—ফাইল চিত্র
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানাইয়াছেন, ২০২১-২২ অর্থবর্ষের জন্য তিনি এমন বাজেট পেশ করিবেন, গত এক শতাব্দীতে ভারত যাহার সমতুল কিছু দেখে নাই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের তরফে এমন ‘যুগান্তকারী’ কোনও ঘোষণার কথা বলা হইলেই অনেকের বুক দুরদুর করিতে থাকে। অভিজ্ঞতা বড় বালাই। অর্থমন্ত্রী তাঁহার বৈপ্লবিক ভাবনার কথাটি প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় একটু বেশি খোলসা করিয়াছেন, তাহাই ভরসা। তিনি জানাইয়াছেন, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ যদি বাড়িয়াও যায়, সরকার তাহার পরোয়া করিবে না— ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াইবে। আর্থিক মন্দা হইতে উদ্ধারের আর কোনও পথ নাই। কথাটি তাঁহারা বুঝিলেন বটে, কিন্তু বড় বিলম্বে। দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রীরা যখন বারংবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, কেন্সীয় দাওয়াই ব্যতীত নিস্তারের পথ নাই, তাঁহারা তখনও ভরসা রাখিয়াছিলেন সুলভ ঋণের মাধ্যমে বাজারে জোগান বাড়াইবার অর্থনৈতিক মন্ত্রে। দৃশ্যত তাহা কাজে আসে নাই— বিশ্বের বৃহৎ অর্থব্যবস্থাগুলির মধ্যে ভারতের অবস্থাই করুণতম। এই অবস্থায় রাজকোষ ঘাটতির কথা ভুলিয়া সরকার যদি সত্যই ব্যয়বৃদ্ধির পথে হাঁটে— শুষ্ক প্রতিশ্রুতি বা হিসাবের চাতুরি নহে, প্রকৃত ব্যয়বৃদ্ধি— তাহাতে অর্থব্যবস্থার ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধার হইবার সম্ভাবনা। বিশেষত, লকডাউনের নয় মাসে ভারতে আর্থিক অসাম্যের পরিমাণ আরও বাড়িয়াছে। এই ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় যদি সম্পদের ন্যায্যতর পুনর্বণ্টনের কথা খেয়াল রাখে, তবে যে শুধু বণ্টনের ন্যায্যতা বাড়িবে, তাহাই নহে— মানুষের ক্রয়ক্ষমতারও বিস্তার হইবে। শেষ অবধি, অর্থব্যবস্থার লাভ।
তাহাতে রাজকোষ ঘাটতির সমস্যাটিও দীর্ঘমেয়াদে মিটিবে। সরকারের মোট ব্যয় হইতে মোট আয়কে বাদ দিলে যাহা পড়িয়া থাকে, তাহাই রাজকোষ ঘাটতি। এই সংখ্যাটির প্রকৃত গুরুত্ব মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র সহিত তাহার অনুপাতে। অর্থাৎ, ঘাটতির পরিমাণ বাড়াইয়াও যদি জিডিপি পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হয়, ঘাটতি বৃদ্ধিতে ক্ষতি নাই। ভারত বর্তমান যে অবস্থায় দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে ভোগব্যয়ের পরিমাণ স্বাভাবিক ভাবে বাড়িবে না; বাজারে যদি চাহিদা না থাকে, তবে বিনিয়োগও বাড়িবে না। অর্থাৎ, জিডিপি-র বৃদ্ধি নির্ভর করিতেছে সরকারি ব্যয়ের উপর। এবং, সেই ব্যয় যদি দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের হাতে আয় হিসাবে পৌঁছায়, তবে ভোগব্যয়ও বাড়িবে বলিয়াই আশা করা চলে। অর্থব্যবস্থার চাকাটি গড়াইতে আরম্ভ করিলে জিডিপি বাড়িবে; বাজারে চাহিদা ফিরিলে কররাজস্ব বাবদ আদায়ের পরিমাণও বাড়িবে। এক দিকে সরকারি আয় বাড়িবে, অন্য দিকে জিডিপি-র পরিমাণও বাড়িবে— অর্থাৎ, জিডিপি-র অনুপাত হিসাবে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ উভয় দিক হইতেই সঙ্কুচিত হইবে। আশা করা চলে, নির্মলা সীতারামনরা রাজকোষ ঘাটতির এই চলমান চরিত্রটির কথা মাথায় রাখিয়াছেন। কেন্সীয় দাওয়াই মানিতে ইতিমধ্যেই সরকার বহু বিলম্ব করিয়াছে, অর্থব্যবস্থা তাহার ফলও ভোগ করিতেছে। রাজকোষ ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার গুরুত্ব ভুলিবার প্রশ্ন নাই। কিন্তু, আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে সরকার যদি সামনের বাজেটে সত্যই ঘাটতির ভাবনা ভুলিয়া খরচ করে, তবে অর্থব্যবস্থার উপকার হইবে।