Price Hike

দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে

আনাজপাতির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হইচই শুরু হতে প্রতি বছরের মতো এ বারও মুখ্যমন্ত্রী-গঠিত টাস্ক ফোর্স বাজারে নেমেছে, বিভিন্ন বাজারে আনাজের দাম জানার চেষ্টা করছে।

Advertisement

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪ ০৮:৪৪
Share:

বছর বছর একই ঘটনা। শীত পেরোলে আনাজের দাম বাড়তে থাকে, বর্ষা পড়তে না পড়তেই বাজার আগুন। এমনকি আলু, পেঁয়াজ, রসুন-সহ বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্করহিত আনাজের দামও আকাশ ছোঁয়। এই বৃদ্ধি অতি দ্রুত ও উচ্চ হারে ঘটে বলে তা সাধারণ মানুষকে বিচলিত করে বেশি। বাজারে কিন্তু সমান্তরাল ভাবে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, মশলা-সহ অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও বছরভর বেড়ে চলে। একটু একটু করে এমন ভাবে তা বাড়ানো হয় যে নজরে আসে না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এ ভাবে বাড়তে বাড়তে এক বছরেই ভোজ্যসামগ্রী-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অন্তত ১৫-২০% বেড়ে যায়; কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও বেশি।

Advertisement

অতিরিক্ত খরচে নাভিশ্বাস উঠলেও মানুষ এই জুলুম মেনে নিতে বাধ্য হন। মূল্যবৃদ্ধির এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এ রাজ্যে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ঐতিহ্য বহুকাল আগেই বিলীন। যে আগুনখেকো বামপন্থীরা একদা ট্রামভাড়া তিন পয়সা বৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতায় বাস-ট্রাম জ্বালিয়ে প্রশাসনকে চরম বিপাকে ফেলেছিলেন, তাঁদের উত্তরসূরিরা আজকাল বিচ্ছিন্ন কিছু বিবৃতি দিয়ে দায় সারেন। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের দাবির পরিবর্তে কেন্দ্র বা রাজ্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে ব্যস্ত, কাজের কাজ কিছু হয় না।

আনাজপাতির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হইচই শুরু হতে প্রতি বছরের মতো এ বারও মুখ্যমন্ত্রী-গঠিত টাস্ক ফোর্স বাজারে নেমেছে, বিভিন্ন বাজারে আনাজের দাম জানার চেষ্টা করছে। টাস্ক ফোর্সের সদস্যদের এ-হেন আচরণ দেখে অনেকে মজার ছলে বলছেন, এঁদের বোধ হয় কোনও কিছু কিনে খেতে হয় না!

Advertisement

প্রশ্ন হল, টাস্ক ফোর্সের পক্ষে কি এ ভাবে বাজারে হানা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানা সম্ভব? বাজারে এখন আনাজ-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তা অন্যায্য চিহ্নিত করে বিক্রেতাদের দাম কমাতে বাধ্য করার সত্যিই কি কোনও আইনি সংস্থান আছে? উপভোক্তা সুরক্ষা আইন, ২০১৯-এর ধারা ২-এর উপধারা ৬(৪) অনুযায়ী, চারটি ক্ষেত্রে কোনও বিক্রেতার বিরুদ্ধে বাড়তি দাম নেওয়ার অভিযোগ জানানো যেতে পারে। রাষ্ট্রের নির্ধারণ করা বা কোনও সুনির্দিষ্ট আইনবলে ধার্য হওয়া দামের চেয়ে বেশি নেওয়া হলে, কোনও পণ্য বা পণ্যের মোড়কের উপরে লেখা দামের চেয়ে বেশি নেওয়া হলে, বিক্রেতা-প্রদর্শিত বা আইনসঙ্গত ভাবে প্রস্তুত মূল্যতালিকায় লেখা দামের চেয়ে বেশি নেওয়া হলে, এবং ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে চুক্তিতে স্থির হওয়া দামের চেয়ে বেশি নেওয়া হলে। বলা বাহুল্য, বাজারে বিক্রি হওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বর্তমান দাম আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় যতই বেশি মনে হোক, এ বিষয়ে বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ করা কঠিন।

গত ১০ জুলাই টাস্ক ফোর্সের সদস্যদের মিটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে ভোজ্যপণ্য, বিশেষত আলুর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পিছনে অধিক মুনাফার লোভে মজুতদারির কথা বলেছেন তা অমূলক নয়। উপভোক্তা সুরক্ষা আইন, ২০১৯-এর ২-এর উপধারা (৪৭) (৩) (৫) অনুযায়ী মজুত বা নষ্ট করার মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে কোনও জিনিসের দাম বাড়ানো হলে তা অন্যায্য বাণিজ্য অনুশীলন হিসেবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য হওয়ার কথা। কিন্তু ২০২০-র সেপ্টেম্বরে পাশ হওয়া ‘অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধন) আইন, ২০২০’ অনুযায়ী দানাশস্য, ডাল, তৈলবীজ, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ ও আলুর মতো বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোজ্যসামগ্রীকে অত্যাবশ্যক জিনিসপত্রের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলত সঙ্ঘবদ্ধ মজুতদাররা ওই সব সামগ্রী যথেচ্ছ মজুত করে একতরফা দাম বাড়িয়ে চললেও আইনি পথে তাদের নিরস্ত করা এক প্রকার অসম্ভব। বলার অপেক্ষা রাখে না, সম্প্রতি লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির পশ্চাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে কটাক্ষ করেছেন তা যথার্থ।

প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা যে মূল্যবৃদ্ধির এই আঁচ কিছুটা প্রশমিত করতে পারে, সেই হদিস দিলেন লোকাল ট্রেনের ভেন্ডর কামরার এক যাত্রী, যিনি নিজে গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজার থেকে আনাজ কলকাতায় সরবরাহ করেন। তিনি জানালেন, আনাজ কেনার সময় একাধিক সমিতি বা কমিটিকে চাঁদার নামে তোলা দেওয়া শুরু হয়। তার পর সেই আনাজ বিক্রয়স্থলে পৌঁছনো পর্যন্ত সরকারি আইনরক্ষক থেকে শুরু করে স্বনিযুক্ত অসরকারি শৃঙ্খলারক্ষকদের যে পরিমাণ তোলা দিতে হয়, তা কমবেশি ওই আনাজের কেনা দামের সমান। কোথাও আবার মাসিক চুক্তির ‘সুব্যবস্থা’ আছে, বিনিময়ে ‘কার্ড’ তথা ওই এলাকা পেরোনোর ছাড়পত্র মেলে। রেলে পরিবহণ করলেও তোলা থেকে রেহাই নেই: রেলকর্মী থেকে আইনরক্ষক, সবাইকে খুশি না করে স্টেশন থেকে বেরোনো অসম্ভব।

প্রশাসন যদি এই অবৈধ তোলা আদায় বন্ধ করতে পারে, তা হলে আনাজের দামে সাময়িক স্বস্তি মিলতেও পারে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালে বেঁধে রাখতে হলে প্রচলিত আইনগুলির উপভোক্তা-বান্ধব হয়ে ওঠার সংস্কারকাজ প্রয়োজন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement