পুষ্ট হয়ে চলে ফ্যাসিবাদের চারা

খবর, আক্রান্ত ছাত্রেরা পুলিশকে জানিয়েছেন, কিন্তু পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ভিন্ন ক্যাম্পাসে ঢোকে কী ভাবে? তাই তারাও নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনুমতির অপেক্ষায়।

Advertisement

দীপেশ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০০
Share:

সুদূর শিকাগোতে বসে ইন্টারনেটে লাইভ দেখছি দিল্লির নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে জন পঞ্চাশেক গুন্ডার ধ্বংসলীলা চলছে। মুখ তাদের চাদরে ঢাকা, হাতে তাদের লাঠি। আর কী অস্ত্র তারা এনেছে আমার জানা নেই। ধূসর ছবি দেখে মনে হয় অন্তত এক জন যেন তাদের মধ্যে মহিলা। খবরে বলা হচ্ছে, এরা বামপন্থী ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে বদলা নিতে এসেছে। দিনের বেলা নাকি দুই দল ছাত্রের মধ্যে কিছু বচসা, হয়তো বা হাতাহাতিও, হয়েছিল। বামবিরোধী দলটি এখন বাইরে থেকে লোক জুটিয়ে এনেছে। বামেদের মারবে বলে। এক হস্টেল থেকে অন্য হস্টেলে তারা তাদের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। শুনছি তাদের কণ্ঠে নাকি স্লোগান, ‘দেশ কে গদ্দারো কো/ গোলি মারো শালে কো’।

Advertisement

খবর, আক্রান্ত ছাত্রেরা পুলিশকে জানিয়েছেন, কিন্তু পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ভিন্ন ক্যাম্পাসে ঢোকে কী ভাবে? তাই তারাও নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনুমতির অপেক্ষায়। জামিয়ায় যখন পুলিশ ছাত্রদের খোঁজে লাইব্রেরি ধ্বংস করে, সেখানে পুলিশের অনুমতি লাগে না। এ ক্ষেত্রে লাগে। ভেতরে তাণ্ডব চলছে, মাথা-ফেটে-যাওয়া এক ছাত্রী ও শিক্ষিকা বেরিয়ে আসছেন, তাও খবরে দেখছি, কিন্তু ক্যাম্পাসের পবিত্রতা রক্ষায় পুলিশ তৎপর! ধ্বংসের পাকা দেড় ঘণ্টা বাদে শুনছি কর্তৃপক্ষ পুলিশের সাহায্য চেয়েছেন, ধ্বংসকারীদের ধরপাকড়ও করতে বলেছেন। কিন্তু এই খবর যখন পেলাম, পুলিশ তখনও গেটের বাইরে, দাঁড়িয়ে!

এর পর কী হবে খানিকটা অনুমান করতে পারি। ঘটনার পর ঘটনা দেখতে দেখতে খানিকটা শিক্ষা হয়েছে। প্রথমত, দেখতে পাব সরকারি পক্ষ ও বিরোধী পক্ষের নেতারা এসে এই ঘটনার ‘তীব্র নিন্দা’ করবেন। শুনতে পাব এ হল বিবদমান দু’পক্ষেরই দোষ, হয়তো বা বলা হবে সমান দোষ। পুলিশ হয়তো দু’দলেরই কিছু লোককে বন্দি করে চালান দেবে। যে দেশে এখন একটি কবিতার পঙ্‌ক্তির অর্থ কী, তা যাচাই করতে কমিশন বসে, সেখানে নিশ্চয়ই এই কথাও শুনতে হবে যে আইন আইনের পথে চলবে ও কমিটি দিয়ে তদন্ত করে অপরাধীদের দণ্ড দেওয়া হবে। এবং দেখব বামবিরোধীদের পক্ষে শাসক দলের কিছু নেতা দলছুট ভাবে বলবেন, যা হয়েছে তা ভালর জন্যই হয়েছে, কারণ বামপন্থী ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি নকশাল-অধ্যুষিত অঞ্চল করে তুলেছে, ওদের একটা শিক্ষা পাওয়া উচিত ছিল। কেউ কেউ অনেক দিন ধরেই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি তুলে দেওয়া হোক। তাঁরা আবার সেই ধুয়ো ধরবেন। এবং দলের পক্ষ থেকে বলা হবে, এগুলো ব্যক্তিগত মত, গণতান্ত্রিক একটি দলের সভ্যদের নানান ব্যক্তিগত মত থাকতেই পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনতে শুনতে আমাদের কানও অসাড় হয়ে আসে।

Advertisement

সতীদাহপ্রথা নিবারণ করতে গিয়ে রামমোহন রায় দেশের মানুষকে প্রশ্ন করেছিলেন, “চোখের উপর এক মহিলা অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়ে জীবন্ত অবস্থায় দগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন, এই দৃশ্য দেখেও তোমাদের মনে দুঃখ জাত হয় না?” (প্রশ্নটা মন থেকে নিজের ভাষায় লিখলাম, সরাসরি উদ্ধৃতি নয়)। রামমোহনের প্রশ্নটা যেন ঘুরে ঘুরেই আমাদের ইতিহাসে ফিরে আসে। আজ আরও বেশি করে আসে। কখন আমরা অন্যের দুঃখ নিজের বলে অনুভব করি না? যখন অপরকে সত্যিই পর বলে ভাবি। রামমোহনের, বিদ্যাসাগরের সময়ে বেশির ভাগ সতীদাহপ্রথা-সমর্থনকারী পুরুষ মানুষ স্ত্রীলোকের জ্বলন্ত মৃত্যুর অমানুষিক কষ্টকে নিজের কষ্ট বলে ভাবত না। সহ বা সম অনুভূতি, যাকে আমরা এক কথায় সহানুভূতি বলি, তার ধারা সম্পূর্ণ শুকিয়ে যেত। তাই চোখ থাকতেও তারা ছিল অন্ধ, অন্তত এই ব্যাপারে। তেমনই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় পরস্পরের ব্যথা আমরা দেখতে পাই না। মুসলমান মেরে হিন্দুর আনন্দ, বা হিন্দু মেরে মুসলমানের, এর মধ্যে উভয়ের মধ্যে যে সহানুভূতির একটি বন্ধন স্বাভাবিক ভাবে শ’ শ’ বছরের সহবাসে তৈরি হয়েছে, এই বোধটাই হারিয়ে যেত। অপর তখন এতই অপর। এই কারণেই রামমোহনের প্রশ্ন নজরুল নিজের মতো করে ফিরিয়ে এনেছিলেন: ‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন/ কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র’’।

আজ এই পরকে অপরায়ণের প্রক্রিয়া দেশের রাজনীতিতে ভয়ঙ্কর ভাবে ফিরে এসেছে। ছাত্রী বা শিক্ষকের মাথা ফাটলে, আহত ছাত্রদের কেউ গুরুতর ভাবে জখম হলে, সারা জীবন পঙ্গু হয়ে গেলেও আমার কিছু এসে যায় না, কারণ তারা আমার দলের, গোষ্ঠীর, বা সম্প্রদায়ের কেউ নয়। মানুষের ইতিহাসে এমন দুর্ভাগা মুহূর্ত, দুর্ভাগ্যবশতই, সংখ্যাহীন ভাবে প্রচুর। এই সব মুহূর্তের একটি লক্ষণই হল, সহানুভূতি তার মানবিকতা হারায়, শুধু একটি দলীয় বা সাম্প্রদায়িক খাত ধরে বইতে থাকে। এই ক্ষীণস্রোত প্রাণহীন ধারাটি যে সঙ্কীর্ণ মানবজমিন ধরে বয়, সেখানে সে সঙ্কীর্ণতা ছাড়া কিছু ফলায় না। উদ্দাম হয়ে ওঠে হিংসা।

আজ কি ভারতের এই ভবিষ্যৎই দেখতে পাচ্ছি? মানুষের মন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে শিক্ষিত মানুষের আলোচনাতেও তা দেখতে পাই। ভারতে বেআইনি ভাবে আসা দরিদ্র মুসলমান সম্বন্ধে তাঁরা এমন ভাবে কথা বলেন যেন সেই মানুষগুলো আজ আর মনুষ্যপদবাচ্য নন। আজ যেন এসপার কি ওসপার, তুমি এ ধারে তো আমি ও ধারে, দেশ যেন আবার দেশভাগের খেলায় মেতে উঠেছে। তফাত, এ বারে ভাগ শুধু ধর্ম দিয়ে নয়, মতাদর্শ দিয়ে, ইতিহাসবীক্ষণ দিয়ে, ভাষা দিয়ে, কী খাদ্য কী অ-খাদ্য, তা দিয়েও। তাই তুমি আজ তুমি, আর আমি আজ আমি। অসহায় লাগে, খুব অসহায় লাগে। দেশে থাকি না, কিন্তু দেশ তো ভেতরে থেকে যায় এক ভালবাসার আশ্রয় ও আধার হিসেবে। শুধু মনে পড়ে যায়, কোনও সুধীজন বলেছিলেন, দয়া সহমর্মিতা সহানুভূতি ইত্যাদি মানবিক বোধগুলি যখন তাদের সর্বজনীন চরিত্র হারায়, যখন সমস্ত অনুভূতিই শুধু নিজের সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীর জন্য তোলা থাকে, অনুভূতির সেই অমানবিক পঙ্কিল ধারাতেই ফ্যাসিবাদের চারাটি পুষ্ট হতে থাকে।

(লেখক: ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement