ছবি পিটিআই।
ইউরোপের মানচিত্রে ইউক্রেন এক নজরে পড়ার মতো দেশ। আয়তনের দিক থেকে ইউক্রেন ইউরোপের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র (রাশিয়াকে বাদ দিলে)। ভৌগোলিক দিক থেকে এ দেশের আয়তন ভারতের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। কিন্তু আকার সব কিছুর মাপকাঠি নয়। দেশটির মোট গৃহজ উৎপাদন (জিডিপি) ভারতের জিডিপি-র কুড়ি ভাগের এক ভাগ। এবং দেশটির জনসংখ্যা শ্রীলঙ্কার দ্বিগুণ। রাশিয়ার মতো একদা অতি ক্ষমতাবান রাষ্ট্র বা সোজা কথায়, অধুনালুপ্ত হলেও এক প্রাক্তন ‘সুপারপাওয়ার’-এর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তার কখনই ছিল না।
ক্রমাগত নিষ্ঠুরতার মাত্রা বৃদ্ধি-পাওয়া এক যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ইউক্রেন পাঁচ মাস কাটিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধের কালে কোনও কোনও অঞ্চল তাদের ছেড়ে দিতে হয়েছে এবং তা সত্ত্বেও রাশিয়াকে ইউক্রেন প্রায় নিশ্চল অবস্থায় নিয়ে যেতে পেরেছে। এর পিছনে কাজ করেছে ইউক্রেনের মানুষের লড়াকু মনোবৃত্তি এবং রণকৌশল। কিন্তু সেই সঙ্গে পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলি থেকে অকাতরে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টিও মনে রাখতে হবে।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে ইউক্রেনের জিডিপি ৪৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। সাম্প্রতিক একটি হিসাব অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে এক-তৃতীয়াংশ বা তার কিছু কম। অন্য দিক থেকে দেখলে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যে পরিমাণ প্রাণহানি বা অন্য মানবিক ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ হিসাব কষে বার করা অসম্ভব। ইতিমধ্যে সে দেশের যুদ্ধরত প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, অসামরিক পরিকাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে হলে ৭৫০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার প্রয়োজন। এই অঙ্কটি দেশটির যুদ্ধ-পূর্ববর্তী জিডিপি-র পাঁচ গুণ। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে এই অঙ্ক বাড়তেই থাকবে। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত পশ্চিমের কোনও দেশই সেই পরিমাণ টাকা দিতে পারবে না। যুদ্ধের ঘটমান বর্তমানে যে দিকে সকলের নজর, সেটি হল এই যে, এক সুষ্ঠু ভাবে পরিচালিত রাষ্ট্রকে কী করে প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়। যেমন একদা ঘটেছিল ইরাক ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে।
এই যুদ্ধে যে রাশিয়া লাভবান হচ্ছে, এমনও নয়। তাকেও ভাল মতো দাম চোকাতে হচ্ছে। রাশিয়ার অর্থনীতি চলতি বছরে ১০ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে অনুমান। রাশিয়ার মুদ্রার মান ক্রমাগত ওঠানামা করছে, মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১৫ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমী দেশগুলির অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে উৎপাদন ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু বিগত দু’দশকে ভ্লাদিমির পুতিন অর্থনীতির হাল বেশ শক্ত হাতেই ধরেছিলেন। যার ফলে জাতীয় ঋণের পরিমাণ জিডিপি-র এক-পঞ্চমাংশে দাঁড়ায় (যেখানে ভারতের ক্ষেত্রে এটি ৮৫ শতাংশ), পাশাপাশি খনিজ তেল এবং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে রাশিয়ার তহবিলে অর্থের প্রবেশও বৃদ্ধি পায়। তবে এ কথাও ঠিক যে, পশ্চিমী দেশগুলির তরফে অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সামরিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত অর্থ বিনিয়োগের ফল কিন্তু ভয়াবহ দাঁড়াবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিনের কণ্ঠে বিন্দুমাত্র হেলদোল লক্ষ করা যাচ্ছে না। যেটুকু দৃশ্যমান তা হল এই যে, ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি যে সব লক্ষ্যে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর সূচনা করেছিলেন, সেগুলিই তিনি তুলে ধরছেন।
যখন কেউ কোনও যুদ্ধের প্রেক্ষিত অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার শিকড়ে গিয়ে পৌঁছান, সেখানে দেখা যায় যে, যুদ্ধের দায় বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যেই বিরাজ করছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা ঘটে, তা অনেকটা ধ্রুপদী গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো উভয় পক্ষের ভেঙে পড়ায়। তেমন উপসংহার যেন অনিবার্য হয়ে উঠছে। সুতরাং এই কাহিনি আর কেবল মাত্র ইউক্রেনে আটকে থাকছে না, তা পিছু হঠতে হঠতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয় এবং তার পরবর্তী ঘটনাক্রমের দিকে ইঙ্গিত করছে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের মানুষের কাছে গণতান্ত্রিক পশ্চিম এবং ধনাঢ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ক্রমাগত স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঢলে পড়তে থাকা রাশিয়ার চাইতে শ্রেয়তর পছন্দ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতের রুশ সাম্রজ্যের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ নীতির কথাও মাথায় আসতে থাকে অনেকের। কিন্তু যেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পূর্বদিকে তার সম্প্রসারণ শুরু করল, তাকে অনুসরণ করল ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ (ন্যাটো)। রাশিয়া টের পেল, সে অবরোধের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। এক জন ভাষ্যকার পরিস্থিতির যথাযথ বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন— পশ্চিমী শক্তিগুলিই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তার পরে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে।
যদি কেউ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, পশ্চিমী শক্তিগুলি কি আদৌ ভৌগোলিক ভাবে সঙ্কুচিত ইউক্রেনকে রক্ষা করতে চেয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের আগ্রাসন কি নিছক পশ্চিমী প্ররোচনার এক প্রত্যুত্তর মাত্র? যদি তা-ই হয়, তা হলে পরিস্থিতি রাশিয়াকে আপসের পথে নিয়ে যেত এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঙ্ঘাতের ইতি ঘটত। কিন্তু পুতিন যদি প্রতিশোধস্পৃহায় আরও কঠোর হয়ে ওঠেন এবং যদি পশ্চিম রাশিয়ার এই হুঙ্কারকে চিরতরে বন্ধ করতে চায় (বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত বলে ধরে নিচ্ছি, যদিও বিষয়টি আদৌ তা নয়), তবে যুদ্ধ চলতেই থাকবে এবং পরিশেষে কাউকেই বিজয়ী হিসেবে দেখা যাবে না।
সর্বোপরি, রাশিয়ার প্রতি প্রযুক্ত অভাবনীয় অবরোধগুলি পশ্চিমের দেশগুলির দু’দিক থেকে ক্ষতি করছে। আমেরিকা এবং ইউরোপকে অর্থক্ষতির মাশুল গুনতে হচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপকে। যদি গ্যাস সরবরাহ কমে আসে, যদি অর্থনীতি মন্দাবস্থা দেখা দেয় এবং মুদ্রাস্ফীতির লেখচিত্র এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছয়, যেখানে বিগত কয়েক দশকে তা পৌঁছায়নি, তা হলে পশ্চিমী গণতন্ত্রের রাজনৈতিক নেতাদের ভোটব্যাঙ্কে টান পড়বে। ইউরোপীয় দেশগুলির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন উভয় সঙ্কটের মধ্যে বিরাজ করছেন। এক দিকে তাঁদের শক্তি বা জ্বালানি সরবরাহের এক নিশ্চিত উৎসকে পরিহার করতে হয়েছে এবং অন্য দিকে তাঁরা তাঁদের দেশের অর্থনীতির সামরিকীকরণ ঘটাতে চাইছেন। কারণ, এর প্রেক্ষিতে কাজ করছে ইউক্রেনকে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দানের বিষয়টি। ঠিক কোন পরিস্থিতিতে পৌঁছালে মিত্রতা বিনষ্ট হবে? যদি তা না হয়, (কারণ পশ্চিমের আসল লক্ষ্য রাশিয়ার হুঙ্কারকে চিরতরে স্তব্ধ করা) তা হলে যেটুকু বাকি থাকে তা হল, ইউক্রেনের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে শুধু মাত্র ‘বেচারা ইউক্রেন’ বলে সরে আসা।