ত্রৈলোক্যনাথের এই বাড়িতেই অরবিন্দ বৈঠক করেন। ছবি লেখকের সৌজন্যে
সাধারণ মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না জেলা কংগ্রেস কমিটি নিয়ে। কারণ কমিটিতে আইনজীবীদের প্রাধান্য। খোলনলচে বদলাতে চাইলেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। নতুনদের অন্তর্ভুক্ত করতে সভা ডাকলেন। বাদানুবাদে সভা স্থগিত হয়ে গেল। অরবিন্দ ঘোষ বীরেন শাসমলদের এড়িয়ে গোপন বৈঠক করলেন।
পরপর কিছু ঘটনার ফল এমন বাদানুবাদ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগে পর্যন্ত ছিল জেলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রভাবিত। মডারেট নেতা যোগেন্দ্রচন্দ্র রায়, কার্তিকচন্দ্র মিত্র, বিপিনবিহারী দত্তের প্রচেষ্টায় মেদিনীপুরে ১৯০১ সালে প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। তখন থেকেই জাতীয় রাজনীতির মূল ধারায় মেদিনীপুর যুক্ত হয়। ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত। মেদিনীপুরে এর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসু।
রাজনারায়ণ বসুর ভাইপো জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু মেদিনীপুরে গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন। তাঁকে সাহায্য করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও হেমচন্দ্র দাস কানুনগো। ১৯০৩ সালে জ্ঞানেন্দ্রনাথের আত্মীয় অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় গুপ্ত সমিতি জোরদার করতে আসেন। ১৯০৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও ভগিনী নিবেদিতা মেদিনীপুরে মিঞাবাজারে প্রাক্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদেরের বাড়িতে ভগিনী নিবেদিতা মেদিনীপুরের প্রথম আখড়ার উদ্বোধন করেন। ১৯০৩ সালে তমলুকে সুরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের বাড়িতে গড়ে উঠল ‘মাতৃসদন’। যার মধ্যমণি ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। মেদিনীপুরের মীরবাজারে ‘বসন্ত মালতি’, বড়বাজারে ‘সন্তান সমিতি’, পাহাড়িপুরে ‘স্বদেশ সমিতি’, চিড়িমারসাইতে ‘শক্তি সমিতি’, অলিগঞ্জ, কাঁথি, মুগবেড়িয়ায় বহু আখড়া গড়ে ওঠে।
লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণায় মেদিনীপুর বিক্ষোভে উত্তাল হয়। ১৬ অক্টোবর জেলায় ‘অশৌচ দিবস’ পালন করা হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর কলেজ মাঠে প্রায় দশ হাজার লোকের বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তৃতা করেন ক্ষীরোদ দত্ত, ত্রৈলোক্যনাথ পাল, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দেবদাস করণ। চন্দ্রকোনার মহারাজা রামানুজ দাসের সভাপতিত্বে ১ নভেম্বর সোয়ান্স কম্পাউন্ডে পরবর্তী সমাবেশে বিলেতি দ্রব্য বর্জন করে স্বদেশি বস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। বস্ত্র তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ক্ষুদিরামকে আনন্দপুরে পাঠানো হয়। তিনি ফিরলে মেদিনীপুরের অলিগঞ্জে তাঁতশাল চালু হয়। দেশীয় দ্রব্যের জন্য বড়বাজারে চালু হল ‘ছাত্রভাণ্ডার’।
নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খান, মুগবেড়িয়ার জমিদার দিগম্বর নন্দের মতো বহু জমিদার চরমপন্থী আন্দোলনে যোগ দেন। জেলাশাসক ডি ওয়েস্টনের সভাপতিত্বে ১৯০৬ সালে মেদিনীপুর কলেজ মাঠে দ্বিতীয় বর্ষ কৃষি-শিল্প প্রদর্শনীতে ব্রিটিশ বিরোধী ও উত্তেজনামূলক প্রচার পত্রিকা ‘বন্দেমাতরম’ ছড়াতে গিয়ে গ্রেফতার হন ক্ষুদিরাম বসু। ১৯০৭ সালে কৃষি-শিল্প প্রদর্শনীর সভাপতি জেলাশাসক ওয়েস্টন ও সম্পাদক ত্রৈলোক্যনাথ পাল। স্বেচ্ছাসেবকরা ‘বন্দেমাতরম’ ব্যাজ পরে বন্দেমাতরম স্লোগানের দাবি তোলেন। জেলা জজ ডারবাল তা মেনে নিলেও জেলাশাসক রাজি হলেন না। প্রদর্শনী বয়কট করলেন ছাত্ররা। ‘মেদিনীবান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক দেবদাস করণ বয়কটের সংবাদ প্রচার করে প্রকাশ্য আন্দোলনের মুখপাত্র হলেন। রাধানাথ দে নামে এক দোকানদার বিলিতি দ্রব্য বিক্রি করায় বিপ্লবীরা ৪ নভেম্বর তাঁর দোকান জ্বালিয়ে দেন। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজার স্ত্রী-পুত্রসহ ৬ ডিসেম্বর ট্রেনে কলকাতায় ফিরছিলেন। নারায়ণগড়ে স্টেশনে বোমাবর্ষণ হয়।
পরদিন আরও বড় ‘বিস্ফোরণ’ মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেস সম্মেলনে। এতদিন জেলা কংগ্রেস কমিটিতে প্রধানত আইনজীবীদের প্রাধান্য ছিল। তাতে জনতার কোনও আগ্রহ ছিল না। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কমিটি পুনর্গঠন করতে ২১ এপ্রিল ‘বেলী হল’এ (বর্তমানে ঋষি রাজনারায়ণ বসু পাঠাগার) সভা করলেন। আইনজীবীদের দাবি মতো, দেবদাস করণকে জেলা কমিটি থেকে না সরানোয় বাদানুবাদ হয়। সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। হাল ধরেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মেদিনীপুরে এসে দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যারিস্টার ক্ষীরোদবিহারী দত্তের সভাপতিত্বে ৭ ও ৮ ডিসেম্বর জেলা কংগ্রেসের অধিবেশনের দিন ঘোষণা করেন। তার আগে অরবিন্দ ঘোষ-সহ কয়েকজনকে নিয়ে মেদিনীপুরে নিজের বাড়িতে বৈঠক করেন ত্রৈলোক্যনাথ পাল। খবর পেয়ে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, কৃষ্ণকুমার মিত্র, যোগেন্দ্রনাথ সেন, ক্ষীরোদবিহারী দত্ত অরবিন্দের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। ১৫০ জন প্রতিনিধি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত শর্ত জানান, সম্মেলনের সভাপতিকে খদ্দরের ধুতি পরে সভায় বাংলায় ভাষণ দিতে হবে। তাঁকে স্বরাজ ও বয়কট বিষয়ে বলতে হবে। সভাপতি তাতে গররাজি। সভায় লাঠি নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। মীরবাজারে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনায় বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে অধিবেশন স্থলে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার।
কলকাতার হেমচন্দ্র সেন অধিবেশন উদ্বোধন করেন। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি রঘুনাথ দাসের ইংরেজি ভাষণের বাংলা তর্জমার পর কেচকাপুরের বিহারীলাল সিংহ অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে ক্ষীরোদবিহারী দত্তের নাম প্রস্তাব করেন। সমর্থন করেন তমলুকের যোগেন্দ্রনাথ সিংহ। নরমপন্থী সভাপতি ক্ষীরোদবিহারী দত্ত সাহেবদের মতো পোশাক পরে লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করতে থাকেন। তিনি স্বরাজ নিয়েও বলতে চাননি। তাই কালিদাস মহাপাত্র-সহ কয়েকজন প্রতিনিধি সভাপতি হিসেবে ক্ষীরোদবিহারী দত্তকে মান্য করা যাবে না বলতেই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। হট্টগোলের মধ্যেই মেদিনীপুর থেকে ১৫ জন, দাঁতনের ২ জন, গড়বেতা ৩ জন, তমলুক, কাঁথি ও ঘাটাল থেকে ১০ জন করে নিয়ে নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করা হয়। নরমপন্থীদের পক্ষে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও চরমপন্থীদের পক্ষে অরবিন্দ ঘোষের মধ্যে বিবাদ চরমে পৌঁছালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এক প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অধিবেশন ভন্ডুল করে দেন। চরমপন্থীরা সভা কক্ষ ত্যাগ করে চলে যান। সন্ধ্যায় তাঁরা ত্রৈলোক্যনাথ পালের বাড়িতে গোপন সভা করেন। ৮ ডিসেম্বর ‘বেলী হলে’ সাবজেক্ট কমিটির সভায় স্বরাজ ও বিদেশি দ্রব্য বয়কটের সিদ্ধান্ত হয়। সেই দিন সকালে ও সন্ধ্যায় চরমপন্থীরা বল্লভপুর মাঠে সভা করেন।
নরেন্দ্রনাথ দাস তাঁর ‘হিস্ট্রি অব মিডনাপুর’এ এবং কৃষ্ণকুমার মিত্র তাঁর আত্মজীবনীতে মেদিনীপুর অধিবেশনের উল্লেখ করেছেন। এই অধিবেশনে তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘বৈধ উপায়ে দেশের কল্যাণ করা সম্ভব, না অবৈধ উপায়ে করা সম্ভব? এক যুবক জবাব দিলেন, ‘রাজদ্রোহী দ্বারা সম্ভব’। কৃষ্ণকুমার মিত্র উল্লেখ করেছেন, ‘তখন সভায় পরিষ্কার বোঝা গেল বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে দুই দলের আবির্ভাব ঘটেছে, একদল ধীরপন্থী, অপর দল উগ্রপন্থী’।
লেখক প্রাবন্ধিক