বেছে নিলে তার খেসারতও তারা নিজের ঘর থেকেই দেয়।
ফিরে আসি আমাদের রাজ্যে। বন্ধের দিন সকালের ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক না কেন, ক্ষমতা পেলে দাঁত-নখ বার করতে ছাড়ে না কোনও দলই। সেই ব্যাপারে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি, দক্ষিণপন্থী তৃণমূল অথবা বামপন্থী সিপিএম— সবাই সমান। বামপন্থীদের ওই রক্তচক্ষু ছাব্বিশের সকালে অনেকেই দেখেছেন। ক্ষমতায় না থেকেই যাদের এত দাপট, ক্ষমতা পেলে তারা কী করতে পারে তা সহজে অনুমেয়। অনুমান করারই বা দরকার কী? স্মৃতিচারণই তো যথেষ্ট।
দেখেশুনে মনে হয়, বিশুদ্ধ, নির্বিকল্প গণতন্ত্রই বুঝি শেষ ভরসার জায়গা। জনকল্যাণ ছাড়া আর কোনও তত্ত্ব বা আদর্শের প্রয়োজন নেই মানুষের কাছে। পন্থাহীন সেই রাজনীতির তৃতীয় স্বরটিই ইদানীং শোনা যাচ্ছে গণতন্ত্রে। তার মধ্যেও দুর্নীতি, স্বজনপোষণ বা ক্ষমতার রক্তচক্ষু কি নেই? অবশ্যই আছে। এবং জনকল্যাণের পাশাপাশি সেই দুর্নীতিও নির্বাচনী ময়দানে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। উঠছেও। বিহারে নীতীশ কুমারের ভোটে ধস নামার সেটাই কারণ। অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গেও তেমন কিছু হলে মোটেই আশ্চর্য হব না। কিন্তু সেই কারণে একটা বিপুল অংশের ‘ভাসমান ভোট’ যদি সিপি(আই)এম এবং বিজেপির মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, তা হলে সেই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনাকে ‘বামপন্থার জয়’ বলে আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কোনও কারণ আছে বলে তো মনে হয় না।
প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।