অনশনান্তে: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলন করছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। ২১ অক্টোবর। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
আজকের এই দুর্দিনে সুখবর হচ্ছে যে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দু’ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর জুনিয়র চিকিৎসকেরা অনশন প্রত্যাহার করেছেন। ২২ তারিখ থেকে সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাকও তুলে নিয়েছেন চিকিৎসকরা। বঙ্গবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। আর জি কর-কাণ্ডে ন্যায়বিচারের দাবিতে তাঁদের কর্মবিরতি, বিক্ষোভ, ধর্না ও আন্দোলন চলছিল শারদোৎসবের মধ্যেও। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাতে যোগ দিয়ে সমর্থন করেছেন সাধারণ মানুষ। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের নিস্পৃহতা এবং সামর্থ্যহীনতা এই তরুণ চিকিৎসকদের বাধ্য করেছিল নিজেদের জীবন বাজি রেখে এমন সুকঠিন আন্দোলনের পথে হাঁটতে।
বহু মানুষ, এমনকি অভয়ার পিতা-মাতাও জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন ভাঙতে বারংবার অনুরোধ করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী অনশনের কষ্ট বোঝেন, উনি নিজে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে, সিঙ্গুরে কৃষকদের সম্মতি ছাড়াই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৬ দিন অনশন চালিয়ে গিয়েছিলেন। উনি অনশন ভেঙেছিলেন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের অনুরোধে। এ বার মুখ্যমন্ত্রীও একাধিক বার জুনিয়রদের অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে দশ দফা দাবি মেনে নিতে বলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী সব ক’টি মানতে রাজি হননি। দীর্ঘ ১৭ দিন অনশন চলার পর যে কারণেই হোক তা যে শেষ হল, তাতে রাজ্যবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।
অভয়া-কাণ্ডের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবায়, বিশেষত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দৃঢ়মূল ও বহু দূর প্রসারিত দুর্নীতির সংযোগের ইঙ্গিত উঠেছে। অনেক দাবির একটি, যেটি মুখ্যমন্ত্রী মানতে সম্মত হননি, ছিল স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের অপসারণ। এক জন উচ্চপদস্থ আমলা— যাঁর বহু দিনের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য বিভাগে অনেক দুর্নীতি এবং অপশাসনের অভিযোগ উঠেছে— তিনি নিজে যদি এ সবের ঊর্ধ্বেও হন, তবু তাঁকে বরখাস্ত নয়, এমনকি বদলি করতেও এত আপত্তি কেন, সেই রহস্যটি এখনও অমীমাংসিত।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ১৭ জন জুনিয়র ডাক্তারের সাক্ষাৎকারের লাইভ সম্প্রচার দেখে বঙ্গবাসীর প্রত্যাশা যে, এ বার অভয়া সুবিচার পাবেন এবং সরকারি বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবার স্থায়ী উন্নয়ন হবে। অনিশ্চয়তার কিছু কারণ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। প্রথমত, জুনিয়রদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বাদানুবাদে এ কথা মনে হতেই পারে যে, দু’পক্ষ অনেক ব্যাপারেই সহমত নন। এক জন আন্দোলনকারী চিকিৎসক বলেছেন যে, সরকার পক্ষ অনেক আশ্বাস দিলেও ওঁদের শরীরী ভাষা সদর্থক ছিল না। দ্বিতীয়ত, ডাক্তারদের দাবি শুধু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের মাধ্যমে পূরণ হবে না, তার জন্য সরকারি স্বাস্থ্য প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে, এবং প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। সেই সদিচ্ছা এবং সামর্থ্য কি এই সরকারের আছে? তৃতীয়ত, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় দীর্ঘ দিন ধরে পুষে রাখা দুর্নীতি ও অপশাসনের বিষাক্ত সাপকে তাড়াতে গেলে সেই কালকেউটের মরণ কামড় ভয়ঙ্কর হবে না তো? কেউ যদি বলেন যে, গোটা আন্দোলন-পর্বে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা নেহাতই দায়সারা এবং সোমবারের বৈঠকেও তিনি সেই ভঙ্গি থেকে বেরিয়ে সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হলেন না, তবে কি সেটা খুব ভুল হবে?
দেশের শীর্ষ আদালতের তত্ত্বাবধানে এখন সিবিআই তদন্ত করছে। এ বিষয়ে বেশি কিছু বলা অবিধেয়। তবে এটুকু তো বলাই যায় যে, কলকাতা পুলিশের এক সময় তুল্যমান ছিল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। সেই কলকাতা পুলিশের এই দুরবস্থা কেন যে, তদন্ত সিবিআইকে দিতে হল? এটাও কি মুখ্যমন্ত্রীর দায়সারা ভঙ্গিরই পরিণতি?
এ প্রসঙ্গে একটা অন্য কথা বলি। গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়ায় বন্যা হল। অনতিবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে, রাজ্য সরকারকে সতর্ক না করেই ডিভিসি অত্যধিক জল ছেড়েছে, ফলে এই বন্যা পরিস্থিতি। পরে জানা গেল যে, ডিভিসি জল ছাড়ে একটি জলাধার নিয়ন্ত্রণ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে এবং সেই কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়াররা আছেন। প্রত্যেকটি বাঁধের নির্ধারিত জলধারণ ক্ষমতা থাকে। সেই ধারণসীমার অতিরিক্ত জল হলে, বাঁধ ভাঙার ভয় থাকে। জল ছাড়া ভিন্ন কোনও উপায় থাকে না। জলাধার নিয়ন্ত্রণ কমিটি এ বিষয়ে বিচার বিবেচনা করে জল ছাড়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। সেপ্টেম্বর মাসে জল ছাড়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের চিফ ইঞ্জিনিয়ারদের এবং পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার জেলা শাসকদের সতর্কবাণী পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা কি মুখ্যমন্ত্রীকে জল ছাড়ার খবর ঠিক ভাবে দেননি? স্থায়ী ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্র এবং ঝাড়খণ্ড সরকার ছাড়া রাজ্য সরকার গত ১৩ বছরে কী করেছে, সে কথা জানা গেল না। দায়সারা কিছু কথা বলার বাইরে আর কিছু করেছে কি?
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ময়দানে এই দায়সারা ব্যাপারটির বহুল প্রচলন। প্রচুর বৃষ্টিপাতে বহু জেলা বানভাসি হলে, তার দায়িত্ব অন্যান্য রাজ্যের এবং কেন্দ্র সরকারের— আমাদের কিছু করণীয় নেই। তরুণী চিকিৎসক ধর্ষিত ও খুন হলে দায়িত্ব যে খুন ও ধর্ষণ করেছে তার বা তাদের একার। পরীক্ষার খাতার মূল্যায়নে বা চাকরির নিয়োগে দুর্নীতির সাক্ষ্যপ্রমাণ হাতেনাতে মিললেও তার দায়িত্ব বেশি উপর অবধি পৌঁছয় না। রাজ্যবাসী প্রশ্ন করতেই পারেন যে, রাজ্যে ঘটে চলা যাবতীয় অনিয়ম-অনাচারের দায় কি শেষ পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্য প্রশাসকেরই নেওয়ার কথা ছিল না?
শোনা যায়, আমেরিকায় ‘পোকার’ খেলার সময়, যার তাস বাঁটার কথা, তার সামনে ‘বাক’ বা হরিণের শিং দিয়ে তৈরি একটি ছুরি রাখা হত। নির্দিষ্ট খেলোয়াড় সেই দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে চাইলে ‘বাক’টিকে সেই অন্য লোকটির সামনে সরিয়ে দিতে হত। অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার জনপ্রিয় প্রথাকে বিদ্রুপ করে বলা হয় ‘পাসিং দ্য বাক’। আমেরিকার ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের টেবিলে অনেক সময় ‘দ্য বাক স্টপস হিয়ার’ লেখা একটি ফলক থাকত। মানে, এখানেই দায়বদ্ধতার শেষ ধাপ। ট্রুম্যানের শাসনকাল বিতর্কিত— হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ, কোরিয়ার যুদ্ধ, দুর্নীতির অভিযোগ এবং জোসেফ ম্যাকার্থির বাম-নিগ্রহ। ট্রুম্যানের জনপ্রিয়তাও ক্রমে হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু সেই ‘দ্য বাক স্টপস হিয়ার’ লেখা ফলকটি অমর হয়ে রয়েছে।
দায়িত্ব নেওয়ার উদাহরণ কিন্তু ভারতেও আছে। ১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন মাদ্রাজ প্রদেশে আরিয়ালুর রেল-দুর্ঘটনার সময় লালবাহাদুর শাস্ত্রী ছিলেন রেলমন্ত্রী। রেলগাড়ি উনি চালাতেন না, সিগন্যালও উনি দিতেন না, কিন্তু উনি ছিলেন রেলের শীর্ষে। তাই দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিয়ে শাস্ত্রীজি পদত্যাগ করেন। সম্প্রতি ভারতে এই ধরনের দায়বদ্ধতা বিরল। এটা কি রাজনীতির ‘পরিপক্বতা’র প্রতিফলন? না কি নির্বাচনে নেতাদের সামগ্রিক ব্যবহারের প্রতি ভোটদাতাদের উদাসীনতা? তাই কি, কোনও আইন অনুযায়ী স্বীকৃত অপরাধের পরে অভিযুক্ত নেতারা বা তাঁদের দলের কর্তারা আইনি আদালতে না গিয়ে জনতার আদালতে যেতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
সংবিধানের ১৬৪ ধারা অনুযায়ী রাজ্যের মন্ত্রিসভা সমবেত ভাবে তাঁদের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য রাজ্যের বিধানসভার প্রতি দায়বদ্ধ। কিন্তু এই সমবেত দায়বদ্ধতার কোনও ইঙ্গিত আমরা সাম্প্রতিক কালে পাইনি। জনপ্রিয় সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীরা দলীয় প্রার্থীর জন্য ভোট চাইতে গিয়ে বলেন যে, প্রার্থীরা সব নিমিত্তমাত্র— জনতা যেন ভোট দেন নেতা বা নেত্রীর মুখ চেয়ে। মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ও সেই শীর্ষ নেতা বা নেত্রীই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ঠিক করেন, কে কোন দফতরের মন্ত্রী হবেন। কিন্তু ছোটখাটো নয়, কোন ঘোরতর ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলেও, দায়িত্ব বর্তায় বড় জোর মন্ত্রীর উপরে— মন্ত্রিসভা বা মুখ্যমন্ত্রীর উপরে নয়। সংবিধানের ১৬৪ ধারা কি আমরা ভুলে গেছি? এতেও কি আমাদের দায়সারা মনোভাব?