অলংকরণ: শৌভিক দেবনাথ।
প্রশ্ন: আপনি অর্থনীতিকে যে ভাবে দেখেন, আপনাদের নতুন বইতে তার কতটা পরিচয় মিলবে? অর্থনীতিতে তো তর্কের শেষ নেই। (অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলো-র নতুন বই: ‘গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস’, জাগারনট)
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়: অর্থনীতিবিদরা সচরাচর কোনও বিষয়ে একমত হন না।
প্র: কিন্তু তাঁরা ঈশ্বর হতে চান। স্কিডেলস্কি কেইনসের জীবনী লিখেছেন, খুবই প্রশংসা হয়েছিল সেই জীবনীর, তিনি বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘দি ইকনমিস্ট অ্যাজ় সেভিয়র’। (রবার্ট স্কিডেলস্কি, অক্সফোর্ডের ইতিহাসবিদ।) এক আমেরিকান সম্পাদক একটা বই লিখেছেন, শিকাগো স্কুলের অর্থনীতিবিদরা, বিশেষ করে মিল্টন ফ্রিডম্যান কী ভাবে সরকারের দখল নিয়ে নিয়েছিলেন, তা নিয়ে সেই বইয়ে আক্ষেপ করেছেন তিনি।
উ: বিনিয়ামিন? (বিনিয়ামিন অ্যাপেলবম, নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় লেখেন, ‘দি ইকনমিস্ট’স আওয়ার’ বইয়ের লেখক।)
প্র: হ্যাঁ।
উ: আমরা এই বইটা লিখেছি এটাই বলার জন্যে যে, অর্থনীতি খুব উপযোগী একটা বিদ্যা। আমরা বইটাতে যেটা করার চেষ্টা করেছি সেটা হয়তো বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ যা করেন তার থেকে আলাদা। তাঁরা অনেকেই দৈববাণীর মতো করে কথা বলেন। আমরা তা করিনি, করি না। আমরা যুক্তি দিই, আমরা চাই লোকে আমাদের যুক্তিগুলো শুনুক, বিচার করুক, বোঝার চেষ্টা করুক, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। এর মানে হল, তাদের সর্বদাই একটা স্বাধীনতা আছে এই কথা বলার যে— আপনি বলছেন বটে, কিন্তু তথ্যপ্রমাণ তো অন্য কথা বলছে। আমরা আসলে একটা সওয়াল করছি।
প্র: আপনি আসলে শিক্ষকের ভূমিকায়।
উ: আমরা তো শিক্ষকই।
আরও পড়ুন: এক্সক্লুসিভ অভিজিৎ: কলকাতা প্রাণবন্ত মেধাচর্চার একটা বড় জায়গা ছিল, এখন আর তা বলা যাবে না
প্র: শেষমেশ বাবারই ছেলে?
উ: একদম। আমার স্বভাবটা একেবারে ষোলো আনা মাস্টারির। আমি চাই মানুষ নানা বিষয় নিয়ে ভাবুক, বুঝুক, তা নিয়ে সুস্থ আলোচনায় যোগ দিক। অর্থনীতির বিদ্যা এমন একটা যন্ত্র নয় যেখান থেকে অভ্রান্ত সত্যগুলো বেরিয়ে আসবে। সেখানে সমস্ত সংশয়গুলো তোলা হবে, তা নিয়ে আলোচনা হবে, তার মীমাংসার চেষ্টা চলবে, সেটাই তো তার কাজ। ভেবে দেখুন, আমরা যখন নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া ভাবে অর্থনীতি নিয়ে কথা বলি, তখন তো নানা মত নিয়ে আমাদের কোনও সমস্যা হয় না, দিব্যি আলোচনা চলে। কিন্তু বাইরের পরিসরে কথা বলতে হলেই আমরা দৈববাণী দিতে শুরু করি। আমাদের এই বই সব রকমের দৈববাণীর বিরোধী, ইতিহাসের সব দৈববাণীর, শিকাগোর দৈববাণীরও। বিশেষ করে পণ্ডিতরা যখন তা করেন তখন সেটা বেশি বিপজ্জনক, তাঁদের ‘সত্য’ ঘোষণা মানুষকে আরও ভয় পাইয়ে দেয়, কারণ তাঁরা সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেন না। আমরা চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব সাদামাটা ভাষায় কথা বলতে, মানুষ যা বোঝে।
অল্প আঁচে অমলেট।—ছবি: কুনাল বর্মণ
প্র: বইটা তো খুবই প্রাঞ্জল।
উ: সেটাই আমাদের চেষ্টা ছিল।
আরও পড়ুন: ‘প্রেসিডেন্সিতে সবাই উচ্চবর্ণের, জেএনইউ-তে আমার জাতপাতের চেতনা, আর হার্ভার্ড শেখাল কঠোর পরিশ্রম’
প্র: আপনারা কী ভাবে লেখেন? দু’জনে আলাদা করে লেখেন, তার পর একসঙ্গে মেশান?
উ: সাধারণত আমরা, এস্থার আর আমি, দু’তিন দিন ধরে একটা লম্বা আলোচনা করি। তার পর আমরা অনেকটা মালমশলা এক জায়গায় জড়ো করি। আমার প্রধান কাজটা হল সেগুলো সব সাজিয়ে গুছিয়ে একটা কাঠামোতে আনা, যাতে তা থেকে একটা গল্প বেরিয়ে আসে। ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম, যে, কতকগুলো আলাদা আলাদা কাহিনি একসঙ্গে জড়ো করে তা থেকে একটা টানা গল্প তৈরি করি আমরা। প্রথম কাজটা সাধারণত এস্থারই বেশি করে। এই বইয়ের গোটা দুয়েক চ্যাপ্টার অবশ্য আমি একেবারে শুরু থেকেই লিখেছি।
প্র: উনি এখনও আপনার ছাত্রী?
উ: না। ওর দক্ষতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। এস্থার খুব পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ও বলে দেয়, এটা ফেলো, ওটা রাখো। এ ব্যাপারে আমার খামতি আছে। কোনটা রাখব, কোনটা নয়, এই নিয়ে আমার দ্বিধার শেষ থাকে না। ওই যে দুটো চ্যাপ্টার লিখেছি, ওতেই আমার অনন্তকাল লেগেছে। ওই জন্যে প্রথম সিদ্ধান্তটা ও নিলে ভাল কাজ হয়। ও যেটা দরকারি মনে করে, রাখে। তার পর আমার যদি কিছু যোগ করার দরকার মনে হয়, সেটা বলি। তবে বেশির ভাগ সময়েই এস্থার যেগুলো বেছে নেয়, আমি তা থেকেই একটা কাহিনি তৈরি করতে চেষ্টা করি। যাতে গল্পটা তরতর করে এগোয়, অবাক করে, মোড় নেয়। লেখাটা যে পড়বে, আমি তার পড়ার দিকটাতে খুব জোর দিই, পাঠকের কেমন লাগবে সেটা আমার কাছে বড় প্রশ্ন। আমরা দু’জনে দু’রকম কাজ ভাল পারি, তাতেই কাজটা ভাল এগোয়।
প্র: বাড়িতে আপনারা কাজের কথা বলেন? খাওয়ার টেবিলে?
উ: বাড়িতে মাঝেমধ্যে কাজের কথা হয়। খাওয়ার টেবিলে বাচ্চারা থাকে, সেখানে তো পুরোটা ওদের নিয়েই... অন্য কথার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বাড়িতে গেস্ট থাকলে আলাদা কথা।
প্র: খবরটা শুনে প্রথম কী মনে হয়েছিল?
উ: আমরা আগেই শুনেছিলাম, ব্যাপারটা কী রকম হয়। প্রথমে একটা ফোন আসে, একটা গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়, তার পর আসল ফোনটা আসে— এই সব। ঠিক সে রকমই হল। এতটাই মিল যে এক বার মনে হয়েছিল সবটাই হয়তো বানানো, বাজে রসিকতা। তার পর বোঝা গেল খবরটা ঠিকই। তখন ঘড়িতে পৌনে পাঁচটা, ভোররাত। কিছু করার ছিল না, ফলে আর একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হল। বিশেষ কিছু করার কথা মনে হয়নি। এটাই ঘটনা। একেবারেই।
প্র: তবু, কী করলেন?
উ: ডিনার তৈরি করলাম। মেন কোর্স যেটা বানালাম, অমলেট— মাশরুম, কড়াইশুঁটি আর চিজ।
প্র: ডিমের সাদা আর হলুদটা আলাদা করে ফেটালেন?
উ: না, একসঙ্গেই।
(একটু অবাক হলাম।)
উ: তবে একটু জল দিলাম।
প্র: আর দুধ?
উ: না, দুধ দিই না। একটু বেশি হয়ে যেত। আমি অল্প আঁচে এটা বানাই, তাতে খুব নরম হয়। ভালই হয়। আমি এ সব ব্যাপার আন্দাজেই করি। জীবনে এত অমলেট বানিয়েছি যে মোটামুটি সব সময়েই ঠিকঠাক হয়।
(তিন পর্বে এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হচ্ছে, আজ শেষ পর্ব)