দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাট থানার খনকার বাজার এলাকার এক অপহৃত নাবালিকাকে পুলিশ উদ্ধার করে ৭ মে, ২০২২। ডায়মন্ড হারবার আদালতে বালিকাটি জবানবন্দি দেয়, জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম। কিন্তু এমন কত হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের ঘটনা খবরে প্রকাশিত হচ্ছে না, কে বলতে পারে? তেমনই এক জন বহরমপুরের শম্পা দাস (নাম পরিবর্তিত)। একমাত্র কন্যাসন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিল বছর চব্বিশের শম্পা, তাই ভাল কাজের সন্ধান করত সে। এক দিন দুপুরবেলা সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল শম্পা। খোঁজাখুঁজি, থানা-পুলিশ সবই হয়েছে। সন্ধান মেলেনি এখনও।
একটি অসরকারি সংস্থার রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছর ১০ লক্ষেরও বেশি নারী ও শিশু পাচার হয় এ দেশে। শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতা, আসানসোল, শিলিগুড়ি ও হাওড়া পাচারের বড় কেন্দ্র। দুই ২৪ পরগনা, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদের মতো জেলা থেকে মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে নারী-শিশুদের বড় বড় শহরে নিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা। পাচার হওয়া দুই-তৃতীয়াংশ শিশুই বালিকা। এদের ৯০ শতাংশ ড্রপ আউট, বা কখনও স্কুলে যায়নি।
কাজ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, বা বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে মেয়েদের পাচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মনিরুলকে গুজরাতের সুরাতে গ্রেফতার করা হয়। বিয়েকে হাতিয়ার করে সে ২০০টি মেয়ে পাচার করেছে। অসমের কোকরাঝাড়ের বাসিন্দা সফিউল ইসলাম কলকাতার সোনারপুরে শতাধিক মেয়েকে পাচার করেছে। এ সবই সংবাদে প্রকাশিত। অথচ, পাচারে অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও শাস্তির সংখ্যা খুব কম। গত ২০ এপ্রিল মুর্শিদাবাদে একটি প্রশাসনিক মিটিংয়ে জেলা পুলিশ নারী পাচারের রিপোর্ট পেশ করে। তাতে বলা হয়, ২০২১ সালে এক জন মাত্র নারী পাচার হয়েছে সেই জেলা থেকে। সকলে হতবাক! ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৩৫৫৯ জন পাচার হয়েছিল রাজ্যে। অতিমারির মধ্যে একটি পাচার-প্রবণ জেলায় পাচারের সংখ্যা এত কমতে পারে কী করে?
পাচারের অগণিত ঘটনা রোজ ঘটে চলেছে প্রবল নারীহিংসার আবহে। হাঁসখালি, দুবরাজপুর, কাকদ্বীপ, জলপাইগুড়ি, উত্তর ২৪ পরগনা, বহরমপুরে পরপর নৃশংস ঘটনাগুলি তার সাক্ষী। ধর্ষণের ঘটনায় ভারতে পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয় স্থানে, বলছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো ২০২১ ডিসেম্বর। ২০১৯-এর ভারতে প্রতি ১৬ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ‘ধর্ষণ গেম’, সাইবার পর্নোগ্রাফিতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চলছে। একটি শব্দ মুখে মুখে ঘোরে, ‘সেক্স ইন্ডাস্ট্রি’। অন্য পণ্যের মতো নারীকে তবে ভোগ্যপণ্যের মতোই দেখা যেতে পারে? সরকারের নীরবতা অপরাধের পৃষ্ঠপোষকতারই নামান্তর নয় কি?
অস্ত্র ও মাদক পাচারের মতোই লাভজনক ব্যবসা শিশু ও নারী পাচার। পাচারের কঠিন ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন হয়ে ওঠে মেয়েদের পক্ষে, নিজের পরিবারে পুনর্বাসন তো প্রায় অসম্ভব। পাচারকারীদের এই বিস্তৃত জাল পুলিশ-প্রশাসনের নজর এড়িয়ে চলতে পারে না। পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগ থাকার কারণেই পাচার রোধে আইন থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয় না।
কেন এত সহজে পাচারের শিকার হচ্ছে এত মেয়ে? বছরখানেক আগে উত্তর ২৪ পরগনার রহিমাকে তালাক দিয়েছিল স্বামী। নিরাশ্রয়, সর্বস্বান্ত রহিমা কাজের সন্ধানে হারিয়ে গেল। থানায় অভিযোগ দায়ের করা গেল না, স্বেচ্ছায় কাজ করতে গিয়েছে বলে। বেশির ভাগ পাচার হওয়া মেয়েদের থানায় নাম নথিভুক্ত হচ্ছে না এই কারণে। সরকার-প্রচারিত উন্নয়নের উজ্জ্বল আলোর পাশেই চলছে অন্ধকারের চোরাস্রোত। কয়েক বছর আগে মুর্শিদাবাদের রানিনগরের বাইশ বছরের ফরিদা শিশুকন্যা নিয়ে হঠাৎ বিধবা হয়। ফরিদার শ্বশুর জীবিত থাকায় মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধানে ফরিদা ও তার সন্তান সম্পত্তির অংশ পেল না, তাদের শ্বশুরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হল। হতদরিদ্র পিতার সংসারে ফরিদার স্থান হল না, পাড়ি দিল মুম্বইয়ে। কয়েক বছর হয়ে গেল কোনও খোঁজ মেলেনি তার।
বহুবিবাহ, অবৈধ তালাক, ঘর থেকে বহিষ্কৃত ও বিধবা মেয়েদের সম্পত্তি-বঞ্চনার জন্য মেয়েদের বিপন্নতা বাড়ছে, সহজে পাচারের শিকার হচ্ছে। মুর্শিদাবাদে এমন আর্থিক সহায়হীন নারীর সংখ্যা লক্ষাধিক। অর্থনীতিবিদ সিরাজ ইয়াকুব ও নৃতত্ত্ববিদ বেঙ্গালুরুর আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রীপর্ণা চট্টোপাধ্যায় তাঁদের গবেষণায় বলেছেন, ভারতে এক বছরে তালাক হয়েছে ১৩ লাখ ৬০ হাজার মেয়ের। মুর্শিদাবাদ জেলাতেই তালাকপ্রাপ্ত নারীদের খোরপোষ মামলা চলছে পঞ্চাশ হাজারের মতো। অন্য দিকে, জাতীয় পরিবার সংস্থা সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে বর্তমানে ৩০ শতাংশ মহিলাই গার্হস্থ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অতএব কেবল পাচারের ঘটনার পুলিশি তদন্ত করলে, ও আদালতের সুবিচার নিশ্চিত করলেই হবে না। পাচার প্রতিরোধ করে মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে হলে সম্পূর্ণ সমাজব্যবস্থারই সংস্কার দরকার।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।