বহরমপুরের বানজেটিয়ায় নদিয়া একাদশ বনাম মুর্শিদাবাদ একাদশ মহিলা ফুটবল খেলা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
মেয়েদের খেলাধুলা আর বাংলা সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠতে পারল না। কিন্তু মেধা ও সাংস্কৃতিক প্রতিভার বাইরে, মেয়েদের সামাজিক পরিচয় তৈরি ও স্বনির্ভরতা লাভের দৌড়ে খেলাই ছিল ভরসাযোগ্য, সুস্থ এক মাধ্যম। এ দেশে চিরকাল খেলা পুরুষতান্ত্রিকতার ধাঁচে বিশ্লেষিত, এই প্রথা ভেঙে খেলার মাঠে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা নারীত্বের এক সামাজিক চ্যালেঞ্জ। তবু চার পাশের সব বাধা, নিষ্ঠুরতা অতিক্রম করে মেয়েরা খেলছে, সামাজিক সাম্যের রজতরেখা সেটুকুই।
নারীত্বের কিছু কাল্পনিক অথচ প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নিয়মাবলি আছে, মেয়েদের ক্রীড়া-অবরোধের জন্য সেই শর্তগুলিই যথেষ্ট। সে কারণে ফুটবলের মতো ‘বডি-কন্ট্যাক্ট গেম’-এ আসা অধিকাংশ মেয়ের পরিবার একটা নির্দিষ্ট সীমার পর আর ঘরের মেয়ের ক্রীড়ানিপুণ হয়ে ওঠায় সহযোগিতা করে না। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশও তাঁদের সাফল্যে নির্বিকার, ওঁদের সাফল্য উদ্যাপন করে না। সমাদর মেলে না বন্ধুদের কাছেও। নিবে যায় খেলার মাধ্যমে আত্মপরিচয় তৈরির ইচ্ছা।
ফুটবল যে নারী ক্ষমতায়নের একটা শক্তপোক্ত উপায়, বিশ্বের নানা দেশে তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। অথচ ভারতে এখনও জনমানসে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে উদাসীনতা স্পষ্ট। তার সঙ্গে আছে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ, সাংস্কৃতিক টানাপড়েন। এ দেশে ফুটবল ও মেয়েদের সংযোগের প্রতিকূল পরিবেশ বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা হয় নানা ভাবে। দেশি বা বিদেশি ক্লাব ও অন্যান্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা এ দেশে অনেকগুলি ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরি করেছে। পরিকল্পনা খারাপ নয়, তবে এদের মূল উদ্দেশ্য বাণিজ্য। ভারতের জনসংখ্যা এদের কাছে লোভনীয়। কিছু ভাল ফুটবলার নিশ্চিত ভাবেই তৈরি হবে, মেয়েদের ফুটবল আধুনিক হবে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু এই বেসরকারি অ্যাকাডেমিগুলিতে আবাসিকদের বাৎসরিক ভরণপোষণের খরচ মধ্যবিত্ত পরিবারের সামর্থ্যের বাইরে। সারা দেশে প্রান্তিক নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই ফুটবলের ‘সাপ্লাই লাইন’ টিকিয়ে রেখেছে। তাই এই অ্যাকাডেমিগুলির রমরমায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সম্ভাবনাময় দরিদ্র মেয়েরা। এ ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান, বৃত্তি, সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি খুব জরুরি। তেমন উদ্যোগ বিরল। ফলত নারী ক্ষমতায়নের যুদ্ধে ‘ফুটবল’ নামক অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ফুটবলের মাধ্যমে প্রান্তিক মেঠো মেয়েদের অন্তত পারিবারিক স্তরে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার যে ন্যূনতম সুযোগ তৈরি হতে পারত, তা ক্রমশ চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে ।
জাতীয় ও রাজ্য স্তরে অনেক মহিলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে। সেখানে যত না নামের পরিবর্তন ঘটেছে, মানের তত নয়। আসলে এই প্রতিযোগিতাগুলি সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক ক্রীড়া নীতি অনুসরণ করে না। হয়তো এতে খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত এক শ্রেণির মানুষের কিছু স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে, নাম বা প্রতাপ বাড়ছে, কিন্তু খেলোয়াড় মেয়েদের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে না। সরকারি উদ্যোগ ছাড়াও রাজ্যের নানা জায়গায় মেয়েদের ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়, সেগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে ‘খেপ খেলা’ ছাড়া আর কিছু নয়। মেয়েদের সম্ভাবনার অপব্যবহার করে এক দল মধ্যস্বত্বভোগী মানুষ আখের গোছাচ্ছে। যোগদানকারী দলসংখ্যা যা-ই হোক, দিনরাত রোদে পুড়ে জলে ভিজে এক থেকে দু’দিনে শেষ করা হয় প্রতিযোগিতা। ছোট্ট মাঠে ‘সেভেন আ সাইড’ খেলা চলে মিনিট পনেরো, পাঁচ মিনিটের বিরতি শেষে শুরু দ্বিতীয়ার্ধের খেলা। নিংড়ে নেওয়া হয় ফুটবলারদের শারীরিক সক্ষমতা। একটা টুর্নামেন্ট শেষে নতুন টুর্নামেন্ট শুরুর আগে দেওয়া হয় না ‘রিকভারি’ বা প্রস্তুতির সুযোগও। এ ভাবে খেলার মূল্যায়ন হয় না। ফলে বড় দলে খেলার সুযোগ পায় না এই মেয়েরা। অল্পেই নষ্ট হয় তাদের ফুটবল-দক্ষতা। মেয়েদের ফুটবল বলেই কি আয়োজন ও মানে এত অবহেলা! কিন্তু লাভের গুড় ঠিকই খেয়ে যায় এজেন্টরা।
বাঙালির কাছে ফুটবল একটা ঐতিহ্য, কিন্তু মেয়েদের ফুটবল কোনও কালেই ‘জাতে’ উঠতে পারল না। অনাদরের এই আর্থ-সামাজিক পরিসরে একুশ শতকে আমাদের ক্রীড়া-সংস্কৃতি হয়ে উঠছে নারী-অবহেলার প্রতীক। এমনিতেই আমাদের ক্রীড়া-সাফল্যের লেখচিত্রটি নিম্নমুখী (ক্রিকেট বাদে)। ক্ষুধা, ক্লান্তি, আঘাতের বোধ ছাপিয়ে নারীত্বের শরীরী যন্ত্রণা কোনও পুরুষ ক্রীড়াবিদকে ভোগ করতে হয় না। নারী খেলোয়াড়দের তা পীড়া দেয় প্রতি পদে। পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য রুখে মেয়েদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে ফুটবল— তাই মাঝমাঠে নারীদের দৌড় থামাতে শুরু হয়েছে পুরুষদের হস্তক্ষেপ, নিগ্রহ। সম্প্রতি কন্যাশ্রী কাপের দ্বিতীয় ডিভিশনের ম্যাচে একটি ক্লাবের ফুটবলার মেয়েরা শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হল। মদ্যপদের মারে তাদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তিও করতে হয়। পুরুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার আগ্রাসন ছাড়া একে আর কী-ই বা বলা যায়? পুরুষতন্ত্রের তর্জনে আক্রান্ত নারীসুরক্ষা, মানবাধিকার, ফুটবল নিয়ামক সংস্থার সুরক্ষাও। খেলার মাঠে প্রকাশ্যে মেয়েদের এই নিগ্রহ কি আমাদের ক্রীড়া-সংস্কৃতির শেষের শুরু নয়? এই সামাজিক ব্যাধির নিরাময় কি সত্যি সম্ভব?