বিষাক্ত কুয়াশার মতো ভয়
Rampurhat

পরিস্থিতি ‘অশান্ত’, তাই বগটুই গ্রামে গেল না মহিলা কমিশন

কী আশ্চর্য! মহিলা কমিশনই যদি অশান্তি দেখে গ্রামে না যায়, তা হলে মেয়েরা গ্রামে থাকবে কোন সাহসে?

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২২ ০৬:০৮
Share:

সুরক্ষিত? রাজনীতির লোক আসছেন বলে ত্রস্ত গ্রামবাসীদের ভিড়, বগটুই, ২২ মার্চ। পিটিআই

একেই বলে পোড়া কপাল। সোমবার বগটুই গ্রামে পুড়ে মরল সাত জন মেয়ে, কিন্তু রাজ্য মহিলা কমিশনের বারো জন সদস্যের কেউ পা রাখলেন না গ্রামে। শনিবার, অর্থাৎ ঘটনার পাঁচ দিন পর, একটি দল রওনা দিয়েছিল বটে, কিন্তু ফিরে এসেছে বর্ধমান থেকে। উকিল নাকি পরামর্শ দিয়েছেন, সিবিআই তদন্ত করছে, তাই কমিশনের যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু তার আগেই তো বগটুই গিয়েছিল নানা বিরোধী দল, অসরকারি সংগঠন, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীও গেলেন। কমিশন গেল না কেন? “পরিস্থিতি অশান্ত ছিল,” বললেন চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়।

Advertisement

কী আশ্চর্য! মহিলা কমিশনই যদি অশান্তি দেখে গ্রামে না যায়, তা হলে মেয়েরা গ্রামে থাকবে কোন সাহসে? কে তা হলে গ্রামে গিয়ে বলবে, “আমরা থাকতে কারও সাহস হবে না মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার, নাগরিকের অধিকারে হাত দেওয়ার”? নাগরিকের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার জন্যই তো তৈরি হয়েছে মহিলা কমিশন, মানবাধিকার কমিশন। এ রাজ্যে শেষেরটি অবশ্য মাস দুয়েক হল ‘নেই’ হয়ে আছে— চেয়ারম্যান এবং আর এক সদস্যের পদ শূন্য, অবশিষ্ট একমাত্র সদস্যের তদন্তকারী দল পাঠানোর ক্ষমতা নেই। আর মহিলা কমিশন? লীনাদেবী জানালেন, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি গ্রহণ করে পুলিশের রিপোর্ট চেয়েছেন তিনি। রিপোর্ট হাতে পেতে লাগবে পনেরো দিন।

এক রাজনৈতিক ব্যক্তি খুন হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে যে গ্রামে সাত-আটটা বাড়িতে আগুন জ্বলে যায়, সে গ্রামে ঘটনার পরবর্তী পনেরো দিনে কী কী ঘটতে পারে, আন্দাজ করা কঠিন নয়। আর বগটুইতে তো মারধর-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় একাধিক পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধেই তদন্ত হচ্ছে। পুলিশের ভরসায় কমিশন-কর্ত্রীরা কলকাতার অফিসে বসে থাকতে পারেন, মেয়েরা গ্রামে থাকবে কোন সাহসে? তারা পালিয়েছে। চেনা নকশা— রাজনৈতিক সংঘাতের পর পুরুষশূন্য গ্রামে মেয়েদের উপর দুষ্কৃতীদের হামলা, অতঃপর কিছু মেয়ের জগৎ থেকে বিদায়, বাকিরা গ্রামছাড়া। যে মেয়েরা স্বামী-শ্বশুরকে পালাতে দেখেও পরিবারের বৃদ্ধ-শিশু, ছাগল-গরুর প্রতি মমতায় ঘর ছাড়তে পারে না, তারাই তো নির্মম আক্রমণের সব চাইতে সহজ শিকার। ওদের জন্যই মহিলা থানা, মহিলা কোর্ট, মহিলা কমিশন। তবু কেউ ছুটে গেল না বগটুইয়ের মৃত, আর জীবন্মৃত মেয়েদের কাছে। রাজ্য মহিলা কমিশন কি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের কোনও সদস্য এটুকুও সংবাদমাধ্যমে, বা সমাজমাধ্যমে বলেননি যে, এই হত্যা রাজ্যের লজ্জা। ওই মেয়েরা যাতে নিজের ঘরে সুরক্ষিত থাকতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

Advertisement

মহিলা কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আগেও, পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে বার বার। রিজওয়ানুরের অপমৃত্যুর ঘটনার পরে যশোধরা বাগচী, নন্দীগ্রামে ‘সূর্যোদয়’-এর পরে মালিনী ভট্টাচার্য সমালোচিত হয়েছিলেন তাঁদের বক্তব্য, বিবৃতির জন্য। তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল প্রকাশ্য সভায় মেয়েদের উপর নির্যাতনের হুমকি দিলে সুনন্দা মুখোপাধ্যায় কেবলমাত্র যথাস্থানে ‘উদ্বেগ’ জানানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন, প্রকাশ্য নিন্দা করেননি। তা বলে নীরব সাক্ষীতে পর্যবসিত হয়েছে কমিশন, এমন নয়। ২০১৩ সালে একটি জাতীয় রিপোর্টে বাংলায় নারীহিংসার উচ্চহার মেলে। সুনন্দা খোলাখুলি বলেন, এ রাজ্যে পুলিশ মেয়েদের অভিযোগ নিতে চায় না। ২০১৪ সালে বিধাননগর পুলিশ মেয়েদের সুরক্ষার জন্য শালীন পোশাক পরার নির্দেশ দিলে তাকে ‘মধ্যযুগীয় পরামর্শ’ বলেছিলেন তিনি, পুলিশ ওই মন্তব্য সরিয়ে দিয়েছিল ওয়েবসাইট থেকে। ২০১৭ সালেও পার্ক স্ট্রিটের বার-রেস্তরাঁয় মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব নিয়ে তিনি বিদ্ধ করেন প্রশাসনকে। অর্থাৎ সঠিক পথে সরকারকে চালিত করার অঙ্কুশটি প্রকাশ্যে হাতে রেখেছিল কমিশন, যতই মৃদু আঘাত করুক।

আজ সেই অঙ্কুশ কই? ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন, এবং এ বছর পুরসভা নির্বাচনে মহিলা প্রার্থী ও এজেন্টদের উপর যে ভাবে রাজনৈতিক আক্রমণ হয়েছে, রাজ্যের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। এর কী তদন্ত করেছে, কী রিপোর্ট দিয়েছে মহিলা কমিশন, কী সুপারিশ করেছে, কেউ তা জানে না। লীনাদেবী সরকারের সমালোচনা করে একটি বাক্যও কখনও প্রকাশ্যে বলেননি। “নীরবে কাজ করলে ক্ষতি কী?” প্রশ্ন করলেন তিনি। শুনে এক বামপন্থী ছাত্রনেত্রীর প্রশ্ন, “নীরব থাকলে বুঝব কী করে উনি কোন পক্ষে কাজ করছেন, মার-খাওয়া মেয়েদের পক্ষে, না কি পুলিশে-শাসক দলের পক্ষে?”

বিরোধীরা খোঁচা দেন, রাজ্যে মহিলা কমিশন বলে কিছু কি আছে? কমিশন অচল, এমন নয়, রুটিন-বাঁধা কাজগুলো কমিশন করে চলেছে। প্রশিক্ষণ, আলোচনা, পারিবারিক হিংসায় বিধ্বস্তদের সহায়তা, অ্যাসিড আক্রান্তদের পুনর্বাসন, সবই হচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের উপর আঘাত নেমে এলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, ভয়ে বোবা হয়ে-যাওয়া মানুষের কণ্ঠ হয়ে ওঠা, পুলিশ-প্রশাসনের ঔদ্ধত্যে রাশ টানা— এ সব কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রকাশ্যে যে হিংসা হয়, তার প্রতিকারের দাবি কি আড়ালে হতে পারে?

তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে বর্ধমানে কিশোরী তুহিনা খাতুন আত্মহত্যা করেছে, রামপুরহাটে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরেছে ঘরবন্দি মেয়ে-শিশু, এই নৃশংসতার সামনে রিপোর্ট তলব আর রিপোর্ট জমা দেওয়ার আমলাতান্ত্রিকতা অসার নিয়মরক্ষা বলে মনে হতে বাধ্য। অভিযোগ উঠছে, নামেই স্বতন্ত্র কমিশন, কাজে স্বজনপোষণের আখড়া, ওদের হাতে অঙ্কুশ তো নয়, পিঠ চুলকানোর কাঠি।

হয়তো এমন সন্দেহ ন্যায্য নয়। হয়তো মহিলা কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের সদস্যরা বিবেকবান, সত্যসন্ধানী, দায়িত্বশীল। তবু তাঁরা কর্তব্যচ্যুতির দায় এড়াতে পারবেন না। কুশমান্ডি থেকে বগটুই, সর্বত্র নারীহিংসার পরেই প্রভাবশালী পক্ষ একটা মিথ্যা বয়ান জোর করে চালানোর চেষ্টা করে। আক্রান্তদের এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়, পাড়া-পড়শিদের হুমকি দিয়ে চুপ করানো হয়। সাংবাদিকদের এলাকায় ঢুকতে বাধা দেওয়া, ‘বিরোধী’ বলে তাড়া করা, প্রতিবাদীদের গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা, সবই চলতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত ঘটনা সর্বসমক্ষে আনার সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতা রয়েছে যাদের, তারা হল মহিলা কমিশন, মানবাধিকার কমিশন। নাগরিক সুরক্ষিত কি না, রাষ্ট্র কর্তব্য করছে কি না, তা সকলকে জানানোই কমিশনের কাজ। নীরব থেকে কমিশন সে দায় এড়াচ্ছে। আইনি সুরক্ষার বর্ম পেয়েও লড়াই করে না, এমনই রক্ষী জুটেছে এ রাজ্যের মেয়েদের।

ভয় ছড়াচ্ছে বিষাক্ত কুয়াশার মতো। অনুদান বন্ধের ভয়, ‘ফান্ডিং’ হারানোর ভয়, চাকরি যাওয়ার, মারধর-হত্যার ভয় সকলের বুকের রক্ত, মুখের কথা শুষে নিচ্ছে। আট জন নিরপরাধ, নির্বিবাদী মহিলার দগ্ধ দেহের সামনে দাঁড়িয়েও কলকাতার প্রধান নারী অধিকার সংগঠনগুলি একযোগে প্রতিবাদ করতে পারেনি। এক অসরকারি সংস্থার কর্তা সব শিশু অধিকার সংগঠনের কাছে প্রস্তাব রাখেন, বগটুইয়ে দগ্ধ শিশুর জন্য বিচার দাবি করে চিঠি লেখা হোক। কেউ রাজি হয়নি, উল্টে তাঁকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। “বন্ডেড লেবার নিয়ে কাজ করি, মনে হচ্ছে আমরাই বন্ডেড লেবার,” বললেন তিনি। গণতন্ত্রে নাগরিকের এই দাসত্বের দায় কি মহিলা কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এড়াতে পারে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement