চলেছে টয় ট্রেন। ফাইল ছবি
শীতের সন্ধ্যা। তিনধারিয়া ‘টি প্লান্টার্স ক্লাব’-এ পার্টিতে যোগ দিতে এসেছেন ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে’-এর এজেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন প্রেস্টিজ। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। ফায়ার প্লেসকে ঘিরে সবাই নাচে মেতে উঠলেন। কিন্তু প্রেস্টিজ সাহেবের নাচে মন নেই। তিনি ভাবছেন, কী ভাবে দার্জিলিং পাহাড়ে রেলপথ বসানো যায়। স্ত্রীর সঙ্গে নাচে পা মিলছিল না। সকলের সামনে লজ্জায় পড়ে গেলেন শ্রীমতী প্রেস্টিজ। বলরুমের এক কোণায় স্বামীকে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘‘খোলা মনে যদি এগিয়ে আসতে না পার, তবে এখান থেকে ফিরে যাচ্ছ না কেন?’’ ব্যস! প্রেস্টিজ পেয়ে গেলেন তাঁর সমস্যার সমাধান। খাড়া পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার উপযোগী আগু-পিছু করে চলার বিশেষ ধরনের পদ্ধতি ‘জেড রিভার্সিং’, কঠিন চড়াইকে সহজ করতে ইংরেজি জেড অক্ষরের মতো রেললাইন পাতার জিগজ্যাগ পদ্ধতি।
সাধারণত, পাহাড়ি পথে চড়াই-উতরাই কমানোর জন্য সুড়ঙ্গ গড়া হয়। দার্জিলিং পাহাড়ে কিন্তু একটিও সুড়ঙ্গ নেই। লুপ আর জেড রিভার্সিং ব্যবহার করে সরীসৃপের মতো উঠেছে এই রেলপথ। এ পথে প্রথম দিকে পাঁচটি লুপ ছিল। বিখ্যাত ‘বাতাসিয়া লুপ’ তখন ছিল না। ট্রেনের চড়াইকে সহজ করতে ১৯১৯ সালে তা তৈরি হয়। প্রথম দিকে শিলিগুড়ি টাউন থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত ছিল মোট ২৫টি স্টেশন। গাড়ি ইঞ্জিন বদল করত তিনধারিয়া আর কার্সিয়াং স্টেশনে। শিলিগুড়ি থেকে সুকনা পর্যন্ত টয় ট্রেন প্রতি ২৮১ ফুট অগ্রসর হলে এক ফুট এবং সুকনা থেকে ঘুম প্রতি ৩০ ফুটে এক ফুট উচ্চতা চড়ত। প্রথম দিকে ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় সাত মাইল। পরে বেড়ে হয় ঘণ্টায় দশ মাইল।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার সময় কমাতে ফ্যাঙ্কলিনই তৎকালীন বাংলার গভর্নর স্যার এসলে ইডেনের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি ইডেন সাহেবের মনে ধরে। তিনি একটি কমিটি গড়েন। ১৮৭৮-এ এই রেললাইন বসানোর দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় কলকাতার ‘টম মিচেল অ্যান্ড রামসে কোম্পানি’কে। জামালপুরের ইআরআর ওয়ার্কশপে তৈরি হতে থাকে এই রেল টানার উপযুক্ত ছোট ইঞ্জিন। খুদে বলে তার নাম দেওয়া হয় ‘টাইনি’। তবে চাকা আনা হত বিদেশ থেকে। ইতিমধ্যে ‘স্টিম ট্রামওয়ে কোম্পানি’ নথিভুক্ত হয়েছে। ১৮৮১ সালের ১৫ অগস্ট সংস্থার নাম হল ‘দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে কোম্পানি’। ফ্যাঙ্কলিনই হলেন জেনারেল ম্যানেজার। সংস্থায় শেয়ার ছিল বাঙালিদেরও।
শিলিগুড়ি থেকে দু’ফুট গেজের লাইন পাতার কাজ শুরু হল। সুকনা, রংটং হয়ে তিনধারিয়া পর্যন্ত লাইন বসিয়ে ১৮৮০ সালের মার্চে ভাইসরয় লর্ড লিটনকে নিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে যাত্রা শুরু করে টয় ট্রেন। সে বছরই খুলে যায় শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং অবধি রেলপথ। ১৯১৪ সালে তিনধারিয়া ওয়ার্কশপ উদ্বোধনের পরে ঢাকা দেওয়া ২৬ ফুট লম্বা আরামদায়ক কামরা তৈরি হওয়ার আগে বগি বলতে ছিল চার চাকাওলা ছোট ট্রলি। কোনওটার মাথা ক্যানভাস ঢাকা। কোনওটা খোলা। টয় ট্রেন দার্জিলিং পৌঁছয় ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই। তার ঠিক পরের বছরই অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই রেলে চড়ে দার্জিলিং যান।
টয় ট্রেনের লাইন আর হিলকার্ট রোড নিজেদের মধ্যে কাটাকুটি করেছে মোট ১৭৭ বার। তবে প্রকৃতি কিন্তু আজও বেগ দিয়ে চলেছে এই লাইনকে। সবচেয়ে বেশি কার্শিয়াং-এর পাগলাঝোরা। বর্ষা এলেই সে ভেঙেচুরে দেয় রেললাইন। ইংরেজরা তাই নাম রেখেছিল ‘ম্যাড টরেন্ট’।
ব্রিটিশরা রেলপথ শুধু দার্জিলিঙেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। দু’টি শাখা লাইনও গড়েছিল। একটি সমতলে বিহারের কিষানগঞ্জ পর্যন্ত। আর একটি গেলিখোলা বা কালিম্পং রোড স্টেশন পর্যন্ত। নাম ছিল ‘তিস্তা ভ্যালি লাইন’। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮-এর মে থেকে ১৯৪০ এর মে পর্যন্ত মোট চার বার ‘তিস্তা ভ্যালি লাইন’ হয়ে ট্রেনে চেপে মংপু যান রিয়াং স্টেশনে নেমে।
এক সময় উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের অন্তর্গত ছিল দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। এটি হয়ে উঠেছিল চা বাগিচাগুলির জীবনরেখা। বাগানের চা পেটিতে ভরে এই রেলে চাপিয়ে শিলিগুড়ি পাঠানো হত। সঙ্গে আলু, শাক এবং আনাজ। আর আনা হত চাল, তেল, ময়দা, মনিহারি সব জিনিসপত্র আর চা বাগানের কর্মীদের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য। কিষানগঞ্জ থেকে আসত ধান আর পাট। ‘তিস্তা ভ্যালি লাইনে’ যাত্রীর চেয়ে মাল পরিবহণই বেশি হত। এই রেলে আসত সিংকোনা, খাদ্যশস্য, সুতিবস্ত্র, সিমেন্ট, তেল, তিব্বত থেকে আনা উল, চমরি গাইয়ের লোম, মাখন,কাঠ আর সিকিমের কমলালেবু। সে সময় শুধু সিকিমের কমলালেবু নিয়ে আসার জন্যই ছিল একটি ট্রেন। তার নাম ছিল ‘অরেঞ্জ স্পেশ্যাল’।
এক সময় ঠিক হয় এই শাখা লাইনটিকে সিকিমের গ্যাংটক অবধি নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু সে আর হয়ে উঠল না। ১৯৫০-এর জুনে প্রবল বর্ষায় তিস্তা ভয়ঙ্করী রূপে গ্রাস করলো পাশের রেলপথকে।
তা আর কখনও গড়ে তোলা হয়নি। এই শাখা লাইনটি ৫০ বছরও স্থায়ী হয়নি।
১৯৯৯-এর ২ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ‘দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে’র দার্জিলিং থেকে ঘুম এর মধ্যে চলা জয় রাইডকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দেয়। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী এই ট্রেন চালানো হয় দিনে দুই থেকে তিন বার। আগে কাটা না থাকলে টিকিট মেলা ভার। জয় রাইডে থাকে ইঞ্জিনের পিছনে নীল রঙের তিনটি প্রথম শ্রেণির চেয়ারকার। ভিতরে দু’টি করে বসার গদি আঁটা চেয়ার দু’সারিতে সাজানো। চেয়ারগুলি গাড়ির অভিমুখে দিব্যি ঘুরিয়ে নেওয়া যায়। পায়ের নীচে থাকে কার্পেট। বড় বড় কাচের জানালায় বাহারি পর্দা ঝোলানো। বেশ তর্জন, গর্জন করে দার্জিলিং স্টেশন থেকে ছাড়ে গাড়ি।
আক্ষরিক অর্থেই ‘কুউউ ঝিক ঝিক ঝিক’ করতে করতে ট্রেন চলে বাজারের মধ্যে দিয়ে, দোকানপাট, উঠোন ঘেঁষে। দোকানি, পথচলতি মানুষ, ছেলেবুড়ো হাত নাড়ে হাসতে, হাসতে। যেন পাড়ার দামাল ছেলেটা বেরিয়েছে দুষ্টুমি করতে। ব্যাপারটা ভারি মজার! এ গাড়ি যত না এগোয় তার চেয়ে বেশি আওয়াজ করে। বাতাসিয়া লুপে এসে থামে মিনিট দশেক। তার পরে আবার চলা শুরু করে দুলকি চালে এসে থামে একে বারে ঘুম স্টেশনে। এই রেলপথ তো বটেই, এক সময় এটি ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্টেশন। মেঘ কুয়াশা জড়ানো থমথমে নির্জন স্টেশন। এখানে গাড়ি মিনিট চল্লিশেক দাঁড়ায়। স্টেশনের পাশেই আছে এক সংগ্রহশালা। ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত রেলগাড়ির যাবতীয় সরঞ্জাম প্রদর্শিত হয়েছে। সঙ্গে পুরনো আমলের টয় ট্রেনের দুষ্প্রাপ্য সব ছবি এবং সে যুগের খেলনা রেলের মডেল সাজানো। দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায় সময়। বেজে ওঠে ফেরার বাঁশি!
তথ্যঋণ: দার্জিলিং এর টয়ট্রেন একাল ও সেকাল: অরুণাভ দাস
আমাদের ছোটরেল: রমেশ দাস
লেখক : অণ্ডালের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী