এ দেশের মেয়েদের খেলার মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থা ফুটবলের।
গত বছর টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতীয় মহিলা হকি দলের প্রতিনিধি বন্দনা কাটারিয়ার ‘অপমান’ মনে আছে? হরিদ্বারের কাছে রোশনাবাদে এই দলিত-কন্যার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখান উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা। তাঁর অসাধারণ পারফর্ম্যান্সের পরেও তিনি দলিত, এটাই নাকি দলের হারের কারণ! কিন্তু এক বছরে আমরা সম্পূর্ণ পাল্টে গেলাম! দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন। জনজাতির মহিলার সাফল্যে গণতন্ত্রের জয়ধ্বনিতে শামিল এই জনতা-জনার্দন বন্দনা কাটারিয়ার অপমানে নীরব ছিল।
বিক্ষোভকারীদের বিশ্বাস ছিল, দলিত কন্যাদের দলে নেওয়াতে মহিলা হকি দল সফল হয়নি। একে বলে ‘সুপরিকল্পিত কুসংস্কার’, ক্ষমতা ধরে রাখার একচ্ছত্র অবলম্বন। এমন ভাবনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মহিলা ক্রীড়া। এ দেশের মেয়েদের খেলার মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থা ফুটবলের। স্বাভাবিক। যে দেশে ফুটবল নিয়ামক সংস্থা বেতন দিয়ে জ্যোতিষী নিয়োগ করে, সে দেশের মহিলা ফুটবল নিতান্তই ‘ছেলেখেলা’। প্রগতিশীল সামাজিকতার আড়ালে আটপৌরে সংস্কৃতি চিরকালীন বৈষম্যের প্রতীক; সেখানে মহিলা ফুটবল মানেই সামাজিক অবরোধ। অবরোধ উঠতে সময় লাগে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পার করা পর্যন্ত। মহিলা ফুটবল এখনও কৌলীন্যে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট এমনকি ভারোত্তোলনেরও সমতুল্য হতে পারেনি।
এই সঙ্কীর্ণতা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। মেরামতির কোনও প্রচেষ্টাই নেই। সমকাল নারী ক্ষমতায়ন দাবি করে। কিন্তু মুষ্টিমেয় মহিলার বাছাই করা কিছু পরিসরে সমানাধিকার দিয়ে সার্বিক নারী ক্ষমতায়ন আসে না। সর্বস্তরের সব মহিলার জন্য সমবিন্যাসে প্রচলিত বৈষম্যের স্থায়ী নিরাময় সম্ভব।
চলতি বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে রাষ্ট্রপুঞ্জ সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সহযোগিতায় মডেল প্রোগ্রাম নিয়েছিল। ভারতে এখনও মহিলা ফুটবল অস্পৃশ্য। এই ক্ষেত্রটিকেই রাষ্ট্রপুঞ্জ অবলম্বন করল নারী ক্ষমতায়নের স্বার্থে। পরিকল্পনাটি অবশ্যই সামাজিক নিরপেক্ষীকরণের উপায় আর এ ভাবেই ফুটবল মেয়েদের জন্য পক্ষপাতমুক্ত হয়ে উঠতে পারে। আয়োজনটি রিফিউজি শিশু কিশোরীদের ফুটবলে উৎসাহিত করেছে।
দেশে অনুষ্ঠিত মহিলাদের এশিয়ান কাপ ফুটবল ২০২২-এ সেই অর্থে প্রচার বা সম্প্রচার কিছুই ছিল না। অদিতি চৌহানদের সমাজমাধ্যমে আবেদন জানাতে হল, “আপনাদের সমর্থন খেলার মাঠে আমাদের একশো শতাংশ দিতে সাহায্য করবে। আমাদের খেলা দেখুন এবং উৎসাহিত করুন।”
আসলে ফুটবল বলতেই মেঠো ঘেমো চোয়াড়ে খেলা বোঝায়। খেলাটির সঙ্গে রমণীয় কোমলতাকে খাপ খাওয়ানো যায় না। তাই গৃহকর্মে অপটু নারীকে আমরা চোখ রাঙাচ্ছি, ক্রীড়ারত নন্দিনীকে দেখে মুখ বাঁকাচ্ছি। বল পায়ে মেয়েরা দর্শক ঠাসা ময়দানে ঢুকে পড়লেই জনতা উৎসুক চোখে মেপে নিচ্ছে তাদের, দৃঢ়পুরুষ হৃদয়ে ধ্বনিত হচ্ছে: “মেরে অঙ্গনেমে তুমহারা কেয়া কাম হ্যায়?” পুরুষের আঙিনায় ভাগ বসালেই ক্রীড়াবীরাঙ্গনা নারী প্রকৃত নারী থাকেন না, পৌরুষ মেশানো ‘ভেজাল-নারী’ হয়ে যান।
কয়েক বছর আগেও জাতীয় মহিলা দলের প্রতি কর্তৃপক্ষের অনাদর বুঝিয়েছে এটা এমন যৌথ পরিবার যেখানে বেশিটা পাওয়া, বড়টা খাওয়া, ভালটা পরার অগ্রাধিকার পুত্রসন্তানটির। জাতীয় দলের মেয়েদের ডায়েট, ট্রেনিং, কিটস সবেতেই কার্পণ্য। কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা মেয়েদের জার্সিটি পর্যন্ত স্পনসর করত না। ফেডারেশন একটা ব্র্যান্ডেড কোম্পানি থেকে সরাসরি কিনে দিত মেয়েদের। অথচ আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং-এ বরাবর মহিলা দল পুরুষ দলের থেকে অনেক সন্তোষজনক স্থানে। জাতীয় পুরুষ দলের বিলাসের পাশে মেয়েদের ফুটবলের প্রতি এই অবহেলা দেশের সমাজচিত্রে পৌরুষের জয়গান। কিন্তু পুরাণের গল্প শুনে বেড়ে ওঠা দেশবাসী কালিদাসের বর্ণনা ভুলেছে। মহাকবি বলছেন, দেবী পার্বতীর সবচেয়ে পছন্দের খেলা কন্দুক ক্রীড়া অর্থাৎ বল খেলা। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন পঞ্চদেবতার সদস্যদলের একমাত্র নারী প্রতিনিধি পার্বতী। তিনি বল খেলেন। এতে তাঁর সার্বিক দৃঢ়তা বাড়ে। কিন্তু হাফ প্যান্ট পরা কাদা মাখা রোদে পোড়া মেয়েগুলোর সামাজিক মর্যাদাই নেই। সেখানে ফুটবল মেয়েদের পেশা হবে এই প্রত্যাশা স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্যাপনের দিনেও হয়তো কষ্টকল্পনা।
নিষ্ঠুর সামাজিক প্রতিবেশ থেকে উঠে এসে মেয়েরা যখন বিশাল অতিক্রমণের ইতিহাস তৈরি করেন তখন তাঁরা হয়ে ওঠেন নারীত্বের আলাদা অভিজ্ঞান। ফুটবলে ভারতীয় নারীর উত্থানও এক দিন আখ্যান হয়ে উঠবে।
ফুটবলপ্রেমী বাঙালির কাছে গোষ্ঠ পালের জন্মদিন ২০ অগস্ট ক্রীড়াদিবস রূপে মান্যতা পেয়েছে। অথচ কাশ্মীরি কন্যা আফসানের ফুটবল সংগ্রামের কাহিনি আমরা জানি না; ভুলে গিয়েছি অর্জুন পুরস্কার জয়ী শান্তি মল্লিককে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে নারী উন্নয়নের ফিরিস্তির বদলে সামাজিক সমতায় নারী ফুটবলকে গ্রহণ অনেক বেশি জরুরি, এটা বোঝার সময় এসে গিয়েছে।
শারীরশিক্ষা বিভাগ, বহরমপুর ইউনিয়ন ক্রিশ্চিয়ান ট্রেনিং কলেজ