সবে চলে গেল শ্রমিক দিবস। কেমন অবস্থা এ রাজ্যের মেয়ে শ্রমিকদের? উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামীণ এলাকায় সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম, একশো দিনের কাজের প্রকল্প মেয়েদের জন্য একটা শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। সমাজ ও সংসারে সম্মানের স্থান পেতে হলে মেয়েদের আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। এই প্রকল্পের জন্য আন্দোলন কম হয়নি। ন্যূনতম একশো দিনের কাজের দাবিতে ১৯৮৯ সালে কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত তিনশো জন স্বেচ্ছাসেবীর সাইকেল মিছিল আয়োজন করা হয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী সাইকেলে দিল্লি এসেছিলেন। গণআন্দোলনের দীর্ঘ, কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে শেষ অবধি ২০০৫ সালে ২৩ অগস্ট জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু হয়। পরের বছর ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের দু’শোটি পিছিয়ে-পড়া জেলাতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, তার মধ্যে এ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলা ছিল। এর পরেও পশ্চিমবঙ্গের সব ক’টি জেলাতে প্রকল্প চালু করার জন্য আন্দোলন অব্যাহত ছিল। ধারাবাহিক চাপ সৃষ্টির ফলে ১ এপ্রিল, ২০০৮ সমস্ত জেলায় একশো দিনের কাজের প্রকল্প শুরু হল।
এই প্রকল্পে প্রধানত মাটি কাটার কাজ করতে হয়— যেমন, রাস্তা তৈরি, জমি সমতল করা, খাল-পুকুর কাটা, বাগান তৈরি ইত্যাদি। প্রথম দিকে সে ভাবে মহিলা শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিল না, কারণ যে মেয়েদের চাষের কাজের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের পক্ষেও মাটি কাটার কাজ বেশ কষ্টকর। তাঁদের কাজে নামাতে বেশ উদ্যোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু এক বার তাঁরা কাজ শুরু করার পর কাজের ধারা আজও অব্যাহত। মণ্ডলপাড়া সংসদের মতো কিছু কিছু এলাকায় মেয়েরা এত সংগঠিত যে, গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁরা কাজ আদায় করতেও পারছেন। কোভিড-পরবর্তী লকডাউনের সময়েও তাঁরা ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত কাজ পেয়েছেন। যেখানে মেয়েরা শক্তি প্রদর্শন করতে পেরেছেন, সেখানেই বেশি কাজ আদায় করেছেন।
কিন্তু কাজ করেও সব সময়ে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। বাগদা ব্লকের বাগদা গ্রাম পঞ্চায়েতের মেয়েদের অভিযোগ, তাঁরা ২০১৯ সালে ব্লক অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে ১৯ দিন কাজ করে এখনও পর্যন্ত এক টাকাও মজুরি পাননি। কেন এমন হচ্ছে? হতে পারে তার কারণ, এ ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে ৪(ক) ফর্ম পূরণ করা হয়নি। জব কার্ডেও কাজের উল্লেখ নেই। গত বছরও বাগদার পঞ্চাশ জন মহিলা শ্রমিক এমন ভাবেই মজুরি না পাওয়ার অভিযোগ করেছিলেন একটি জনসভায়। দোষটা ওই মেয়েদের নয়। কাজের আবেদনপত্র যথাযথ ভাবে জমা নিয়ে কাজ দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতই অনুসরণ করে না। কাজ দেওয়াটা গ্রাম পঞ্চায়েতের মর্জিমাফিক, দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বোঝানোর পর আবেদন জমা নিলেও তার প্রতিলিপি স্বাক্ষর করতে চায় না। “আবেদন রেখে যান, কাজ এলে দেব”— এমন কথা বলাই যেন আজ গ্রাম পঞ্চায়েতগুলোর রেওয়াজ। কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেওয়ার বাধ্যতা এড়াতে এই কৌশল নিচ্ছে পঞ্চায়েত। এ নিয়ে অভিযোগ করেও শ্রমিকরা সুফল পাননি।
আর একটা মস্ত অনিয়ম দেখা যাচ্ছে মেয়েদের মজুরির ক্ষেত্রে। আইনত একশো দিনের কাজে পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকের মজুরিতে পার্থক্য থাকতে পারে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, এক একটি ব্লকে পুরুষরা দৈনিক ২১৩ টাকা হারে মজুরি পেলেও মেয়েরা পাচ্ছেন না। তাঁদের মজুরি দাঁড়ায় দৈনিক চল্লিশ টাকা থেকে দেড়শো টাকার মাঝামাঝি কোথাও। মেয়েদের জন্য দৈনিক মাটি কাটার মাপ নির্দিষ্ট করা রয়েছে বাষট্টি বর্গফুট— কিন্তু অপুষ্ট, দুর্বল মেয়েদের অনেকে সাত-আট ঘণ্টা কাজ করেও মাথাপিছু সেই পরিমাণ মাটি কেটে উঠতে পারেন না। গাইঘাটা ব্লকের অন্তত চারশো মহিলা কাজের মাপে খামতির জন্য নিয়মিত কম মজুরি পাচ্ছেন। অথচ, মেয়েরা কাজ করছেন কি না, দেখার দায়িত্ব সুপারভাইজ়ারের। তিনি প্রতি দিন আধ ঘণ্টা-এক ঘণ্টা থেকেই চলে যান, তবু দক্ষ শ্রমিকের জন্য নির্ধারিত হারে মজুরি পান।
এমন ‘কঠোরতা’ সর্বত্র নেই— উত্তর চব্বিশ পরগনারই বসিরহাট, বারাসতের কদম্বগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতে মেয়েদের উপস্থিতি ও কাজের সময় দেখে পূর্ণ মজুরি দেওয়া হয়। অথচ, বাগদা, বনগাঁ, গাইঘাটা, যে সব জায়গায় অনেক মেয়ে একশো দিনের কাজের উপর নির্ভরশীল, সেখানে সামান্য টাকা পেয়ে মুখ বুজে থাকতে হয় মেয়েদের।
মেয়েদের কাজে ঘণ্টার ভিত্তিতে কেন টাকা দেওয়া হবে না? কেন তাঁদের শ্রমের অবমূল্যায়ন করবে পঞ্চায়েত? কেউ বলতে পারেন, সরকার টাকা দিতে গেলে কাজের মূল্যায়ন তো করবেই। প্রশ্ন করা প্রয়োজন, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এমন কঠোর মূল্যায়ন করা হয় তো? সে দিনই ব্লক অফিসে গিয়েছিলাম একটি কাজে। দেখলাম, অফিস প্রায় ফাঁকা, তিন-চার জন কর্মী মুখের সামনে মোবাইল নিয়ে বসে আছেন। সব কড়াকড়ি কি দরিদ্র, শ্রমজীবী মেয়েদের জন্য?