মানবেন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী এভেলিন ট্রেন্ট। নন্দন পত্রিকার সৌজন্যে।
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ চলতি বছর। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে গঠিত হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। তাসখন্দে পার্টির প্রতিষ্ঠার পুরোধা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। এই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বটির সঙ্গে মেদিনীপুরের যোগ রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর খেপুত গ্রামে রয়েছে তাঁর পৈতৃক ভিটে।
অবশ্য মানবেন্দ্রনাথেরা মেদিনীপুরের আদি বাসিন্দা নন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা হুগলির বাসিন্দা ছিলেন। হুগলির সোনাটাকরি গ্রামে থাকতেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। কথিত, দেবী ক্ষিপ্তেশ্বরীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে হুগলি থেকে বংশের প্রথম পুরুষ রমাকান্ত খেপুতে চলে আসেন। সেবায়েত হিসেবে বর্ধমান রাজার বেশ কিছু সম্পত্তিও পেয়েছিলেন। সেবায়েতরা স্থানীয় ভাবে অধিকারী নামে পরিচিত। ইতিহাস বলছে, মানবেন্দ্রনাথের বাবা দীনবন্ধু ভট্টাচার্যের জন্মস্থান খেপুত উত্তরবাড় গ্রামে। তবে একসময় তিনি পূজারির পৈতৃক বৃত্তি ছেড়ে উত্তর ২৪ পরগনায় চলে যান। সেখানকার আড়বেলিয়া গ্রামের বিদ্যালয়ের হেড পণ্ডিতের চাকরি নেন। ১৮৮৯ সালে মার্চে ওখানেই জন্ম হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির পুরোধার। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানেই।
১৯১৫ সালে জার্মানি যাওয়ার জন্য ভারত ছেড়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। তখন তাঁর বয়স ২৬ বছর। জার্মানি যাওয়ার উদ্দেশ্য, এক সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠীর জন্য অস্ত্র জোগাড় করা। ওই দলের সদস্য ছিলেন তিনি। পরের বছর আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো হয়ে পৌঁছন নিউইয়র্কে। দেখা হয় প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায়ের সঙ্গে। জার্মানি থেকে অস্ত্র পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ফলে মানবেন্দ্রনাথ ১৯১৭ সালের নভেম্বরে মেক্সিকো চলে যান। মেক্সিকোর সমাজবাদীদের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। মেক্সিকোতেই পরিচয় হয় লেনিনের দূত মিখাইল বরোদিনের সঙ্গে। মেক্সিকোর সোশ্যালিস্ট পার্টিতে তাঁর প্রভাব বাড়ে। এক বছরের মধ্যেই তিনি মেক্সিকান সোশ্যালিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাশিয়ার বাইরে মেক্সিকান সোশ্যালিস্ট পার্টিই প্রথম নিজেদের কমিউনিস্ট হিসেবে ঘোষণা করে। মেক্সিকো থেকেই তিনি সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়েছিলেন।
১৯১৬ সালে ক্যালিফর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এভেলিন লিওনোরা ট্রেন্টের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তথা মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে। সেই সময়ে নরেন্দ্রনাথ রেভারেন্ট সি এ মার্টিন ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। সেখানে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয় আরেকজনের। ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। তিনি বিপ্লবী যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ভাই। পরবর্তী কালে ধনগোপাল লেখক হিসেবে বিখ্যাত হবেন। ধনগোপালের পরামর্শেই তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় নাম নেন। পরে সংক্ষেপে এম এন রায়। এভেলিনের সঙ্গেই পরে বিয়ে হয় মানবেন্দ্রনাথের।
১৯৩৯ সালে এম এন রায় পত্নী এভেলিনকে নিয়ে খেপুত গ্রামে এসেছিলেন। কোলাঘাট থেকে রূপনারায়ণ নদ দিয়ে ঘাটালগামী স্টিমারে চড়ে পিতৃভূমি খেপুত গ্রামে পৌঁছেছিলেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে পিঁড়িতে বসে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন। তাঁর আত্মীয়গোষ্ঠী অধিকারী (ভট্টাচার্য) পরিবার সাদর অভ্যর্থনা করেছিলেন তাঁকে। সন্ধ্যায় সোনাখালিতে বৈঠক করে অখিলচন্দ্র সামন্তের বাড়িতে রাত কাটান। পরদিন বাড়ির সকলের সঙ্গে দেখা করে কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন। এম এন রায়ের আদিবাড়িতে গিয়ে কথা হল, তাঁর বংশের উত্তর পুরুষ অজয়,অরুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। অজয়ের কথায়, “। উনি যে কতবড় তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন অনেকেই জানেন না। আমরা চাই তাঁর স্মরণে কিছু হোক।” এখনও খেপুতে এম এন রায়ের বংশের পাঁচ-ছ’টি পরিবার রয়েছে। চাষবাস ও পুজোর আয়ে তাঁদের সংসার চলে। তবে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে কেউ যুক্ত নন। এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা এম এন রায়ের নামটুকু শুনেছেন। আর কিছু জানেন না।
ইতিহাসে একটি বিতর্ক রয়েছে। তবে সেটা স্থানীয় ভাবে। পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় তাঁর ‘ঘাটালের কথা’ বইয়ে দাবি করেছেন, মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অবিভক্ত মেদিনীপুরের দাসপুর থানার খেপুত (উনি লিখেছিলেন ক্ষেপুত) গ্রামে জন্ম। তাঁর দাবি অনুযায়ী, সালটা ১৮৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি। ক্ষেপুতের বিখ্যাত ক্ষেপুতেশ্বরীর পুরোহিত ভৈরবচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছেলে পণ্ডিত দীনবন্ধু ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় স্ত্রীর দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ। দীনবন্ধু পরে চব্বিশ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে চলে যান। ওই গ্রামেই তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল। ২৪ পরগনার আড়িখালি স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক ছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ ওই স্কুল থেকেই ১৯০৫-০৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯০৬ সালে শ্রীঅরবিন্দের জাতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের দলে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
পঞ্চানন রায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ভারত পথিক’ গ্রন্থে মানবেন্দ্রনাথের জন্মস্থান নিয়ে তথ্য অস্বীকার করেছেন। তিনি নেতাজির গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতিও দিয়েছেন, ‘কোদালিয়া, চিংড়িপোতা, হরিনাভি, মালঞ্চ, রাজপুর ইত্যাদি গ্রামগুলি আবার কর্মকোলাহলমুখর হয়ে ওঠে।...বিশ্ববিখ্যাত কমরেড এম এন রায় এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন’। কিন্তু পঞ্চানন রায়ের দাবি, ‘কোদালিয়ায় তাঁহার (মানবেন্দ্রনাথ রায়) মাতুলালয়ে তিনি বাল্যকালে ছিলেন সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁহার জন্মস্থান ছিল ক্ষেপুতগ্রামে’।
জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে খেপুতের সঙ্গে এম এন রায়ের যোগ তাতে ক্ষুণ্ণ বা বৃদ্ধি হয় না। কিন্তু খেপুত কি তাঁকে মনে রেখেছে? কয়েক বছর আগে এলাকার হইচই ক্লাবের কয়েকজনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল স্মৃতিস্তম্ভ। সেই বেদিও পড়ে রয়েছে অনাদরে। ক্ষয়াটে ফলকে চেষ্টা করে নাম, পরিচয় এবং জন্ম-মৃত্যুর সাল পড়া যায়। স্মৃতিস্তম্ভের কাছেই রয়েছে তাঁর পৈতৃক ভিটে। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, এক সময় তিনি ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পিপিলস পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মূল ধারা থেকে সরে যাওয়ায় তাঁর স্মৃতি কি গ্রামে ঝাপসা হতে শুরু করে? ‘বাধ্যবাধকতা’ রয়েছে বলে প্রশ্ন এড়ান কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতৃত্ব। মহকুমাশাসক অসীম পাল বলেন, “এম এন রায়ের ঘাটালের সঙ্গে যোগাযোগ জানা ছিল না।”
দেশ জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ পালনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরের এম এন রায়ের স্মৃতি বিজড়িত দাসপুরের খেপুত রয়ে গিয়েছে আড়ালেই।
তথ্যসূত্র: নন্দন, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ‘ঘাটালের কথা’-
পঞ্চানন রায়।