Society

চাই ঐক্য বিবেক শুভবোধ

বিগত কিছু দিন ধরে রাজ্য তথা দেশ জুড়ে বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন। তাঁরা ইতিহাসে কেবল সংখ্যা হয়ে থাকবেন, মানুষ হিসাবে নন।

Advertisement

মৃন্ময় প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২২ ০৫:০২
Share:

লাহোর থেকে প্রকাশিত হয় কুরাতুলাইন হায়দার-এর উপন্যাস আগ কা দরিয়া, ১৯৫৯ সালে। প্রাচীন ভারত থেকে স্বাধীন ভারত অবধি বিস্তৃত এ উপন্যাসের পরতে পরতে লেখক দেখান, কী ভাবে ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে বহুত্বের চর্চা, বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ ও জাতির মানুষের মধ্যে দর্শনের আদানপ্রদান। ভারতীয় সংস্কৃতি যে আসলে এক মিশ্র সংস্কৃতি, ভারতের সঙ্গে প্রাচ্য ও বিশেষত পশ্চিম এশিয়ার সম্পর্ক, সুফি ও ইসলামিক দর্শনের সঙ্গে তথাকথিত হিন্দু দর্শনের বহু ধারার নিরন্তর সংলাপ বর্ণনা করেছেন হায়দার।

Advertisement

দেশবাসীর মধ্যে স্বাধীনতার আবেগ-অনুভূতি থাকতে থাকতেই ক্রমে প্রকট হতে থাকে অসাম্য, শ্রেণি-বর্ণ-ধর্ম বিভাজন। গুরু দত্তের পিয়াসা ছবিতে সাহির লুধিয়ানভির একাধিক গানে ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’-দের হতাশা ফুটে ওঠে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর ‘মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য’ নামের দীর্ঘ গানের আখ্যানে বলেন সদ্য-স্বাধীন দেশের অসহায়তার কথা। ধর্ম বর্ণ জাত বিভেদের বাইরে গিয়ে সাম্যের কথা ভেবেছিলেন বহু মানুষ।

রামচন্দ্র গুহের একটি লেখায় রয়েছে, উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান পাকিস্তানে তাঁর গানের যথার্থ রসিক না পাওয়ায় ফিরে আসতে চান ভারতে। নেহরু সাদরে তাঁকে দিল্লিতে ফিরে আসতে বলেন, মোরারজি দেশাই বলেন মুম্বইয়ে আসতে। মুম্বইয়ে উস্তাদজি পসার জমান, এক রামনবমীতে বেঙ্গালুরুতে পরিবেশন করেন হংসধ্বনি রাগ। কর্নাটকি এই রাগের রচয়িতা রামস্বামী দীক্ষিতার, তাকে জনপ্রিয় করেছেন উস্তাদ আমান আলি খান ও উস্তাদ আমির খান, আবার শিল্পীর হাতের বাদ্যযন্ত্র তৈরি কোনও মুসলমান শিল্পীর হাতে। ভারতীয় সাংস্কৃতিক জীবনে কোনটা মুসলমানের আর কোনটা হিন্দুর সম্পদ, আলাদা করা যাবে কোন উপায়ে?

Advertisement

লেখক ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। ঔপনিবেশিক শাসনের চতুর কৌশলে এঁরা চিরশত্রু হয়ে গেলেন। আজ সম্প্রীতির কথায় মানুষ স্পন্দিত হন না, ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে তথ্য পাওয়া যায় তা আজ বেশির ভাগ মানুষের কাছে ‘বই’-এর কথা। শুধু লিখে বা পড়িয়ে হিংসার মতো শক্তির সঙ্গে আজ লড়াই করা যাবে না; যুক্তিহীন ইতিহাসবোধহীন অগভীর মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বহুত্বের আবেদন তৈরিতে দরকার শুভবুদ্ধির চর্চা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চাকারীদের ‘অ্যাক্টিভিজ়ম’। যে অপশক্তি সব জেনেও ক্ষমতায় থাকার জন্য জনতাকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়, ঐক্যের ‘অ্যাক্টিভিজ়ম’ নিয়ে এগিয়ে এলে তারা ভয় পাবে, বুঝবে ভোটে জেতার জন্য তাদের অনুসৃত পথে এখন আর কাজ হবে না।

হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উনিশ শতকের বাঙালি ব্রিটিশ সরকারের ‘সহবাস সম্মতি বিল’-এর পরিপ্রেক্ষিতে নাবালিকা মেয়ের প্রসূতি হওয়ার ও বারো বছরের কমবয়সি মেয়ের বিবাহের বিপক্ষে রুখে দাঁড়িয়েছিল। বহু শ্রদ্ধেয় হিন্দু উচ্চবর্ণীয় পুরুষ নাবালিকা বিবাহ করেছিলেন, কিন্তু সে যুগের মানুষ এই রীতির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এও সমান সত্য। কালক্রমে মেয়েদের বিয়ের বয়স আজ আর উনিশ শতকের মতো নেই। যে প্রশ্নের সমাধান বহু যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে বহু বছর আগেই হয়ে গিয়েছে, আজ সেই প্রশ্ন পুনরায় উত্থাপন করা নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক। হিন্দু মুসলিম কারও কাজেই লাগবে না সেই তথ্য বা বিতর্ক।

বিগত কিছু দিন ধরে রাজ্য তথা দেশ জুড়ে বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন। তাঁরা ইতিহাসে কেবল সংখ্যা হয়ে থাকবেন, মানুষ হিসাবে নন। জনগণের সম্পত্তির বিনষ্টি, মানুষের মৃত্যু দ্রুত মুছে যাবে সামূহিক স্মৃতি থেকে। যে বিষয় নিয়ে বিতর্ক ও হিংসা, সেই বিষয় নিয়ে যে মারে ও যে মরে, কোনও পক্ষই কোনও দিন ভাবেনি, ভাবার প্রয়োজনও বোধ করেনি। হিংসার জন্ম বৃহত্তর মানুষের অপ্রয়োজনের উৎস থেকে। ধর্মীয় অপ্রয়োজনকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারলে হিংসা নামক এক সুদূর প্রভাববিস্তারী ক্রিয়ার জন্ম দেওয়া যায়। মানুষের ধর্ম পরিচয়কে প্রকট করে, গোষ্ঠী-স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে যায় তা।

এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাই ম্যাচ শেষ হল সে দিন। যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গন কানায় কানায় পূর্ণ, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে খেলছে ভারত। দর্শকাসনে শুধু চিৎকার ‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া!’, সুনীল ছেত্রী-আব্দুল সামাদের গোল, গ্যালারি থেকে উছলে পড়ছে মোবাইলের আলো আর আনন্দের হিল্লোল। কেউ জিজ্ঞেস করেনি কে হিন্দু কে মুসলমান, আফগান খেলোয়াড়দের ধর্ম তুলে গালিও পাড়তে দেখিনি কাউকে। ঠিক সেই দিনই— তার আগে বা পরেও—জ্বলেছে পুড়েছে ভেঙেছে এই রাজ্য, এই দেশ। মনে পড়ছিল গান, ‘এই পৃথিবী এক ক্রীড়াঙ্গন, ক্রীড়া হল শান্তির প্রাঙ্গণ’। দেশ ও দশের মনে শান্তি আনতে দরকার অন্তঃস্থ সেই বিবেকবোধের জাগরণ।

তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement