সাবঅলটার্নের দোহাই, গালাগালি দেবেন না

ইদানীং কিছু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে শহুরে ভদ্রলোক শ্রেণির একটা অংশ গ্রামীণ বা প্রান্তিক মানুষের ভাষার দোহাই দিয়ে বিশেষ এক রকমের বাংলা ভাষা উচ্চারণ করে বেশ ‘বিপ্লবাত্মক আনন্দ’ পাচ্ছেন। এটা অ-বাস্তব এবং অন্যায়। শহুরে শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা অনেক সময়েই রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দ করেন না, তবে ইদানীং কোনও কোনও নেতার সঙ্গে শহুরে ভদ্রলোক শ্রেণির একটা বিষয়ে বেশ মিল চোখে পড়ছে। ভদ্রলোকেরা সাব-অলটার্নদের ভাষার দোহাই দিয়ে বিশেষ এক রকমের বাংলা ভাষা উচ্চারণ করে বেশ ‘বিপ্লবাত্মক আনন্দ’ পাচ্ছেন। আর নানা দলের রাজনৈতিক নেতারা গ্রামের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ প্রমাণের জন্য প্রায় একই রকম ভঙ্গিতে জিভ শানাচ্ছেন।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

কী ভাষায়। ‘কাঙাল মালসাট’ ছবির একটি দৃশ্য

শহুরে শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা অনেক সময়েই রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দ করেন না, তবে ইদানীং কোনও কোনও নেতার সঙ্গে শহুরে ভদ্রলোক শ্রেণির একটা বিষয়ে বেশ মিল চোখে পড়ছে। ভদ্রলোকেরা সাব-অলটার্নদের ভাষার দোহাই দিয়ে বিশেষ এক রকমের বাংলা ভাষা উচ্চারণ করে বেশ ‘বিপ্লবাত্মক আনন্দ’ পাচ্ছেন। আর নানা দলের রাজনৈতিক নেতারা গ্রামের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ প্রমাণের জন্য প্রায় একই রকম ভঙ্গিতে জিভ শানাচ্ছেন। তাঁদের মতে এই গালাগালাত্মক ও উসকানিমূলক বাংলা ভাষা নাকি চলে আসা ভদ্রলোকি মান্য শিষ্ট ভাষার বিপরীত প্রতিক্রিয়া। যে আপাত-শিষ্ট যুক্তিনিষ্ঠ বাংলা ভাষা সামাজিক স্থিতাবস্থা ও ভদ্রলোকের কায়েমি শ্রেণিস্বার্থ বজায় রাখত, এই ভাষা নাকি তাকে নিকেশ করবে, এতে ভদ্রলোকেরাও অন্তত ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেণিপরিচয়ের কলঙ্কমুক্ত হয়ে ডিক্লাসড ‘নব্য-মানুষ’ হয়ে উঠবেন। হয় হয়ে উঠবেন সাবঅলটার্ন, না-হয় ভাষা-পরিচয়ে গ্রামের মানুষ।

Advertisement

এই ভাষার বৈশিষ্ট্য কী? খেয়াল করে দেখেছি, অবলীলায় শরীরের যৌন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উল্লেখ ও যৌনক্রিয়ার ইঙ্গিত করা এই ভাষার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য। তার সঙ্গে সঙ্গে, কোনও রাখঢাক না করে তীব্র ভাষায় প্রতিপক্ষকে স-শরীর আক্রমণ এই ভাষার আর এক লক্ষণ। কোনও রকম আবডাল থাকে না বলে এ ভাষা খুবই সহজে অন্যের কাছে পৌঁছে যায়, ‘ন্যাকামি’ ও ‘কাব্যবর্জিত’ বলে সহজেই বোঝা যায়। যে কেউ চাইলে এ ভাষা রপ্ত করতে পারেন। আর এ ভাষায় ব্যবহৃত শব্দভাণ্ডারও বিপুল নয়, সুতরাং বাংলা ভাষার এই রূপটি বিগত কয়েক বছরে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। যাঁরা এমনিতে ইংরিজি ছাড়া কথা বলতেন না, সেই শহুরেরাও কেউ কেউ এই স্মার্ট সাবঅলটার্ন ভাষার টানে বাংলায় ফিরেছেন। মুচমুচে এই ভাষা বলে দিব্যি উপভোগ করছেন। আহা! সাবঅলটার্ন আর গ্রামের মানুষের ভাষা বলে চালিয়ে দেওয়া এ বাংলার কী পরম মহিমা! কী উপভোগ্যতা! উপভোক্তার অভাব হচ্ছে না।

একটু চোখকান খোলা রেখে তলিয়ে ভাবলেই অবশ্য এই যুক্তির ফাঁকগুলি চোখে পড়ে। সাবঅলটার্ন, গ্রামের মানুষ ইত্যাদি বলে ভাসা ভাসা ভাবে যে শ্রেণির কথা বলা হচ্ছে তাঁরা কি সদাসর্বদা এই যৌন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গস্পর্শী গালাগালাত্মক ভাষায় কথা বলেন? শরীরে মনে রাগের উত্তুঙ্গ ছিলাটান অস্ত্র হয়ে থাকা ছাড়া তাঁদের কি আর কোনও রূপ নেই? অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলছে। কলকাতার বাইরে থাকি, একটু আধটু গ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। সেখানে মানুষ সব সময় মোটেই এ ভাষায় কথা বলেন না। শুধু ধ্বংসাত্মক রাগ নয়, তাঁদের মনে নানা আবেগের ওঠাপড়া। সুতরাং ‘সাবঅলটার্ন’ বা ‘গ্রামের মানুষ’-এর ভাষার বিশেষ রূপ তৈরি করে তাঁদের নিতান্ত খণ্ডিত, সুতরাং বিকৃত পরিচয় তুলে ধরা হচ্ছে। আর যদি ধরেও নিই তাঁরা রাগ ও প্রতিরোধের সময় এ ভাষাতে কথা বলেন তা হলেও শহুরে বাবু ও নেতাদের মুখে ‘অনুরূপ’ ভাষাকে সমর্থন করা যায় না।

Advertisement

আপত্তির কারণ মূলত দুটি। প্রিয়া সিনেমায় বসে নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখা অবলম্বনে নির্মিত সুমন মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘কাঙাল মালসাট’ দেখছিলাম বছর কয়েক আগে। নবারুণ তাঁর নভেলে ও সুমন তাঁর ছবিতে কলকাতার যে অংশের মানুষদের কথা বলছিলেন, তাঁদের সঙ্গে দামি টিকিট কেটে গাড়ি করে ছবি দেখতে আসা মানুষদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের কোনও মিলই নেই। ছবির ‘কাঙাল’ মানুষেরা তাঁদের রাগ প্রকাশের জন্য ক্রুদ্ধ গালাগালাত্মক শারীরিক ভাষা ব্যবহার করে কায়েমি ভদ্রলোকি সংস্কৃতির শরীরে অন্তর্ঘাতী আক্রমণ চালাচ্ছিলেন, আর তা দেখে শুনে নিরাপদ অবস্থানে থাকা শহুরে বাবুবিবিরা কৌতুকে একে অপরের গায়ে এলিয়ে পড়ছিলেন। নিরাপদ সামাজিক অবস্থানে থেকে অফিসে আড্ডায় এই ভাষা ব্যবহার করে ভদ্রলোকেরা আমোদ পেতে পারেন, তাঁদের অবদমিত কাম চরিতার্থ হতে পারে, কিন্তু আর যাই হোক, এই ভাষা ব্যবহার করছেন বলে তাঁরা বিপ্লবী হয়ে উঠছেন এমন ভাবনা নিতান্ত ভণ্ডামি। এ ভাষা কিছুতেই ‘অনুরূপ’ ভাষা নয়। এতে ওই কাঙাল মানুষেরা ভদ্রলোকের মুখে অপমানিতই হচ্ছেন। ভদ্রলোকেরা কাঙালদের সঙ্গে সামাজিক ভাবে এক না হয়ে, পপকর্ন খেতে খেতে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে সিনেমা দেখা ছাড়া আর কোনও কাজ না করে ‘কাঙালদের ভাষা’ নামক একটি বিশেষ ভাষাভঙ্গিকে ব্যক্তিগত ও দলগত উপভোগের জন্য ভেঙচি কাটছেন মাত্র।

নেতাদের ক্ষেত্রেও একই কথা। গ্রামের মানুষের ভাষার দেশজ গন্ধ তাঁদের বুকনিতে নেই। যেটা আছে, সেটা হল ছেঁকে নেওয়া হিংসার ভাষা। শরীরের বিশেষ অংশে প্রহার করার বা শরীরের বিশেষ অংশ প্রদর্শন করার কথা বলার জন্য শুধু শুধু গ্রামের মানুষের দোহাই দেওয়া কেন? বহু ক্ষেত্রে দেখেছি, সাহিত্যেও পড়েছি, গ্রামের মানুষেরা অনেক সময়েই তাঁদের যুক্তি প্রকাশ করার জন্য স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করেন। আবার লোকায়ত সংস্কৃতির নানা পঙক্তি, উপমা তাঁদের ভাষায় মিশে তাঁদের মুখের বাংলাকে চমৎকার শানিত করে তোলে। রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের দুখে কেওড়ার ও গ্রামের মানুষের বাচনে লেখা গপ্প যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন রামকুমার লোকায়ত ভাষার এই চালটি চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন। রামকুমারের গল্পের সেই গ্রামের মানুষরা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মিডিয়াকে যখন নিজেদের অবস্থা ও অবস্থানের কথা বলেন, তখন তা কখনও একমাত্রিক ভাবে হিংসাত্মক ও গালাগালাত্মক নয়। সেই ভাষা ব্যবহারের মধ্যে তাঁদের আঞ্চলিক সংস্কৃতির ছাপ আছে, আছে মানুষটির মননের ছাপ, কৌতুক ও কৌতূহল। সেই মননে রাগ, অনুরাগ, প্রতিবাদ, নিস্পৃহতা স্বাভাবিক ভাবে মিলে মিশে গেছে। রাজনৈতিক নেতারা, যাঁরা অনেকেই এই গ্রাম ও সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন, তাঁরা চেষ্টা করলেও কিন্তু এই ভাষা বলতে পারবেন না। বরং নিজেদের মনের সাধ মেটানোর জন্য তাঁরা শুধু শুধু কিছু আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার করে বাংলার গ্রামসংস্কৃতির পরিচয়টি গুলিয়ে দেবেন।

এই ভাষা শুধু যে সাবঅলটার্ন ও গ্রামের মানুষদের ভেঙচি কাটছে তাই নয়, এর সম্পর্কে দ্বিতীয় অভিযোগ হল, এই ভাষা অত্যন্ত হিংসাত্মক এবং নারীবিদ্বেষী। এমনিতেই বঙ্গীয় রাজনীতির পরিসর খুবই পুরুষতান্ত্রিক। যে কোনও রাজনৈতিক দলের মহিলা-কর্মী অপর দলের কর্মী ও নেতাদের আক্রমণের সহজ লক্ষ্য। ভাষায় ভঙ্গিতে মহিলাদের অপমান ও আঘাত করতে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের দোসর মেলা ভার। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী যিনি, সেই মুখ্যমন্ত্রীও কিন্তু ‘মহিলা’ হিসেবে কখনও কখনও বিরোধীদের ভাষায় আক্রান্ত। কারও রাজনীতিকে কেউ সমর্থন না করতে পারেন, কিন্তু নারীবিদ্বেষী হিংসার ভাষা ব্যবহার করবেন কেন! আর সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল, এই পুরুষতান্ত্রিক হিংসাত্মক সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাষা এতটাই প্রবল যে অনেক সময় মেয়েরাও মেয়েদের আক্রমণ করার জন্য, কিংবা মহিলা রাজনৈতিক কর্মী নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য এই ভাষা ব্যবহার করছেন!

মনে পড়ে যাচ্ছে অতীত ইতিহাসের বাংলা ভাষা বিতর্কের কথা। দু’একটা উদাহরণ দিই। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা’ লেখাটিতে মনের ভাব সহজে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন মাফিক প্রায় সব রকম শব্দই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, ‘গ্রাম্য’ ‘বুনো’ শব্দকেও বাদ দিতে চাননি। আবার, রাধাকমল মুখোপাধ্যায় এক সময় চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় লোকায়ত ভাষা ব্যবহার করুন। বাংলা ভাষার সীমা বিস্তার করতে চাওয়ার সেই মুহূর্তগুলিতে কিন্তু বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারের কোনও একটি রূপকে ‘মান্য’ করে তুলতে চাওয়া হয়নি। এখন দেখছি সাবঅলটার্ন কিংবা গ্রামের মানুষের দোহাই দিয়ে তাঁদের প্রকৃত বচন ও অবস্থানকে গুলিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষার একটি রূপকেই ক্রমে ক্রমে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের ঢাল-তলোয়ার করে তোলা হচ্ছে। অকাতরে নির্বিচারে অন্তর্জালে নানা নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়ে নিতান্ত তাৎক্ষণিক অভিমুখহীন শারীরিক কৌতুক ও আমোদ তৈরি করছে এই ভাষা।

এই যদি বাঙালির প্রতিবাদ ও বিপ্লবের মুখ্যভাষা হয়, তা হলে তা খুব একটা আশার সঞ্চার করছে না।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement