corona virus

যে ঘুম ভাঙবে না কখনও কিংবা যাঁরা ঘুমোননি

আপনারা কত সুখে ছিলেন, তা কি ‘নেশন’ জানে? আপনাদের জীবন তো নিশ্চিত ছিল! ছিল পকেটভর্তি টাকাপয়সাও! তারপরও তিন বেলা ভরপেট খেয়ে কে যে বলেছিল আপনাদের রেললাইন দিয়ে নৈশভ্রমণ করতে? আপনাদের কি এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান নেই?

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ০১:০৯
Share:

এই ঘুমই চেয়েছিলেন বুঝি!

Advertisement

এই ঘুম?

যে ঘুমে শোনা যায় না রেলের ভোঁ, যে ঘুম ভাঙে না জোরালো আলোয়, যে ঘুমে স্বপ্ন নয়, লেপ্টে থাকে বাড়ি ফেরার তাগিদ, সেই ঘুমই তো আপনাদের কাল হল!
নাকি মরেও বেঁচে গেলেন?

Advertisement

ষোলো জন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত শ্রমিকের উপর দিয়ে চলে গেল একটা খালি মালগাড়ি। আড়মোড়া ভেঙে সূর্য তখনও ধাতস্থ হয়নি। ইঞ্জিনের গর্জন আর চাকার ঘড়ঘড়ানিতে ঢাকা পড়ে গেল গোঙানি, কান্না, হাহাকার। জীবন ও মৃত্যুর মতো সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলা রেললাইনের পাথরের উপরে পড়ে রইল রুটির টুকরো, ছেঁড়া চটি, গামছা, দাঁতন, সস্তার মাস্ক আর ছিন্নভিন্ন দেহ...

সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, মহারাষ্ট্রের অওরাঙ্গবাদের জলনা থেকে ২০ জন শ্রমিক বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। চড়া রোদে কষ্ট হবে বলে যাত্রা শুরু করেছিলেন সন্ধ্যায়। হাঁটা শুরু হয়েছিল বাসরাস্তা ধরে। কিন্তু নাকা-ঝামেলা এড়াতে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন রেললাইন। টানা চল্লিশ কিলোমিটার হাঁটার পরে শরীর আর চলছিল না।

হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল বলে এক শ্রমিক পিছিয়ে পড়েছিলেন। ১৬ জন শুয়ে পড়েছিলেন বদনাপুর ও কারমাডের মাঝামাঝি এলাকার রেললাইনেই। আর তিন জন ছিলেন রেললাইন থেকে একটু দূরে। চোখের পাতা যখন লেগে আসছিল, তখনও সকলেই ভেবেছিলেন, ট্রেন তো বন্ধ। কিন্তু মালগাড়ি যে চলছে সে কথা ঘূণাক্ষরে কারও মাথায় আসেনি।

কাকভোরে মালগাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেলেন ১৬ জন। বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছেন ফোস্কা পায়ে পিছিয়ে পড়া ও রেললাইনের পাশে শুয়ে পড়া মোট চার শ্রমিক। দেহগুলির ময়নাতদন্তের আগেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে। এক দল প্রতিবাদে গর্জে উঠল। আর এক দল প্রশ্ন তুলে দিল, রেললাইনে ও ভাবে শুয়ে পড়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। রেললাইন কি ঘুমোনোর জায়গা?

সত্যিই তো, রেললাইন কি ঘুমোনোর জায়গা?

আপনাদের কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই?

আপনারা যে কত সুখে ছিলেন তা কি ‘নেশন’ জানে? নিশ্চিন্ত জীবনে, পকেটভর্তি টাকা-পয়সা নিয়ে, তিন বেলা ভরপেট খেয়ে কে বলেছিল আপনাদের নৈশ-ভ্রমণ করতে? সে-ও না হয় করলেন, তার পরে পোড়া রুটি, চাটনি দিয়ে জমিয়ে ‘ডিনার’ সেরে কেন রেললাইনটাকেই তুলতুলে বিছানা-বালিশ ভেবে বসলেন?

ও ভাবে বেআক্কেলের মতো আপনারা ঘুমিয়ে পড়লেন বলেই তো সাতসকালেই ব্যস্ত হয়ে উঠতে হল আমার ধীর-স্থির-নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা রাষ্ট্রকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলতে হল, ‘‘(আমি) প্রচণ্ড মর্মাহত।’’ টুইট করলেন অমিত শাহ, ‘‘দুঃখ প্রকাশের ভাষা নেই।’’ রেলমন্ত্রীও জানিয়ে দিলেন, এ বার থেকে রেললাইনে হাঁটবেন না। মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশ সরকারের তরফে আপনাদের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের ঘোষণাও করা হল!

যাক গে, টাকার অঙ্কটা এক বার হিসেব করে দেখেছেন? জীবনভর ‘লেবার’ খেটে পারতেন ওই টাকা জমাতে? এই অকালে আপনি, আপনারা নেই তো কী হয়েছে, আপনাদের পরিবারগুলোর তো একটা হিল্লে হল! ওই টাকায় আপনার পরিবারের লোকজন চাল, ডাল, আটা, নুন, তেল, মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার সব কিনতে পারবেন। চাইলে একটা পাকা ঘরও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
এটা কি কম প্রাপ্তি!

আমার দেশ মহান। বড় ভাল। বড় দয়ালু। কিন্তু আপনাদের কে বোঝাবে? রেলমমন্ত্রীর নিষেধ উপেক্ষা করেই (কেন যে আপনারা নিয়মিত টুইট ফলো করেন না, দেশের খবরাখবর রাখেন না, কে জানে!) ফের আপনারা প্রায় ৫১ জন বীরভূম এলাকায় রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করলেন! ভাগ্যিস, চালক বুঝতে পেরেছিলেন! না হলে তো আপনারাও আবার দেশকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন।

এমনিতেই তো আপনাদের ডান-বাম জ্ঞান নেই। সড়কপথে প্রায় নিত্যদিনই দুর্ঘটনা ডেকে আনছেন (ইতিমধ্যে একটি রাজনৈতিক দল দাবি করেছে, ৮ মে পর্যন্ত ৪২ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার মধ্যপ্রদেশের গুনা এবং উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরাবাদে দু’টি পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও ১৪ জন ঘরমুখো শ্রমিক। এ পর্যন্ত মৃতের মোট সংখ্যা যে আরও বেশি তা বলাই বাহুল্য।)। রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়ে বিব্রত করছেন রাষ্ট্রকে।

এ দিকে রাষ্ট্র দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে (আপনারা আর কী এমন পরিশ্রম করেন!) দেশবাসীর জন্য ভেবে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্র কত টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, জানেন? নাকি সেটাও বলে দিতে হবে! কুড়ি লক্ষ কোটি টাকা (আজ্ঞে হ্যাঁ, ছাপার ভুল-টুল নয়, ঠিকই পড়ছেন বা শুনছেন!)। কুড়ির পরে কতগুলো শূন্য বসবে সেটা ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকুন। হাঁটতে থাকুন যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ। ছোট্ট শিশুটি খিদের জ্বালায় হাঁটতে না পারলে কাঁধে তুলে নিয়ে তাকেও শোনান দেশের গল্প। দেশ-প্রেমের গল্প। সব কথা হয়তো সে বুঝবে না। বোঝার কথাও নয়। তবুও আপনি বলে চলুন, এই বিপদের দিনে সরকার কত কী করে যাচ্ছে! দেশের ভাল হলে আপনাদেরও একটা হিল্লে হতে পারে।

খোদ প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভর ও আত্মনির্ভরতার কথা বলেছেন বার বার। সে কথা আপনারা বুঝতে চাইছেন না। তথাকথিত নিন্দুকদের মতো আপনাদেরও এটাকে রাজকীয় রসিকতা বলে মনে হচ্ছে? হোক। এই সময় একমাত্র রাজাই রসিকতা করতে পারেন, বুঝেছেন? আপনি বরং আত্মনির্ভর হয়ে উঠুন। না পারলে আত্মনির্ভরতার পাঠ নিন।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement