আগুন কেন লাগে

গড়িয়াহাটের আগুনেই যেমন জানা গেল, পুরসভা ছয় মাস পূর্বেই হকার বিধি প্রস্তুত করিয়াছিল। সেই বিধি লইয়া আলোচনায় বসিবার জন্য এ হেন একটি অগ্নিকাণ্ডের প্রয়োজন ছিল কি না, সেই প্রশ্ন আপাতত বকেয়া থাকুক। যথেচ্ছ হকার যে আগুনের সমস্যাটিকে বহু গুণ জটিল করিয়া তুলিয়াছে, রাজনৈতিক সমাজ এই কথাটি স্বীকার করিতেছে, ইহাই যথেষ্ট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

—ছবি পিটিআই।

আগুনের শিখা নির্বাপিত হইলে দগ্ধাবশেষের পার্শ্বেই পড়িয়া থাকে একটি সত্য— এই আগুনই শেষ নহে। এই শহরের ভবিষ্যতে আরও অনেক আগুন, আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি লুকাইয়া আছে। নন্দরামের পর স্টিফেন কোর্ট, বাগড়ি বাজারের পর গড়িয়াহাট, তাহার পর অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। কিন্তু আগুন সত্য। কেন, সেই কারণ সন্ধান করিলে প্রথমেই চোখে পড়িবে অগ্নিবিধিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিবার প্রবণতাটি। হুকিং, খোলা তার, ক্ষমতার অধিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রবণতা— কলিকাতা আক্ষরিক অর্থেই আগুন লইয়া খেলে। যে বহুতলগুলি আগুনের গ্রাসে পড়িয়াছে, আর যেগুলি এখনও আগুন লইয়া খেলিতেছে, তাহার সব কয়টিতেই বহু মানুষের বাস, বহু ব্যবসার ঠিকানা। তবুও অগ্নিবিধি মান্য করা হয় না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের ভাড়াটিয়া আইনের কথা আসিয়া পড়িবেই। বাড়ির উপর মালিকের অধিকার এমনই খণ্ডিত যে অর্থনীতির ভাষায় এই বাড়িগুলি এখন ‘কমন প্রপার্টি’-র আকার লইয়াছে। যে সম্পত্তি হইতে সকলেই অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হয়, কিন্তু তাহার দেখভালের দায় কাহারও নহে। ভাড়াটিয়া মালিকের অপেক্ষায় থাকেন; আর মালিক জানান, যে সম্পত্তির উপর তাঁহার কার্যত অধিকারই নাই, তাহার দেখভাল করিতেও তিনি অপারগ। এই ফাঁক গলিয়া আগুনের শিখা অগ্রসর হয়। তাহার পর, এক দিন দাউদাউ জ্বলিয়া উঠে। তখন সংবাদ হয়, পুরসভা নড়িয়া বসে, দমকল দফতর অজুহাত খাড়া করে। দিন কতক কাটিলে, পূর্ববৎ।

Advertisement

গড়িয়াহাটের আগুনেই যেমন জানা গেল, পুরসভা ছয় মাস পূর্বেই হকার বিধি প্রস্তুত করিয়াছিল। সেই বিধি লইয়া আলোচনায় বসিবার জন্য এ হেন একটি অগ্নিকাণ্ডের প্রয়োজন ছিল কি না, সেই প্রশ্ন আপাতত বকেয়া থাকুক। যথেচ্ছ হকার যে আগুনের সমস্যাটিকে বহু গুণ জটিল করিয়া তুলিয়াছে, রাজনৈতিক সমাজ এই কথাটি স্বীকার করিতেছে, ইহাই যথেষ্ট। যে হেতু হকারদের অবস্থান আইন-বেআইনের মধ্যবর্তী আলো-আঁধারিতে, অতএব তাঁহারা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণের অতীত। প্লাস্টিক, ত্রিপল ইত্যাদি অতিদাহ্য বস্তু দিয়া তাঁহারা ফুটপাত দখল করিয়া ব্যবসা করেন। অর্থাৎ, আগুন লাগাইবার উপকরণও তাঁহাদের নিকট মজুত, আবার দমকলের পথে বাধা সৃষ্টি করিবার উপকরণও। জানা গেল, গুরুত্বপূর্ণ চৌমাথার পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে কোনও হকার যেন না বসেন; দোকানে ত্রিপল বা প্লাস্টিক যেন ব্যবহার না করেন; কোনও কারণেই যেন ফুটপাতে আগুন না জ্বালান; রাস্তার দুই-তৃতীয়াংশ যেন পথচারীদের জন্য ছাড়া থাকে— এমন সব বাধানিষেধই ২০১৮ সালের নিয়মবিধিতে আছে। এক আগুনে ছয় মাসের দীর্ঘসূত্রতা ঘুচিয়াছে। আরও কয়টি আগুন লাগিলে তবে নিয়মবিধিগুলি মানিতে আরম্ভ করিবে পুরসভা, কলিকাতা উত্তরের অপেক্ষায় থাকিবে।

ভাবিয়া দেখিলে, আগুন আসলে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর ভয়াল প্রকাশ। কোনও বাড়িতে বা বাণিজ্যিক কেন্দ্রে অগ্নিবিধি মানা হইতেছে কি না, তাহা দেখা প্রশাসনের দায়িত্ব। প্রশাসন কার্যত চোখ বুজিয়া থাকে। খোঁজ করিলে উত্তর মিলিবে, কড়া ব্যবস্থা করিতে চাহিলেই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়। হকারের ক্ষেত্রে রাজনীতি আরও প্রকট। উন্নততর জীবিকার সুযোগ থাকিলে কেহ ফুটপাতে হকারি করিতেন না, তাহা অনস্বীকার্য। রাজপথের দখল লইতে তাঁহাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা না করিয়াই উচ্ছেদ করাও খুব মানবিক হইবে না। কিন্তু, এই ভাবে তো চলিতে পারে না। চৌকা ছাতা বা চাকা লাগানো গাড়ি নহে, হকারদের স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করিয়া তাঁহাদের ফুটপাত ছাড়িতে বাধ্য করাই ঠিক সিদ্ধান্ত হইবে। কিন্তু, রাজনীতি তাহা করিতে দিবে কি?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement