ফাইল চিত্র।
আমাদের দেশে এখন মহাসমারোহে স্বচ্ছ ভারত অভিযান চলছে। সরকারি কর্মসূচিটির লক্ষ্য, আদর্শ, প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এতদিন সম্যক ধারণা অনেকেরই ছিল না। সাম্প্রতিক একটি পরিবেশ সংক্রান্ত সমীক্ষা বুঝিয়ে দিল, স্বচ্ছ ভারত অভিযান কতটা জরুরি এ দেশে। সমীক্ষার ফলাফল অবশ্য এও বুঝিয়ে দিল যে, স্বচ্ছ ভারত অভিযানে এখনও পর্যন্ত খুব স্বচ্ছ হয়ে উঠতে পারিনি আমরা।
আন্তর্জাতিক একটি সমীক্ষা বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরগুলির তালিকায় অগ্রগণ্য স্থান এক ডজনেরও বেশি ভারতীয় শহরের। বায়ু দূষণের নিরিখে সবচেয়ে দূষিত যে ১০টি শহর, সেগুলির মধ্যে ৯টিই ভারতীয়। প্রথম ২০তে মোট ১৪টি ভারতীয় শহরের অবস্থান। স্বচ্ছতা বা পরিচ্ছন্নতা কতটা শিক্ষণীয় বিষয় ভারতীয়দের জন্য, কতটা প্রাসঙ্গিক স্বচ্ছ ভারত অভিযান, আন্তর্জাতিক সমীক্ষার ফলাফল জানার পরে, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না।
বায়ুদূষণের মাত্রা সাংঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে ভারতের এই শহরগুলিতে। এই তালিকায় সামনের দিকে নাম উঠেছে আর যে সব শহরের, সেগুলিও অধিকাংশই তৃতীয় বিশ্বের শহর। অনুন্নত দেশগুলির বেশ কয়েকটি শহরের নামও উঠে এসেছে। অতএব খুব স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যাচ্ছে, প্রথম বিশ্বে অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলিতে এত দূষিত নয় শহুরে হাওয়া। বাতাসে দূষিত কণার মাত্রা ওইসব দেশগুলিতে অনেক কম।
সবচেয়ে দূষিত কোন কোন শহরগুলির বাতাস? তালিকাটাই অনেক কথা বলে দেয়। এই দূষণের সঙ্গে যে অর্থনীতি বা আর্থ-সামাজিকতার নিবিড় যোগ রয়েছে, তা আলাদা করে বলে দিতে হয় না। প্রথম বিশ্বের দেশগুলি শহুরে বাতাসকে দূষণমুক্ত রাখার উপরে জোর দিতে পেরেছে, সে বিষয়ে বিশেষভাবে যত্নবান থেকেছে। ভারত কিন্তু এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। রাষ্ট্র হিসাবে ভারত অনেকটা এগিয়েছে, প্রভূত ক্ষমতাশালীও হয়ে উঠেছে। কিন্তু ভারতের আর্থ-সামাজিকতা বলছে, বিপুল সংখ্যক নাগরিকের কাছে এখনও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো বুনিয়াদি চাহিদাগুলো পূরণ করাই রোজকার লড়াই। তাই জীবনযাপনের পরবর্তী স্তরটায় পৌঁছনো এখনও হয়ে ওঠেনি ভারতের। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে যে পর্যায়ে তুলে নিয়ে যেতে পারলে, জাতীয় জীবনযাত্রার মানকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করার লক্ষ্যে এগোনো যায়, ভারত এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছয়নি।
অর্থনৈতিকভাবে এবং আর্থ-সামাজিকভাবে এখনও অনেকটা উন্নত হতে হবে আমাদের, সে কথা ঠিক। কিন্তু যতদিন না সেই গন্তব্যে পৌঁছতে পারছি, ততদিন দূষিত হাওয়ায় শ্বাস নেব, ভয়ঙ্কর দূষণকে নিত্য সঙ্গী করে বাঁচব, এমনটা হতে পারে না। তাই সুস্থ জীবনের লক্ষ্যেও পদক্ষেপ আমাদের করতেই হবে।
ভারতের এক বিপুলায়তন জনগোষ্ঠীকে রোজ রুটি-রুজির লড়াইটা যে প্রক্রিয়ায় চালাতে হয়, সে প্রক্রিয়ার অনেক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই সব বাধ্যবাধকতাই অনেকাংশে এখনও পুরোপুরি সফল হতে দেয়নি স্বচ্ছ ভারত অভিযানকে। সরকারের তরফে বহুল বিজ্ঞাপন চলছে, বিপুল ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু গত বেশ কয়েকটা বছর ধরে দেশজুড়ে চলতে থাকা এই পরিচ্ছন্নতার অভিযান যতটা ছাপ ফেলবে বলে আশা করা গিয়েছিল, ছাপ ততটা পড়েনি। একইভাবে দেশে দূষণের মাত্রাতেও রাশ টানা যায়নি।
পরিস্থিতি যাই হোক, দায় কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কারণ, সমস্যাটা ভয়ঙ্কর, ভবিষ্যতে সঙ্কট আরও ভয়ানক চেহারা নেবে, যদি না সতর্ক হই এখনই। নাগরিক তার কর্তব্য পালন করছেন না— এ কথা বলে দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে না সরকার। দূষণ কমানো তো সরকারের কাজ— এই বলে দায়িত্ব এড়াতে পারেন না নাগরিকও। যে কোনও উপায়ে সুস্থ জীবনের দিকে পা ফেলতেই হবে আমাদের। সমস্ত সীমাবদ্ধতা এবং বাধ্যবাধকতা উত্তীর্ণ হয়েই সেই লক্ষ্যে এগোতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে সুনিশ্চিত করতে হবে দূষণ-রোধ। সেই লক্ষ্যেই পদক্ষেপ করুক সরকার। কোনও কঠোর পদক্ষেপ বা কড়া আইন কারও কাছে বিষবৎ ঠেকতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক মারাত্মক বিষ রোজ জমছে আমাদের প্রত্যেকের ফুসফুসে।