…থেমে যেতে যেতে একবার জোর করে
নিতে যদি তুমি নিঃশ্বাস প্রাণভরে
বেঁচে নিতে যদি একবার, বড় ভালো হত।
—কবীর সুমন
যা হলে ভাল হত, তা সব সময় হয় না। তাই অকালে স্বেচ্ছায় ঝরে যাওয়া মুখগুলি প্রশ্নচিহ্ন হয়ে উঠে আসে খবরের শিরোনামে। ক্লিষ্ট, বিষণ্ণ মুখগুলি নিজেরাই উত্তর দিয়ে যায়। কিন্তু যে মুখটি ঝলমলে, উদ্ভাসিত— সে প্রশ্নচিহ্ন হয়েই জমে থাকে স্মৃতির গভীরে। কেন? কেন? জীবন কি এতই সস্তা? আর কি কিছুই করার ছিল না?
এ মাসেরই গোড়ার দিকে, ১০ তারিখ, ছিল আত্মহত্যা নিবারণ দিবস। কিন্তু নিবারণের উপায় কী? আত্মহত্যার ইচ্ছে তো রোগ নয় যে, তার জন্য দায়ী বিশেষ জিন বা হরমোনকে শনাক্ত করে ওষুধ বা উপদেশ প্রয়োগে তাকে ঠেকানো যাবে! আত্মহনন রোধ করতে গেলে, আগে জানতে হবে এক জন কেন জীবন থেকে সরে যেতে চাইছেন। কারণটা সকলের এক রকম নয়। স্বপ্নের যেমন দ্বিতীয় দর্শক হয় না, আত্মহত্যারও তো তেমন সহযোগী হয় না যে, আগেভাগে জানতে পারা যাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘটনাটা জানা যায় ঘটে যাওয়ার পর। মনোবিদরা বলেন, জীবনে ছোটখাটো অপ্রাপ্তিকে বড় করে না দেখতে, না-পাওয়াকে মেনে নিতে ইত্যাদি। কিন্তু কোন অপ্রাপ্তি ছোট বা বড়, ঠিক করবে কে? এক জন জীবন বলতে যা বোঝেন, তীব্র হতাশায় যদি কিছু ক্ষণের জন্যও নিজেকে তা থেকে বঞ্চিত ভাবেন— তা হলে সেই সময় তাঁর বাঁচার ইচ্ছে শূন্য হয়ে যেতে পারে। কে কখন এই ভাবে চুপিচুপি খাদের ধারে এগিয়ে যাচ্ছেন, তা বুঝতেই না পারলে কী করে তাঁর কানে কানে শুনিয়ে আসব ফিরে আসার মন্ত্র? কারণ, আমরা তো কোনও ঘটনার অভিঘাত বুঝতেই পারি না, যত ক্ষণ না সেটা আমাদের সঙ্গেই ঘটছে!
চিকিৎসক অবন্তিকা ভট্টাচার্য বাড়ির কাছাকাছি বদলি পাননি বলে আত্মহত্যা করেছেন। সমাজমাধ্যমের পাতায় পাতায় তাঁকে নিয়ে যে ছিছিক্কারের বন্যা বইতে দেখলাম, তাতেই ব্যাপারটা আরও এক বার পরিষ্কার হয়ে গেল। তাঁর পরিবারের কথা ভেবে অনেকেই মেয়েটিকে ‘আত্মকেন্দ্রিক’, ‘অপরিণামদর্শী’ বলে দেগে দিয়েছেন। তাঁদের মন্তব্য পড়ে মনে হচ্ছিল, মেয়েটি যেন সংসার-সন্তান ফেলে কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন। কেউ বুঝতেই চাননি যে, ‘কাছাকাছি বদলি না পাওয়া’— ওই চারটি শব্দের আড়ালে কতটা হতাশা, ক্ষোভ, ব্যর্থতা ও অপমান লুকিয়ে থাকলে একটা মেয়ে সব ছেড়ে চলে যেতে পারেন! উপরন্তু, যে যাঁর নিজের নিজের অবস্থান থেকে মন্তব্য করেই চলেছেন, কত কী বিকল্প ব্যবস্থা হাতের কাছে ছিল, তবে শুধু নিজের কথা ভেবে কেন পরিবারকে ভাসিয়ে চলে গেলেন! জীবন বলতে অবন্তিকা যা বুঝতেন তার জন্য বাড়ির কাছে বদলিটা দরকার ছিল। দীর্ঘ সময় তিনি অপেক্ষা করেছিলেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানের কাছাকাছি থেকে ডাক্তারি চালিয়ে যেতে। বার বার আবেদন করেছেন, কেউ তাঁর কথা শোনেনি, উত্তর দেয়নি, পদোন্নতি না করেই আবার বদলি করেছে দূরে। মেয়েটি কি সত্যিই এতখানি উপেক্ষার যোগ্য ছিলেন? এই উপেক্ষার প্রতিবাদ কী দিয়ে করা যেত?
হ্যাঁ প্রতিবাদ। আত্মহত্যার অনেক কারণের মধ্যে প্রতিবাদও যে একটা কারণ, তা আমাদের মনে রাখতে হবে। বেঁচে থেকে যে অবিচারের কথা কারও কানে তোলা যায়নি, মৃত্যু সেই কথা অসংখ্য কানে পৌঁছে দিতে পারে! সেটা চলচ্চিত্র জগতের নিষ্ঠুর পক্ষপাতিত্ব, চাকরিতে অন্যায্য বদলি বা শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য (রোহিত ভেমুলা, পায়েল তদভি)— যা-ই হোক। এই নির্মম উদাসীনতা কিন্তু আমাদেরও অপরিচিত নয়। নিজেদের প্রাপ্য অর্থ বা পদোন্নতি কিংবা বিচার (‘প্রাপ্য’ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ) চেয়ে চেয়ে, দিনের পর দিন স্রেফ ঘুরে মরার ঘটনা যদি আমাদের জীবনে ঘটে থাকে, শত শত চিঠি, ইমেল লিখে হাজার বার যাবতীয় নথিপত্রের প্রমাণ পাঠিয়ে বছরের পর বছর যদি শুধু নীরবতা পেয়ে থাকি, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে জানি নীরবতার সন্ত্রাস কাকে বলে এবং তা কী করে ন্যায্য দাবিদারকে প্রায় ভিক্ষুকে বদলে দিতে পারে! শুধু ওই অর্থটুকু বা সুযোগটুকুর জন্যই কেউ বাঁচেন না, কিন্তু অনেক সময় ওইটুকুই বেঁচে থাকার শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। শর্তভঙ্গ হলে কখনও মরে গিয়েই প্রমাণ করতে ইচ্ছে হয় যে, আমি বেঁচে ছিলাম। লাভ-ক্ষতির প্রশ্নটা সেখানে অবান্তর। অবন্তিকা হয়তো চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসে রোগী দেখে চালিয়ে নিতে পারতেন, আমি-আপনিও হয়তো নিজেদের প্রাপ্যটা ছেড়ে দিতে পারি। জীবনের সংজ্ঞা বদলে নিতে নিতে কোনও ভাবে টিকে যেতে পারলে সেটা ভালই নিশ্চয়! কিন্তু সেটাকেই সমাধান বলে সবাই সর্বদা মেনে না-ও নিতে পারেন।
আত্মহনন করে কেউ ‘বেশ’ করেন না, তাই তাঁকে সমর্থনের প্রশ্নই নেই। আত্মহননের বিরোধিতা সহজ; কিন্তু তা ‘নিবারণ’ করতে কিছু দায়িত্ব নিতে হয়। আত্মহত্যায় প্ররোচনা শব্দটা আমাদের জানা। কিন্তু অবন্তিকার বদলির অর্ডারে যিনি সই করেছেন, কিংবা দিনের পর দিন যিনি নীরব উপেক্ষায় কারও ইমেলের উত্তর না দিয়ে ডিলিট করেছেন, তিনি কি ভেবেছেন যে, তিনিও কারও আত্মহত্যার প্ররোচক হতে পারেন? দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর জেনে কী হবে যে, কে রোজ রোজ কোন লড়াইটা হেরে যাচ্ছিলেন? সুতরাং, অন্তত কিছু আত্মহননের ঘটনাকেও ঠেকাতে গেলে, মানুষের প্রাপ্য ও সম্মান বিষয়ে দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা গড়ে তোলা খুব দরকার।
সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি