মেয়েদের প্রাণের দাম কোথায় মেলে? পশ্চিমবঙ্গে একটাই এমন জায়গা আছে, কালিম্পং। সেই জেলায় মেয়েরা কোভিড টিকা পেয়েছে পুরুষদের সমান। দেশের মধ্যে কেবল দুটো রাজ্যে, হিমাচল প্রদেশ আর কেরল। নইলে সর্বত্র মেয়েদের কপালে টিকা জুটেছে কম। কত কম? জুলাইয়ের মাঝামাঝি দেখা যাচ্ছে, সারা ভারতে যত পুরুষ টিকা পেয়েছেন (২০.৪ কোটি), তার চাইতে আড়াই কোটি কম মেয়ে টিকা পেয়েছেন (১৭.৭ কোটি)।
টিকার জোগান নেই বলেই কি এমন হচ্ছে? তেমন আশাও জাগছে না। জুনের শেষ অবধি টিকা পেয়েছিলেন ১৫ কোটি মেয়ে আর ১৭.৫ কোটি পুরুষ। মানে, সেই আড়াই কোটির তফাত রয়েই যাচ্ছে। দেশের মতোই ছবি পশ্চিমবঙ্গেরও। জুনের শেষে ১ কোটি ২৫ লক্ষ পুরুষ পেয়েছিলেন টিকা, মেয়েদের সংখ্যা ছিল এক কোটির কাছাকাছি। মানে, ২৫ লক্ষ কম। তার পর পনেরো দিনে আরও ১১ লক্ষ পুরুষ আর ১০ লক্ষ মহিলা টিকা পেয়েছেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি তফাত ২৬ লক্ষ। তার মানে, টিকাকরণ বাড়ছে, কিন্তু ফারাকও বাড়ছে।
লজ্জার কথা, মেয়েদের টিকায় পিছিয়ে বাংলা। ভারতের গড় হারের চাইতেও (১০০ পুরুষে ৮৬ মহিলা) পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের হাল খারাপ (১০০ পুরুষে ৮১ মহিলা)। কেরল তো বটেই, গুজরাতের চেয়েও যা কম। খাস কলকাতায় প্রতি একশো জন পুরুষ পিছু ৭৫ জন মেয়ে টিকা পাচ্ছেন। সবচাইতে খারাপ হার ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর আর পশ্চিম বর্ধমানে।
মনে রাখতে হবে, সরকারি এবং বেসরকারি নার্স, সহকারী নার্স-ধাত্রী (এএনএম) প্রভৃতি মিলিয়ে রাজ্যে প্রায় সত্তর হাজার মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী, এবং আরও হাজার পঞ্চাশেক আশাকর্মী গোড়াতেই টিকা পেয়েছেন সরকারি নির্দেশে। পরিবার বা সমাজের নিয়ম কাজ করেনি। না হলে হয়তো মেয়েদের টিকাকরণের হার আরও নামত, প্রকট হত বৈষম্যের বহরটা।
এতে মেয়েদের জীবন যেমন বিপন্ন হচ্ছে, তেমন জীবিকাও। বিলাসী বিশ্বাস কলকাতার দুটো বাড়িতে কাজ করেন। গেরস্ত বলে দিয়েছে, টিকা না নিয়ে আসা যাবে না। বিলাসীর মতো তিনশো মেয়ে, যাঁরা চাঁদপাড়া পঞ্চায়েতে থাকেন আর কলকাতায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন, টিকার আবেদন করেছিলেন গাইঘাটার বিডিও-র কাছে। তিনি অপেক্ষা করতে বলেছেন। কবে টিকা মিলবে, কাজে যেতে পারবেন, জানেন না বিলাসীরা।
কেবল গরিবগুর্বো মেয়েরাই কি টিকায় পিছিয়ে? যাদের টাকা আছে, তারাও মেয়েদের টিকায় খরচ করতে নারাজ। ‘আমরি’ গ্রুপ কলকাতায় তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের টিকাকরণ করেছে। প্রথম দিকে পুরুষ-মহিলা অনুপাত ছিল ৬৫-৩৫, সম্প্রতি দাঁড়িয়েছে ৫৫-৪৫, জানালেন কর্ণধার রূপক বড়ুয়া। মেয়েদের প্রাণের দাম দেওয়ার প্রশ্নে সরকার যেখানে, পরিবারও সেখানে।
কোভিডের শুরু থেকেই ‘নারীর মূল্য’ বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। ভাইরাস মেয়ে-পুরুষ বোঝে না, বিশ্ব জুড়ে সংক্রমণের হার প্রায় ৫০-৫০। কিন্তু ভারতে গত বছর অতিমারির প্রথম তিন মাসে তিন জন পুরুষ পিছু মাত্র এক জন মহিলার সংক্রমণ ধরা পড়েছে। অর্থাৎ, কোভিড পরীক্ষা হয়েছে কম মেয়ের। একই সঙ্গে, মৃত্যুহারে মেয়েরা ছাড়িয়ে গিয়েছিল পুরুষদের। মানে, মেয়েদের কোভিড যখন ধরা পড়েছে, তত ক্ষণে মৃত্যু শিয়রে। ভারতে মেয়েদের পরীক্ষা কেন কম হচ্ছে, কেন মৃত্যুহার বেশি, তা নিয়ে সারা বিশ্বে বহু লেখালিখি, হইচই হল। সে সবই জলের দাগ। এ বছর মে মাসে, দ্বিতীয় ঢেউ যখন তুঙ্গে, তখনও কোভিড-পজ়িটিভদের মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ ছিল মেয়ে। মানে, আবারও কোভিড পরীক্ষার সুযোগ হয়নি বহু সংক্রমিত মেয়ের। শুশ্রূষা, চিকিৎসা, কিছুই হয়তো পায়নি। আর মৃত্যুহার নিয়ে আলোচনাই তো অর্থহীন— এ কথা কারও জানতে বাকি নেই যে, এ বছর নথিবদ্ধ মৃত্যুর চাইতে ঢের বেশি মৃত্যু ঘটেছে কোভিডে। পরীক্ষাকেন্দ্রে, হাসপাতালে যাওয়ার আগেই শ্মশান-গোরস্থানে গিয়েছে কত মেয়ে, কে বলতে পারে?
আগে পুরুষ পাবে, তবে তো মেয়েরা— সংসার-সমাজের এই ধারণা টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও কাজ করছে। অলক্ষ্যে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে মেয়েদের, বিশেষত তরুণীদের। ভারতে গর্ভবতী মেয়েদের এবং নবজাতকদের অকালমৃত্যু অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে কোভিড। জুন মাসে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের বিজ্ঞানীরা একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। মোট পঁয়ত্রিশটি দেশ থেকে হাজার দশেক মেয়ের তথ্য (মার্চ- ডিসেম্বর, ২০২০) খতিয়ে দেখে তাঁরা বলছেন, ধনী দেশের চাইতে গরিব দেশের গর্ভবতীর মৃত্যুর ঝুঁকি আটগুণ বেশি, গর্ভপাতের সম্ভাবনা ছয়গুণ বেশি, আর মৃত সন্তানের জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা দু’গুণ বেশি। অথচ, গরিব দেশের মেয়েদের মধ্যে কোভিডের লক্ষণ, কষ্ট বেশি দেখা যাচ্ছে, এমন নয়। বরং ধনী দেশগুলোতেই মেয়েদের কোভিড-জনিত সমস্যা বেশি তীব্র। কিন্তু মেয়েরা মরছে গরিব দেশেই, কারণ তাদের শরীর আগে থেকেই নানা অসুখ, অপুষ্টি আর রক্তাল্পতায় দুর্বল। পশ্চিমবঙ্গে আবার নাবালিকা মা সব রাজ্যের চাইতে বেশি— এ তথ্যটা মনে পড়লে ভয়টা আরও ঘনিয়ে আসে।
গবেষকরা সুপারিশ করছেন, গর্ভবতী মেয়েদের কোভিড টিকাকরণের বিশেষ ব্যবস্থা করা হোক। সরকার এখনও অবধি কেবল গর্ভবতীদের টিকাকরণ অনুমোদন করেছে, কার্যসূচি কিছু নেয়নি। অথচ, নড়ে বসার কারণ কি নেই? বহু চেষ্টায়, বহু অর্থব্যয়ে ভারতে জননীমৃত্যুর হার কমানো গিয়েছিল। দুটো পদ্ধতি কাজ দিয়েছিল। এক, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত প্রসূতিদের বাড়িতে ভিজ়িট, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, টিকাদান। অন্যটা, বাড়িতে প্রসব না করে হাসপাতালে প্রসব। এই কার্যসূচি গুরুত্ব হারিয়েছে কোভিড অতিমারিতে। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে সংক্রমণের খোঁজ, মা-শিশুর স্বাস্থ্য সরে গিয়েছে নিয়মিত কাজের কেন্দ্র থেকে। হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য নিশ্চয়যান, অ্যাম্বুল্যান্সও মেলেনি প্রসূতিদের, সেগুলো ব্যস্ত ছিল কোভিড-রোগী বহনে। লকডাউনে মিলছে না যানবাহন। এই সব কারণে অতিমারিতে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে প্রসব কমেছে— কোনও কোনও হাসপাতালে ২০১৯-এর তুলনায় অর্ধেক প্রসব হয়েছে ২০২০ সালে। বাংলাদেশের গবেষকরা দেখিয়েছেন, সে দেশের প্রতিটি জেলায় হাসপাতালে প্রসব অন্তত কুড়ি শতাংশ কমেছে। আমাদের দেশে কিছু টুকরো সংবাদ ছাড়া কিছুই হাতে নেই। রাজ্য বা কেন্দ্র যেন অতিমারিতে প্রসূতির কোনও ঝুঁকিই দেখছে না।
সরকারি ব্যবস্থা দায় এড়াচ্ছে, সরে যাচ্ছে সমাজও। বারুইপুরে একটি মহিলা সংগঠনের নেত্রী মীনা দাস জানালেন, গ্রামের মানুষকে হাসপাতাল যেতে হলে আশেপাশের পাঁচটা মানুষের সহায়তা লাগে। এখন কেউ এগিয়ে আসছে না সংক্রমণের ভয়ে। সংগঠনের মেয়েরাই ভ্যান জোগাড় করে প্রসূতিদের, অসুস্থদের নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে।
মেয়েদের প্রাণ রাখতে মেয়েদেরই এখন নামতে হচ্ছে রাস্তায়।