আরজি করে চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় কলকাতার রাজপথে বিক্ষোভ।
দিন কয়েক আগে রাজ্যের এক প্রশাসনিক ভবনে রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ এক আধিকারিক অনামিকা গুপ্ত (নাম পরিবর্তিত) আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন, ‘‘কাজের প্রয়োজনে রাত ৮টা পর্যন্ত এই অফিসে প্রায়ই থেকে যেতে হয়। চারদিক যখন প্রায় জনশূন্য ছিল, সেই কোভিডের সময়েও অনেক রাত অবধি অফিসে থাকতে হয়েছে। কখনও মনের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ দেখা দেয়নি। কিন্তু এখন সত্যিই ভয় পাচ্ছি। বিপন্ন বোধ করছি।’’
এই বিপন্নতার মূলে রয়েছে প্রশাসন যে নিরাপত্তা দিতে পারে, সেই আস্থা বা ভরসা হারিয়ে ফেলা। ওই আধিকারিকের কণ্ঠস্বরে বিপন্নতার আর ভয়ের অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ এবং তীব্র রাগও ফুটে উঠতে দেখলাম!
মানুষ খুব রেগে আছে। সারা ভারতেই সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গে সেই রাগ যেন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের চেহারা নিয়েছে।
প্রতিবাদ। আরজি কর কাণ্ড নিয়ে বিক্ষোভ কলকাতার রাস্তায়।
কার উপর এই রাগ?
এ-প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে যুক্ত, তাদের উপর। যাঁরা এই নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা চাপা দিতে বা অপরাধীদের আড়াল করতে চাইছেন, তাঁদের উপর। এ যাবৎ জীবনের বিভিন্ন পর্বে যারা কোনও না কোনও ভাবে নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী, তাদের উপর তথা সামগ্রিক ভাবে সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্যের জন্য দায়ী পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর।
১৯৭৭ ইংল্যান্ডের লিডস্ শহরে নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের উদ্যোগে ‘রিক্লেম দ্য নাইট’ আন্দোলনের মতোই আমাদের এখানে সমাজমাধ্যমে ১৪ অগস্ট ডাক দেওয়া হল ‘মেয়েরা, রাত দখল করো’। সেই ডাকে যেন নতুন এক ‘অগস্ট আন্দোলন’-এর ইতিহাস রচিত হল সে রাতে। এ রাজ্যের প্রায় প্রতিটি শহর-মফস্সল-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ল সেই ডাক। বিভিন্ন বয়সি মেয়েরা জড়ো হতে শুরু করলেন। সঙ্গী হলেন পুরুষরাও। মফস্সল শহরগুলোতেও জমায়েত কমপক্ষে হাজার দশেক ছাড়িয়ে গেল। এ রাজ্যের গণ্ডি অতিক্রম করে প্রতিবাদের ‘রাত দখল’ ভারতের বহু শহরে ছড়িয়ে পড়ল। রাজ্য সরকারের ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর নানা ‘উদ্যোগ’ আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করল। মানুষের রাগ বাড়তে শুরু করল। ক্রুদ্ধ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণে আন্দোলনের বহুমাত্রিক ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ল। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সেই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ এখন আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে।
এর আগেও নারীর উপর যৌন নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা এই রাজ্য তথা এই দেশে অনেক ঘটেছে। কিন্তু কখনওই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এমন সর্বজনীন রূপ পায়নি। এ ক্ষেত্রে জনমানসে এই সর্বব্যাপী তীব্র ক্ষোভের ভিসুভিয়াস-সম উদ্গিরণের নেপথ্যে কী রয়েছে? এ প্রশ্ন অনেকের মনেই দেখা দিতে শুরু করেছে। এমনকি, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দিশেহারা শাসকদলের নেতা-নেত্রীরাও একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন। মাত্র কয়েক মাস আগেও লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যের শাসকদল যে বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে, সেই দলের বিরুদ্ধেই জনমানসের এমন স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ তাঁদের কাছে আশ্চর্যের মনে হচ্ছে!
এই স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণের নেপথ্যে যে আবেগ বা প্রক্ষোভ রয়েছে, তা হল দীর্ঘ দিনের সঞ্চিত পুঞ্জীভূত রাগ। রাগ কী কারণে হয়? সাধারণত রাগের নেপথ্যে থাকে অপূর্ণ প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার ফলে দেখা দেয় হতাশা। আর সেই হতাশা থেকেই জন্ম নেয় রাগ বা ক্রোধ।
আরজি কর-কাণ্ডে বিচারের দাবিতে সরব জনতা।
২০১১ সালে বর্তমান শাসকদল এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে তাঁদের ভূমিকার নির্মোহ মূল্যায়ন যদি করা যায়, তা হলে হয়তো এই উপলব্ধিতে আমরা পৌঁছব যে, এই পরিণতি আজ হোক বা কাল অবধারিত ছিল। চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের পর রাজ্যের মানুষ বেছে নিয়েছিলেন এক প্রতিবাদী মুখকে, যিনি অকুতোভয়ে সরকারের যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতেন। মাথায় লাঠির আঘাতও তাঁকে দমাতে পারেনি। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই যখন ক্ষমতায় এলেন, তখন তার কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর পরিবর্তন ধরা পড়তে শুরু করল। নোনাডাঙা বস্তি উচ্ছেদ দিয়ে শুরু হল সেই পরিবর্তন। শাসকের সমস্ত অন্যায়-অবিচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন তিনি পূর্ববর্তী শাসকের মতোই। নারীর উপর ঘটে চলা একের পর এক যৌনহিংসার ঘটনার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দেখলেন রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে কখনও বলা হল, ‘সামান্য ঘটনা’, কখনও ‘তুচ্ছ ঘটনা’, কখনও আবার ‘সাজানো ঘটনা’ কিংবা ‘এ সব ষড়যন্ত্র’। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতাকেই প্রকারান্তরে দায়ী করা হল। তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার তাঁর সক্রিয়তার ‘পুরস্কার’ পেলেন তুলনামূলক কম দায়িত্বের পদে বদলি হয়ে। প্রতিবাদী শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস হত্যা, বামনগাছির প্রতিবাদী যুবককে হত্যা, কামদুনি, গাইঘাটা, মধ্যমগ্রাম, কাঁথি। একের পর এক নারীর উপর যৌনহিংসার ঘটনায় অপরাধীকে চিহ্নিত করে যথাযথ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার পরিবর্তে অপরাধীদের আড়াল করে প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধেই পুলিশের সক্রিয় হওয়ার অভিযোগ উঠেছে বারংবার! মানুষ প্রতারিত বোধ করেছেন সরকারের ভূমিকায়।
পাশাপাশি, আমরা দেখলাম এই সরকারের আমলে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিল। প্রশাসনিক দুর্নীতি খুব নতুন নয়। তবে তা মুষ্টিমেয় কিছু নেতা ও প্রশাসকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের রাজ্যে কাঠামোগত দুর্নীতি বাড়তে শুরু করে পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট শাসনের মাঝামাঝি সময়ে। যখন বেছে বেছে শিক্ষাক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে নিজের দলের, নিজের পছন্দের মানুষকে নিয়োগের চল শুরু হয়। এই প্রবণতা একে একে অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা দিতে শুরু করে। রাজ্যে তৃণমূলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই কাঠামোগত দুর্নীতি রাজ্যের সর্ব ক্ষেত্রে, সর্ব স্তরে প্রসারিত হল। উচ্চ পদ থেকে একেবারে নীচের তলায় কর্মপ্রাপ্তির যোগ্যতামান বদলে গেল অলিখিত ভাবে। শিক্ষাগত যোগ্যতার থেকে অন্যতর নানাবিধ ‘যোগ্যতা’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। প্রকৃত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বহু কর্মপ্রার্থী বঞ্চিত হতে থাকলেন সর্বত্র। শিক্ষিত যুবসমাজ চরম হতাশার শিকার হল। শাসকের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করল। আমাকে আমার পেশাগত মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিংয়ের কাজের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই যে হতাশার সাক্ষী হতে হয়।
রাজ্য জুড়ে ক্ষমতাসীন নেতা-নেত্রীদের বিপুল বৈভব সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিতে উৎকট ও অশালীন এক রূপ নিয়ে ধরা দিল। সারদা-নারদা-শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, খাদ্য সরবরাহে দুর্নীতি। এমন অসংখ্য দুর্নীতির তালিকায় মানুষের মনে একটু একটু করে অসন্তোষের মেঘ জমতে শুরু করল। রাজ্যের মানুষ দেখলেন, শাসকদলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-মন্ত্রীরা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জেলে গেলেন। এখনও তাঁরা জেলেই আছেন।
রাজ্যের মানুষ আরও দেখলেন, রাজ্য প্রশাসনের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় এই সব নেতা-নেত্রীর ছত্রছায়ায় সমান্তরাল মস্তানরাজ কায়েম হতে। কোথাও শাজাহান শেখ, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার। কোথাও জায়ান্ট সিং। এমন নানাবিধ নামের সঙ্গে উঠে এল তাদের নানাবিধ কার্যকলাপের কাহিনি। তাদের বিপুল বৈভব ও ক্ষমতার বিবরণ এবং রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্কের কথা।
বরাহনগরে এক কর্মসূচিতে শাসকদলেরই সাংসদ সৌগত রায় বললেন, ‘‘গান গাইতে এসে কেকে-র মৃত্যু হল। আমি শুধু ভাবছি, এত টাকা কোথা থেকে এল! ৩০ লাখ না কি ৫০ লাখ? কত যেন লেগেছে শুনলাম! টাকা তো হাওয়া থেকে আসে না! কলেজের ফেস্টের জন্য এত টাকা দিল কে? এত টাকা খরচ করে মুম্বইয়ের শিল্পী আনার কি খুব দরকার ছিল? এত টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান করতে হলে তো কারও না কারও কাছে ‘সারেন্ডার’ করতে হয়! হয় প্রোমোটার, না হয় এলাকার মস্তান! আর জীবনের প্রথমেই যদি সারেন্ডার করো, তা হলে বাকি জীবন কী করবে?’’ সংবাদমাধ্যমেই জেনেছিলাম, সৌগতবাবুর এই বয়ানে শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্ব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
বছরের পর বছর স্কুলের অভিভাবক সমিতি, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ, লাইব্রেরির পরিচালন সমিতির নির্বাচন বন্ধ। পঞ্চায়েত নির্বাচন কার্যত প্রহসনে রূপান্তরিত হয়েছে বহু জায়গায়। বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচনেও ক্ষমতার আস্ফালন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অনেক কেন্দ্রে দেখেছেন। বিগত লোকসভা নির্বাচনে ডায়মন্ড হারবারে শাসকদল বাম আমলের আরামবাগের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে। এমনকি, এই রাজ্যে চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ-র নির্বাচনও কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কল্যাণে। বিরোধী দলের হয়ে নির্বাচনে জেতার পরেও বহু জন নাম লিখিয়েছেন শাসকদলে। এর নেপথ্য কারণ অনেক ক্ষেত্রেই আর নেপথ্যে থাকেনি।
সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজ্যের শিক্ষা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অধোগতির কারণে এক ধরনের হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হলেন। যে বাঙালির মনন এক সময়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সমীহ আদায় করে নিত, সেই বাঙালি আজ অন্যত্র উপহাসের পাত্রে পরিণত। এই পরিস্থিতির জন্যও রাজ্যের মানুষ অনেক ক্ষেত্রে দায়ী করেছে শাসককেই।
শাসক, তা সে যে দলেরই হোক না কেন, এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, মানুষের স্মৃতি বড় দুর্বল। কোনও ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ভাবে মানুষের মন আলোড়িত হবে, হইচই-হল্লা হবে, মিডিয়ায় প্রচুর লেখালেখি হবে, টিভিতে বিতর্ক হবে। আবার এক সময় সকলেই ভুলতে শুরু করবে। মিডিয়াও তখন নতুন কোনও ঘটনা বা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
আপাত ভাবে তাঁদের ওই ভাবনাই সঠিক বলে মনে হতে পারে। অতীতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথাই ক্রমশ স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ভিড় করছে অন্য অনেক ঘটনা। বদলে যাচ্ছে প্রতিবাদের বিষয়। প্রায় প্রতি দিনই কিছু না-কিছু ঘটে চলেছে। কতটুকুই বা আমাদের ‘মেমরি ব্যাঙ্কে’ জমা হয়! বেশির ভাগই তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হতে থাকে। কিংবা সময়-ধুলোর পরত পড়তে-পড়তে চাপা পড়ে যায় স্মৃতির অতলে। হয়তো ক্রমশ আমাদের স্মৃতি থেকে একদিন হারিয়ে যাবেন এই তরুণী চিকিৎসকও! যেমন হারিয়ে গিয়েছেন বরুণ বিশ্বাস বা রিজওয়ানুর রহমানেরা। ইদের দিনে মুখ্যমন্ত্রী রিজের বাড়িতে উপস্থিত না-হলে আদৌ কি রিজ ফিরে আসতেন আমাদের স্মৃতিতে?
স্মৃতি অনেক সময় হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় স্মৃতির প্রতিবাদী সত্তাও। আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী বোধ হয় সে কারণেই জনগণের স্মৃতির উপর বেশ আস্থাশীল। তাঁরা জানেন, ‘যা-ই করি না কেন, মানুষ ধীরে ধীরে ঠিক ভুলে যাবে।’ মানুষের এই ‘ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা’ নিয়ে তাঁরা এতটাই নিশ্চিত থাকেন যে, একের পর এক মর্মান্তিক, ভয়ঙ্কর ঘটনার পরেও তাঁদের আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে। নিশ্চিন্ত থাকেন তাঁরা। তাই চিহ্নিত সমাজবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-নেত্রীদের আশ্রয় দিতে একটুও অসুবিধা হয় না তাঁদের।
সমাজমন নিয়ে কাজ করতে করতে ঠিক এখানে এসেই থমকে যেতে হয়। তৈরি হয় কিছু প্রশ্ন।
সত্যিই কি মানুষ সব ভুলে যায়? ভুলে যেতে চায়? মর্মান্তিক সব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী যাঁরা অথবা সাক্ষী নন কিন্তু শিহরিত হয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে কোথাও কি ধরা থাকে না অতীতের ক্ষত?
বিক্ষোভে সামিল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও।
খবরে দেখেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল দিল্লিতে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট দিতে। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল চাপা পড়ে থাকা ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যার কথা। সেই সময়ে যে আইএএস আধিকারিক সেই গণহত্যার প্রতিবাদে ইস্তফা দিয়েছিলেন প্রশাসনিক পরিষেবা থেকে, সেই বিশিষ্ট লেখক ও মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দারের লেখা মর্মস্পর্শী সেই প্রতিবেদন ‘কাঁদো প্রিয় মাতৃভূমি’-র ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল। নরেন্দ্র মোদী শাসিত গুজরাতে কয়েক হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যেমন গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন, তেমনই বহু নারী হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকারও হয়েছিলেন। মনে পড়ে গেল বিলকিস বানোর কথা। বিলকিস শুধু ধর্ষণের শিকার হননি, তাঁর সন্তান-সহ পরিবারের বেশ কয়েক জনকে তাঁর সামনেই হত্যা করা হয়েছিল নৃশংস ভাবে। বিলকিসের ধর্ষকদের গুজরাত সরকারের উদ্যোগে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল সাজা শেষ হওয়ার আগেই। স্বাধীনতা দিবসে মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। মনে পড়ে গেল উন্নাওয়ের সেই শিশুকন্যার কথা, যাকে জম্মুর মন্দিরের মধ্যেই ধর্ষণ করা হয়েছিল। সেই ধর্ষকের সমর্থনে ও মুক্তির দাবিতে ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থকেরা জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করেছিলেন। মনে পড়ে গেল হাথরসের সেই গণধর্ষণের ঘটনা। যেখানে ধর্ষক ছিলেন রাজ্যের শাসকদল বিজেপির নেতা। মনে পড়ল কেরলের সেই সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের কথাও, যিনি হাথরসের গণধর্ষণের তথ্যানুসন্ধানের কাজে এসে গ্রেফতার হন। তাঁকে ইউএপিএ বা বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে অভিযুক্ত করা হয়। মনে পড়ে গেল ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রাক্তন প্রধান তথা বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে বিনেশ ফোগাট, সাক্ষী মালিক এবং বজরং পুনিয়ার সাহসী লড়াই, মণিপুরে নির্যাতনের শিকার সেই কুকি রমণীর কথাও।
অমিত শাহের নাম দেখেই এই সব ঘটনা পর পর মনের মধ্যে অতীতের গহ্বর থেকে উঠে এল।
মনের গভীরে কোথাও থেকে যায় বিজন সেতু, করণদা, সুচপুর, ভিখারি পাসোয়ান, বানতলার ঘটনা। তা হলে সম্পূর্ণ তো মুছে যায় না স্মৃতি! শুধু আমারই নয়, আরও অনেকেরই! এ ভাবেই কিছু স্মৃতি থেকে যায়। স্থায়ী ক্ষত হিসাবে মনের গভীরে। গভীর মানেই অন্ধকার নয়। সময় সময় সে সব স্মৃতি ‘আলোকোজ্জ্বল’ হয়ে ওঠে। যেমন উঠেছিল ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, শুধু রিজওয়ানুর-সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নয়, ‘পরিবর্তনপন্থী’ নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী সত্তায় নিখুঁত ভাবে সংযোজিত হয়েছিল পুরনো, বেশ পুরনো ঘটনাপ্রবাহও। প্রতিবাদী কণ্ঠে উঠেছিল সে সব কথা।
বর্তমান শাসকদলের কর্ণধারেরাও হয়তো ধরেই নিচ্ছেন এ-সব লোকে ভুলে যাবে! স্মৃতি তা হলে কার বেশি পলকা? জনগণের? না কি শাসকের? শাসক হয়তো ভুলে গিয়েছে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কথা। না কি ক্ষমতার পিরামিড-বিন্যাস ক্ষমতাশীর্ষের সঙ্গে ভিত্তিভূমিতে থাকা তৃণমূল স্তরের বিস্তর ব্যবধান তৈরি করেছে? তাই ক্রমশ বেড়েছে জনবিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই শাসকের ভাল কাজ স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। মনের গভীরে থেকে যাওয়া ক্ষত উঠে আসে বর্তমানে।
এ সবের উৎস নিহিত রয়েছে ক্ষমতার এক উৎকট প্রবণতার মধ্যেই। সেই প্রবণতা থেকেই বোধ হয় এক অবধারিত ভবিতব্যের দিকে পথ হাঁটা শুরু করে প্রতিবাদী থেকে শাসকে রূপান্তরিত হওয়া রাজনৈতিক দল।
উনিশ শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও নীতিবিশেষজ্ঞ লর্ড অ্যাক্টন বলেছিলেন, ক্ষমতার প্রবণতাই দুর্নীতির দিকে ধাবিত হওয়া। একচ্ছত্র ক্ষমতা একচ্ছত্র দুর্নীতির জন্ম দেয়। লক্ষ করা গিয়েছে, ক্ষমতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের নৈতিকতার বোধ ক্রমশ কমতে শুরু করে। ক্ষমতা মনের মধ্যে জন্ম দেয় দম্ভের। সেই দম্ভ থেকেই মানুষ হারাতে থাকে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ। সুনীতি-দুর্নীতির পার্থক্য তখন অস্পষ্ট হয়ে যায়। যে কোনও প্রকারে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা আর ক্ষমতার পরিধিকে প্রসারিত করাই তখন লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ক্ষমতাশালীর অহমিকা ভিন্নমতকে অগ্রাহ্য করার মানসিকতার জন্ম দেয়। তুচ্ছ হয়ে যায় সততা, অহিংসা, সহমর্মিতার মতো মানবিক বোধ। গুরুত্ব হারায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাংবিধানিক নিরপেক্ষতার মতো বৃহত্তর দায়বদ্ধতা।
লর্ড অ্যাক্টনের ক্ষমতা সম্পর্কিত সেই উক্তির তাৎপর্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বিশিষ্ট দুই মনোবিদ ল্যামার ও গ্যালিনস্কি। তাঁদের গবেষণায় অ্যাক্টনের উক্তির মনোবৈজ্ঞানিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল। ওঁরা তার সঙ্গে অন্য একটি কথা যোগ করেছিলেন— ক্ষমতা যে দুর্নীতি ডেকে আনে, তা সত্য। বিশেষ করে ডেকে আনে তাঁদেরই মনের মধ্যে, যাঁরা মনে করেন তাঁরা ক্ষমতাবান।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পরে রাজ্য প্রশাসনের কণ্ঠে এই ক্ষমতার ভাষাই বারংবার উঠে এসেছে। প্রশাসকদের একের পর এক ভুল পদক্ষেপ দেখতে পেয়েছেন জনসাধারণ! প্রথমে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা, বাবা-মাকে ঘণ্টা তিনেক আটকে রাখা, তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত সেরে ফেলার চেষ্টা, মেডিক্যাল কলেজের অধুনাপ্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বক্তব্য (গভীর রাতে ওই চিকিৎসক সেমিনার হলে কেন গিয়েছেন), রাজ্যের শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের সংবেদনহীন আচরণ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য, ১৪ অগস্টের রাতে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুষ্কৃতী হামলা, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা...।
ছোটবেলায় ক্যারম খেলতে গিয়ে দেখেছি, অনেক সময়েই একটা ভুল করার পর মেজাজ হারিয়ে যায়। বারে বারে ভুল হতে থাকে। যত যত্ন নিয়েই খেলার চেষ্টা করা যাক না কেন, মেজাজটাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মেজাজ ও ঔদ্ধত্যের মূলেও জনবিচ্ছিন্নতার ভূমিকা ছিল। তিনিও সমস্ত বিরুদ্ধতাকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসাবে দেখেছিলেন। সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলছে। পিরামিড-বিন্যাসের শীর্ষে বসে জনভূমির মন বোঝা কঠিন। কোন ক্ষত তাঁদের স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে থেকে গেল, তার তল পাওয়াও হয়তো দুরূহ হয়ে ওঠে। দুরূহ হয় তত দিন পর্যন্ত, যত দিন না নতুনতর কোনও প্রেক্ষিত সামনে আসে।
নতুন প্রেক্ষিতের আভাস যখন পাওয়া গেল, তত দিনে বাস্তিল দুর্গে আগুন লেগে গিয়েছে। মানুষ তত দিনে বুঝে গিয়েছেন, পিরামিড শীর্ষের শাসক ধীরে ধীরে নীচের তলের আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গা সম্পূর্ণত বিস্মৃত হয়ে আখের গোছানোতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সংগঠনই তার কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রায় সার্বিক ভাবে শাসকের উপর আস্থা হারানো সাধারণ মানুষও এখন আর শাসককে গুরুত্ব দেয় না। ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু হয়। শাসকের ভাল কাজ স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে থাকে।
ঘুম ভাঙার পর থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত জেগে থাকা প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা কোনও না কোনও অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যাই। সেই সব অনুভূতির মধ্যে থাকে আমাদের বিরক্তি, রাগ, ক্ষোভ, হতাশা, ঘৃণা, অসহায়তা, উৎকণ্ঠা, ভয়— এমন আরও অনেক নেতিবাচক অনুভূতি। আবার ভাললাগা, তৃপ্তি, আনন্দ, স্বস্তি, যৌনতা, নিশ্চিন্তির মতো ইতিবাচক অনুভূতিও। এই সব অনুভূতি সম্পর্কে কতটা সজাগ, কতটা সচেতন থাকি আমরা? এই সব অনুভূতি কতটুকুই বা স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে পারি? ইতিবাচক অনুভূতি যদিও বা প্রকাশ করতে পারি, নেতিবাচক অনুভূতির বেশির ভাগই থেকে যায় মনের অগোচরে। তারা অবদমিত হতে থাকে। ভিতরের কোটরে জমতে থাকে। জমতে জমতে একসময় উপচে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রেশার কুকারে রান্নার কৃৎকৌশল প্রায় সকলেরই জানা। ভিতরের বাষ্প জমতে জমতে একসময় ধাক্কা দেয় উপরে। সেই ধাক্কায় উঠে যায় উপরের ভাল্ভ। হুইস্লের শব্দে বেরিয়ে আসে উত্তপ্ত বাষ্প। কিন্তু উপরের ওই ভাল্ভ যদি ‘সিল’ করে দেওয়া হয়? বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তেমনই এক প্রক্ষোভের বিস্ফোরণ আমরা দেখলাম গত ১৪ অগস্টের রাতে।
রাত ও দিন ‘দখলের’ ডাক মেয়েদের।
সম্প্রতি এই বিষয়ে আনন্দবাজার অনলাইনে গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা লিখেছেন বিশিষ্ট মনোবিদ ও আমার বন্ধু অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, মনস্তত্ত্বের বিশিষ্ট গবেষক কার্ল গুস্তাফ ইয়ুং উদ্ভাবিত ‘কালেক্টিভ আনকনশাস’-এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই বিপুল জনরোষের কারণ। ইয়ুং কথিত ‘কালেক্টিভ আনকনশাস’ বলতে বুঝি মানুষের অচেতন মনের মধ্যে বসত করা পরম্পরাবাহিত স্মৃতি। অনুত্তমার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমার কিঞ্চিৎ ভিন্ন মতের কথা বলি। আমার মনে হয়েছে, এই ক্ষেত্রে অচেতন মনের ভূমিকার চেয়েও সচেতন এবং অবচেতন মনের ভূমিকাই প্রবল ভাবে অনুভব করেছি। ইয়ুংয়ের থেকেও ফ্রয়েডের তত্ত্বই এ ক্ষেত্রে যেন বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। অবচেতন মনে নানা কারণে দীর্ঘ দিন ধরে একটু একটু করে জমতে থাকা পুঞ্জীভূত প্রক্ষোভের সঙ্গে মানুষের সচেতন মনের বহুবিধ অভিজ্ঞতালব্ধ আস্থাহীনতা, হতাশা ও ক্রোধের সম্মিলিত উদ্গিরণই আমরা দেখলাম ১৪ অগস্টের রাতে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রক্ষোভ বা আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত এবং সমবেত উদ্গিরণ এক অভূতপূর্ব ঘটনা! এমন ঘটনার সাক্ষী এর আগে আমরা কখনও হইনি। এর পরিণতি কী তা আমরা জানি না, কিন্তু এই সময়ের কিছু কথা স্থান-কাল-সময়ের গণ্ডিকে অতিক্রম করে আমাদের স্মৃতিতে অমোঘ উচ্চারণ হিসাবে থেকে যাবে। তেমনই এক উচ্চারণ আমরা শুনলাম হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের প্রধানশিক্ষিকা মোনালিসা মাইতি যখন তাঁর প্রতিবাদী ছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘তোমাদের বলতে এসেছি, নিজেদের অধিকারের জন্য যে কোনও ভিকটিম (নির্যাতনের শিকার)-এর পাশে দাঁড়াও! না-হলে তুমিও তোমার অধিকার কোনও দিন খুঁজে পাবে না।’’ বললেন, ‘‘যদি রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে, আঠারো বছরের নীচের মানুষটাকেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’’ তাঁর এই কথা পৌঁছে গিয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে।
কোন্নগরে পাড়ার দুর্গাপুজোয় সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান করে একদল নারী ফেস্টুনে লিখেছেন, ‘অন্যায় যখন নিয়ম হয়ে ওঠে, প্রতিবাদ তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।’ এ ভাবেই নিরস্ত্র মানুষের প্রতিবাদে গান্ধী ফিরে আসেন বারংবার। শাহিনবাগ আন্দোলনের পরে আবার আমরা তা-ই দেখছি।
পশ্চিমবঙ্গে একটা কথা কিছু দিন আগেও বহু উচ্চারিত ছিল— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল শক্তি এ রাজ্যের কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রভৃতি প্রকল্পের দ্বারা উপকৃত নারীসমাজ। এ কথা সত্যি যে, নারীসমাজ এই প্রকল্পগুলোর ফলে কিছুটা উপকৃত হয়েছে। কিন্তু, এই প্রকল্পগুলির ফলে এই রাজ্যের নারীসমাজ কতটা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারল, কতটা তাদের সত্যিকারের ক্ষমতায়ন হল, কতটা তাদের প্রতি দিনের জীবন ও যাপন নিরাপদ হল, তা নিয়ে গভীর সংশয় থেকেই যায়। ‘মেয়েদের রাত দখলের আন্দোলন’ শুধুমাত্র শহুরে এলিট শ্রেণির মধ্যে আর আটকে নেই। নগর থেকে গ্রাম— সর্বত্র এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় মেয়েরাই আছেন। তাঁদের সঙ্গে আছেন বিপুল সংখ্যায় তরুণের দল।
অবদমিত প্রক্ষোভের এই উদ্গিরণকেই সম্ভবত ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের মুখ্য বিচারক ‘ন্যাশনাল ক্যাথারসিস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আরও একটি কথা প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল। কথাটি লেখক মিলান কুন্দেরার, ‘‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই আদতে বিস্মরণের বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই।’’
(লেখক মনোসমাজকর্মী। মতামত নিজস্ব)
ছবি: এএফপি, রয়টার্স, পিটিআই।