ছবি: পিটিআই।
শেষ পর্যন্ত অঙ্কটি কি ত্রৈরাশিকের দাঁড়াইল, না ভগ্নাংশের, বলা কঠিন। তবে সহজ সত্যটি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করিতেছে। অর্থমন্ত্রীর গত পাঁচ দিনব্যাপী ঐতিহাসিক সাংবাদিক বৈঠক আজিকার রাষ্ট্রীয় সঙ্কটের পটভূমিকায় দেশবাসীকে দিশা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কোভিড মোকাবিলায় ভারতবর্ষ যখন কোমর বাঁধিয়া যুদ্ধে নামিয়াছে, তখন অর্থমন্ত্রী যেন অন্য কোনও অভিমুখে চলিতেছেন, অন্য কথা ভাবিতেছেন। দেশজোড়া জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক প্যাকেজের উদ্দেশ্য ও বিধেয়-র মধ্যে এই বিপুলাকার ফাঁকটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এক দিক হইতে, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে দিকে চাকা ঘুরাইলেন, যে সংস্কারের দিকে দেশের অর্থনীতিকে ঠেলা মারিয়া নামাইয়া দিলেন, তাহার গুরুত্ব অস্বীকার করা চলে না। বহু দিন যাবৎ এই সকল সংস্কার প্রতীক্ষিত ছিল। নিশ্চিত ভাবেই ইহা ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের দ্বিতীয় পর্ব। কিন্তু অন্য দিকে, একেবারে একটি গোড়ার প্রশ্ন। সংস্কার যত গুরুতরই হউক, ইহা এখন কেন? এখনই কি ইহার উপযুক্ত সময়? অতিমারিতে যখন অর্ধেকেরও বেশি দেশ ধুঁকিতেছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অর্থাভাবে প্রাণ হারাইতেছে, আর বাকি দেশ অনিশ্চয়তায় গ্রাসে আতঙ্কিত আত্মসমর্পণ করিতেছে, সেই সময়টিকেই সংস্কার-কার্যক্রমের প্রকৃষ্ট মুহূর্ত বলিয়া অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী ঠাহরাইলেন কোন যু্ক্তিতে? ঘরে আগুন লাগিলে আগে আগুন নিবানোর কাজ, না কি ঘর নূতন করিয়া সাজাইবার কাজ? অতিমারি-সম্ভূত দুর্দশাকে সামাল দিবার জন্য আশু যে সব সমাধান জরুরি ছিল, তাহার পরিবর্তে কেন এত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা? নির্মলা সীতারামনের অবদান সত্যই ঐতিহাসিক হইয়া থাকিবে, দেশের অভূতপূর্ব সঙ্কটের সময় এই উদভ্রান্ত (না কি নিষ্করুণ?) সংস্কারযজ্ঞের জন্য।
আর ঐতিহাসিক হইয়া থাকিবে কুড়ি লক্ষ কোটির প্যাকেজের রূপকথা। বহু বিশ্লেষণের পরও অঙ্ক কিছুতেই মিলিতেছে না, দেখা যাইতেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘর হইতে মাত্র দুই লক্ষ কোটি টাকার মতো খরচ হইবে। অর্থাৎ খাতায় কলমে সঙ্কটকালীন খরচ জিডিপির দশ শতাংশ, কিন্তু বাস্তবে তাহা এক শতাংশের মতো! প্রশ্ন করিলে অর্থমন্ত্রী হয় নীরব থাকিয়াছেন, নয় উত্তর দিয়াছেন, সরকার এখন বড়ই চাপের মধ্যে, টাকা উড়াইতে অপারগ! তবে এই সামান্যকে অসামান্য করিয়া ‘ফিসকাল স্টিমুলাস’ বলিবার প্রয়োজন কী ছিল? প্যাকেজের মধ্যে যেখানে মাত্র দশ শতাংশ সরকারি খরচ, সেখানে ‘ত্রাণ প্রকল্প’ বলিয়া ঢাক পিটাইবারই বা দরকার কী ছিল? মানুষের হাতে টাকা আসিল না, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়িল না— অতিমারির মোকাবিলা হইয়া গেল? এই মুহূর্তে দেশবাসীকে বাঁচাইবার জন্য কী চাই, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা সে বিষয়ে বহু প্রস্তাব দিয়াছেন। তাহার কেন্দ্রে ছিল চাহিদাবৃদ্ধির যুক্তি, সাধারণ মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করিবার গুরুত্ব। অথচ গোটা সংস্কারতালিকায় তাহার ছায়ামাত্র পড়িল না।
এই সুবিপুল স্পর্ধা, অতলান্ত অবজ্ঞা ও অলজ্জ অসত্যভাষণ রীতিমতো মূক করিয়া দিবার মতো। সঙ্গে বিষফোঁড়ার মতো হাজির, নরেন্দ্র মোদী সরকারের পরিচিত প্রবণতা— রাজনীতিকরণ। অতিমারির সুযোগকেও নির্লজ্জ ভাবে কাজে লাগাইয়া কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির কলকৌশল। যে পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ হইতে রাজ্যগুলিকে শর্তহীন সহায়তা দানের কথা, সেখানে রাজ্যের মাথার উপরই সব দায়িত্ব চাপানো হইল, ঋণের জন্য এমন শর্ত রাজ্যের উপর বসিল যাহা আইএমএফ-এরও বাড়া। ফলত অনেক রাজ্যের কাছেই এই প্রস্তাব কাগজেকলমেই থাকিবে, ঋণ গ্রহণ অসম্ভব, অবাস্তব হইয়া দাঁড়াইবে। অর্থাৎ, তলাইয়া দেখিলে, সমগ্র নির্মলা-প্রকল্পের মধ্যে রাজনীতির দুন্দুভিটিই সদম্ভে ধ্বনিত হইতেছে— অর্থনীতির সুরক্ষাস্পর্শ দূর অস্ত্।