ভা রতের অবনতি হইয়াছে। অবনতি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে। একশো আশিটি দেশ লইয়া এক সমীক্ষা চালাইয়াছিল প্যারিস-কেন্দ্রিক রিপোর্টারস সান্স ফ্রন্টিয়েরস। সমীক্ষাতে জানা গিয়াছে, গত বৎসর ভারতের ১৩৩-তম স্থানটি এ বৎসর আরও তিনটি ধাপ নামিয়া দাঁড়াইয়াছে ১৩৬-এ। একশো আশির মধ্যে একশো তেত্রিশ হওয়াই যথেষ্ট অগৌরবের। এই বৎসর দেখাইল, পরিস্থিতি শুধুমাত্র অগৌরবের নহে, বরং উদ্বেগেরও। উদ্বেগের কারণ, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের অভ্যন্তরেই এক চূড়ান্ত অ-গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুষ্ঠু গণতন্ত্রের প্রধান শর্তগুলির অন্যতম। ভারতে তাহা প্রতি নিয়ত লঙ্ঘিত হইতেছে। কেন এমন অবনমন? কারণ দর্শাইয়াছে ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডার’ নামক একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া পর্যবেক্ষক সংস্থা। তাহার রিপোর্টে সে স্পষ্ট বলিয়াছে, ইহার কারণ, নরেন্দ্র মোদীর জাতীয়তাবাদের চোখরাঙানি। সোশ্যাল মিডিয়ায় উগ্র জাতীয়তাবাদীদের অবিরাম কুৎসার শিকার হইতেছেন সাংবাদিকরা। সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে মামলা হইতেছে। উঠিতেছে রাষ্ট্রদ্রোহের প্রসঙ্গও। এখনও পর্যন্ত অবশ্য কোনও সাংবাদিকের উপর রাষ্ট্রদ্রোহের অপবাদ চাপে নাই। রাষ্ট্রের বদান্যতা নহে, তাহার কারণ, ক্রমাগত আক্রমণের মুখে অধিকাংশ সাংবাদিক নিজেরাই এক স্ব-আরোপিত সংযমের রাস্তায় হাঁটিতেছে।
এই প্রবণতা শুধুমাত্র উদ্বেগের নহে, আতংকের। আতংকের, কারণ ইহা এক প্রবল স্বৈরতন্ত্রের উত্থানের দিকে ইঙ্গিত করে। স্বৈরতন্ত্র, আরও স্পষ্ট ভাবে বলিতে গেলে একনায়কতন্ত্রের উত্থানের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হইল সংবাদমাধ্যম-সহ যাবতীয় বিরোধী স্বরের গলা টিপিয়া ধরা। সাম্প্রতিক কালে স্বঘোষিত ‘জাতীয়তাবাদী’দের মিডিয়া-বিদ্বেষ দেখিয়া বোধ হয়, ভারতও সেই দিকেই পা বাড়াইয়াছে। অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করিবার প্রচেষ্টা ভারতে নূতন নহে। ’৭৫ সালে ইন্দিরা গাঁধী-সরকারও ‘মিডিয়া সেন্সরশিপ’-এর রাস্তায় হাঁটিয়াছিল। কিন্তু তখন দেশে ‘ইমারজেন্সি’। ভারতে তো এখন গণতন্ত্র অটুট রহিয়াছে। অন্তত খাতায়-কলমে। কিন্তু এখন অবস্থা জটিলতর। তখন সরাসরি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়াছিল। এখন যাহা চলিতেছে, তাহার সবটাই প্রচ্ছন্ন। বাহিরের গণতান্ত্রিক খোলসটি অটুট রাখিয়া অন্দরের পরিস্থিতিকে এমন ভীতিপ্রদ করিয়া তোলা হইতেছে, যাহাতে ভীত সংবাদমাধ্যম আত্মসংবরণে বাধ্য হন। আইন বা বাহুবল প্রয়োগের প্রয়োজন না হয়। দৃশ্যমান শক্তির তুলনায় অদৃশ্য শক্তি অনেক বেশি ভয়ংকর।
আর প্রমাণ রাখে না বলিয়াই ‘সীমান্তহীন সংবাদিক’-এর মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির এ হেন পর্যবেক্ষণ মূল্যবান। কারণ তাহাতে নেতাদের মুখনিঃসৃত স্বাধীনতার আশ্বাসের অন্তঃসারশূন্যতাটি যথার্থ বুঝা যায়। বস্তুত, অন্দরের সমালোচনার পথটি যখন রুদ্ধ করিবার প্রচেষ্টা চলে, তখন বাহিরই একমাত্র ভরসা। তাই সরকারের প্রকৃত চরিত্র বুঝিতে হইলে, বাহিরের যে কোনও পর্যবেক্ষণ, তাহা যতই ক্ষুদ্র হউক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের আত্মসংবরণের জন্যও, জনগণের চোখের ওপর হইতে সম্মোহনের পরদাটি সরাইবার জন্যও।