Russia

Russian invasion of Ukraine: পুতিনের রাশিয়া কি ‘ফুটো মস্তান’! ইউক্রেন যুদ্ধ ১০০ দিন পেরোল, এ প্রশ্ন তো স্বাভাবিক

দেশের কঠিন সময়ে যথার্থ নেতৃত্ব দিলেন জেলেনস্কি। আমাদের পছন্দ হল না। কমেডিয়ান দেশ চালাবে? দেশের নেতার মধ্যে একটু ঋষিসুলভ গাম্ভীর্য থাকবে না?

Advertisement

অর্ধেন্দু সেন

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২২ ০৮:৫৭
Share:

রাশিয়াও বসে নেই। তাদের মিসাইল ১,০০০ কিলোমিটার দূরে টার্গেট ধ্বংস করে দেখিয়েছে। —ফাইল চিত্র।

এ রকম কিন্তু কথা ছিল না। কথা ছিল হবে ভিনি ভিডি ভিসি। বিশ্বের ডজনখানেক শক্তিধর নেতার মধ্যে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন সাহেবকে মনে করা হয় মহাশক্তিধর। তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেছে ইউক্রেনের ভোলোদিমির জেলেনস্কি। দুঃসাহস ছাড়া কী বলবেন একে! পুতিনের ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্যাঙ্কবাহিনীর সামনে কত দিন দাঁড়াবে ইউক্রেন? বড় জোর দু’সপ্তাহ, বললেন বিশেষজ্ঞরা। পুতিন আসবেন। দেখবেন। জয় করে বেরিয়ে যাবেন। রাজধানী কিভের পতন অনিবার্য দেখে জেলেনস্কি পালিয়ে আশ্রয় নেবেন ফ্রান্সে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত নতুন প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করবেন যে, নেটো-অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনও বাসনা তাদের নেই। অস্ত্রক্ষেপণ বন্ধ হবে। শুরু হবে পুষ্পবৃষ্টি।

Advertisement

পালাটা কিন্তু চিত্রনাট্য অনুযায়ী চলল না বেশি দিন। রাশিয়ান সৈন্যদের বোঝানো হয়েছিল, ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ পথের দু’ধারে সমবেত হবে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে। আপ্যায়ন করতে। তা তো হলই না, বরং সাধারণ মানুষকে দেখা গেল সেনাবাহিনীর পাশে। সাত লক্ষের বাহিনী স্ফীত হয়ে দাঁড়াল নয় লক্ষে। মহিলাদেরও— যাঁদের বাংলায় আমরা সুন্দরী বলি— দেখা গেল বন্দুক কাঁধে। গোড়ার দিকে রাশিয়ার মিসাইল আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল সামরিক টার্গেটে। দু’-এক দিনেই তা আছড়ে পড়ল আবাসনে, স্কুলে, হাসপাতালে।

বহু মানুষ ভিটেছাড়া হলেন। দেশ ছেড়ে পালালেন কয়েক লক্ষ। ইউরোপ তাঁদের আশ্রয় দিল। সিরিয়ার মানুষ যে সহমর্মিতা চেয়েও পাননি, ইউক্রেনের মানুষ তা অনায়াসে পেলেন। একেই বলে ত্বকের জেল্লা! সে যা-ই হোক, ধ্বংসলীলার মধ্যে যাঁরা রয়ে গেলেন, তাঁদের মনোবল অটুট রইল। রাশিয়ান ট্যাঙ্কের পথ আটকে দাঁড়িয়ে এক মহিলা— সে ছবি ভাইরাল হল। দেশের কঠিন সময়ে যথার্থ নেতৃত্ব দিলেন জেলেনস্কি। আমাদের অবশ্য পছন্দ হল না। একটা কমেডিয়ান দেশ চালাবে? লোকটা টি-শার্ট পরে প্রেস কনফারেন্স করে! দেশের নেতার মধ্যে একটু ঋষিসুলভ গাম্ভীর্য থাকবে না?

Advertisement

রাশিয়ান ট্যাঙ্কের পথ আটকে দাঁড়িয়ে এক মহিলা— সে ছবি ভাইরাল হল। ছবি সংগৃহীত।

ভারতীয় নাগরিকের জন্য উপযুক্ত ন্যারেটিভ তৈরি করল হোয়াটসঅ্যাপ। বোঝা গেল, জেলেনস্কি প্রভু চিনতে ভুল করেছেন। কোনও শক্তিশালী রাষ্ট্রের আশেপাশের দেশগুলির তো একটু সমঝে চলা উচিত! রাশিয়ার কাছে থেকে আমেরিকার সঙ্গে দহরম মহরম! এতো লাভ জিহাদের শামিল। মিমে দেখা গেল, ভেবেচিন্তে জীবনসঙ্গী বাছাই না করলে মেয়েদের কী করুণ অবস্থা হয়। প্রত্যাশিত ভাবেই পশ্চিমী দুনিয়া যুদ্ধের জন্য আমেরিকা আর জেলেনস্কিকে দায়ী না করে দোষী করল পুতিনকে। রাষ্ট্রসঙ্ঘে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দায় প্রস্তাব পাশ হল ১৪১ বনাম ৫ ভোটে। ভারত ভোটদানে বিরত রইল।

তার কারণ ছিল একাধিক। প্রথম কারণ, নিন্দাপ্রস্তাবের ভাষা। সব দোষ অবশ্যই রাশিয়ার নয়। নেটো রাশিয়ার সীমান্তে তার প্রভাব বিস্তার করছে, অস্ত্রশস্ত্র মজুত করছে দেখেও রাশিয়া সব কিছু নিঃশব্দে মেনে নেবে, তা মনে করার কোনও কারণ ছিল না। তাই নিন্দা প্রস্তাবে রাশিয়ার পরেই নাম থাকা উচিত ছিল আমেরিকা আর নেটোর।

দ্বিতীয় কারণ এই যে, অস্ত্র আমদানির নিরিখে ভারত বিশ্বে তৃতীয় স্থানের অধিকারী। এবং এই অস্ত্রের বেশির ভাগই আসে রাশিয়া থেকে। ভারতের সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক, ক্ষেপণাস্ত্র, কামান, নৌবাহিনীর সাবমেরিন, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এবং এয়ার ফোরসের মিগ বিমান— সবই এসেছে রাশিয়া থেকে। তাই আমরা দেশের স্বার্থে বিরত থেকেছি ভোটদানে।

তৃতীয় কারণ, ভারত এখন সুপারপাওয়ার হওয়ার দাবিদার। ভারতের পড়শিদের বোঝা দরকার যে, ভারতের বশ্যতা স্বীকার করাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক হবে। মঙ্গলের হবে। ভারতের মোদী রাশিয়ার পুতিনের তুলনায় কোনও অংশে কম নন।

ড্রোনাচার্যের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে দু’পক্ষেই। ড্রোনের সূক্ষ্ম ক্যামেরা ছবি তুলছে শত্রুশিবিরের। ছবি: রয়টার্স।

পণ্ডিত নেহরু থাকলে কী করতেন? খুব সম্ভব তিনিও ভোটদানে বিরত থাকতেন। দু’দেশের সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজন তিনি নিশ্চয়ই বুঝতেন। কিন্তু রাশিয়াকে তিনি ছেড়ে কথা বলতেন না। আগ্রাসনের কড়া নিন্দা করতেন বলেই মনে হয়। বিরোধীরা নিশ্চয়ই তাঁর নীতিতে কিছুটা দ্বিধার পরিচয় পেতেন। সমালোচনার সুযোগ পেতেন। কিন্তু বিশ্বের দরবারে আমাদের কদর বাড়ত বই কমত না। আজকের বলিষ্ঠ নেতা সে সমালোচনার সুযোগ দেননি। কিন্তু তাঁকেও নিশ্চয়ই ভাবতে হচ্ছে জেলেনস্কিকে যারা ১০০ দিনেও পরাজিত করতে পারে না, তাদের উপর আমাদের কেন এই নির্ভরতা?

যুদ্ধের রীতিনীতি বদলে গিয়েছে। ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলে বিস্তীর্ণ সমতল ক্ষেত্র। ট্যাঙ্ক চালাবার জন্য আদর্শ জমি। তাই রাশিয়া যুদ্ধে নেমেওছিল সাত হাজারের বেশি ট্যাঙ্ক নিয়ে। শোনা যাচ্ছে, তার শতকরা ১০ ভাগ এখন অকেজো। ট্যাঙ্কের এই হাল হয়েছে আমেরিকার জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য। ইউক্রেনের সৈন্য কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছে এই মিসাইল। লক্ষ ডলারের একটা মিসাইল ধ্বংস করছে কোটি ডলারের একটা ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কের অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছে ইউরোপীয় দেশের গোয়েন্দাবাহিনী। এলন মাস্ক নাকি কয়েক হাজার স্টারলিঙ্ক ল্যাপটপ বিলি করেছেন ইউক্রেনে। ট্যাঙ্কের অবস্থান পৌঁছে যাচ্ছে ল্যাপটপে। মিসাইলকে পথ দেখাচ্ছে অত্যাধুনিক লেসার। ছুঁচোবাজির মতো একেবেঁকে টার্গেটের দিকে ছুটছে তারা। ভুল হওয়ার চান্স কম। জ্যাভেলিন মিসাইলের প্রস্তুতকারী আমেরিকার লকহিড কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন আকাশছোঁয়া।

ড্রোনাচার্যের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে দু’পক্ষেই। ড্রোনের সূক্ষ্ম ক্যামেরা ছবি তুলছে শত্রুশিবিরের। সে ছবি পরীক্ষা করা হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে। ১০০ দিনের যুদ্ধে রাশিয়ার সাত জন জেনারেলের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। কোনও সন্দেহ নেই, তাঁদের অবস্থান ধরা পড়েছে স্যাটেলাইটে অথবা ড্রোনে। আমরা ছবিতে দেখেছি, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার জাহাজ মস্কোভা আক্রান্ত হল। এ সবই হল অত্যাধুনিক প্রযুক্তির খেলা।

যুদ্ধের রীতিনীতি বদলে গিয়েছে। ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলে বিস্তীর্ণ সমতল ক্ষেত্র। ট্যাঙ্ক চালাবার জন্য আদর্শ জমি। ছবি: রয়টার্স।

রাশিয়াও বসে নেই। তাদের মিসাইল ১,০০০ কিলোমিটার দূরে টার্গেট ধ্বংস করে দেখিয়েছে। মার্চ মাসে রাশিয়া একটা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ করে ইউক্রেনে। এই ধরনের অস্ত্রের গতিবেগ হয় শব্দতরঙ্গের গতিবেগের পাঁচগুণ থেকে ২৫ গুণ। এই অসম্ভব গতিবেগেও তারা দ্রুত পথ পরিবর্তন করতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্র কোন পথে যাবে, কোথায় গিয়ে পড়বে, কিছুই বোঝা যায় না। সব শেষে মাথায় রাখতে হয় রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তির কথা। যুদ্ধে আরও ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হলে পুতিন কি ছোট সাইজের পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে পিছপা হবেন?

এক ইউক্রেন নিয়ে এত সমস্যা। এখন ফিনল্যান্ড আর সুইডেন চাইছে নেটোর সদস্য হতে! এদের সদস্যপদ অনুমোদিত হলে অনেক বেশি চাপে পড়বেন পুতিন। আরও সমস্যা হবে, যদি নরওয়ে এবং হল্যান্ডের প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলি রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনে। তেলের ক্ষেত্রে তারা এমনই পদক্ষেপ করেছে। গ্যাসের বেলায় কাজটা এত সহজ হবে না। কিন্তু কিছুই অসম্ভব নয়। সত্তরের দশকে ইউরোপ মনস্থির করে রাশিয়া থেকে গ্যাস কেনার। আমেরিকা তখন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ইউরোপকে নিরস্ত করতে। কারণ কমিউনিস্ট দেশের উপর এতটা নির্ভরতা বাঞ্ছনীয় নয়। কমিউনিস্টরা চলে গেলে যে সমস্যা বাড়বে তা কি কেউ জানত?

(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement