মমতা বার বার প্রমাণ করেছেন, তৃণমূলের ‘ভোটের মুখ’ তিনিই
Mamata Banerjee

এ বার কি ‘নবীন রাজা’

‘নতুন তৃণমূল’ এখন রাজ্য-রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, তৃণমূল ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে ‘মমতাময়’।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০২২ ০৪:৪৭
Share:

ধাপে ধাপে অভিষেককে মমতা এগিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর ধরে।

বলে গিয়েছেন জ্ঞানী-সন্তেরা, বায়ুর চেয়েও দ্রুতগামী হল আমাদের মন। মনের গতি যে ভাবে পলে পলে বদলাতে থাকে, বাতাস তার কাছে হার মানবে। আজকের দিনে সেই কথাকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে বলা যেতে পারে, রাজনীতি বোধ হয় এ বার মনের গতিকেও হারিয়ে দেবে!

Advertisement

মঞ্চে এবং মঞ্চের পিছনে রাজনীতির পট পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রাখা এখন সত্যিই দুরূহ। গত এক মাসের ঘটনা পরম্পরায় সেই ধোঁয়াশা আরও বেড়েছে। সেই সঙ্গেই বাড়ছে প্রশ্ন ও সংশয়।

‘নতুন তৃণমূল’ এখন রাজ্য-রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, তৃণমূল ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে ‘মমতাময়’। প্রায় পঁচিশ বছরের চলমানতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে শূন্য থেকে গড়া এই দলটি তাঁর নির্দেশ, সিদ্ধান্ত ও কৌশল অনুযায়ী চলেছে। এমনকি, দলের বাইরেও তৃণমূল-ভোটারদের সিংহভাগ ঘাসফুলের পক্ষে বোতাম টিপে ভাবেন এবং বলে থাকেন, “মমতাকে ভোট দিয়ে এলাম!”

Advertisement

অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত দলের ক্ষেত্রে, অন্তত বাংলায়, এমন হয় বলে জানা নেই। তাই মমতা যখন প্রচারের ময়দানে গিয়ে দাবি করেন, ‘আমিই প্রার্থী’, তখন তাতে অহমিকা জাহির করার চাইতে বেশি থাকে বাস্তবতা। কী ভাবে তিনি ধাপে ধাপে এই অবস্থানে পৌঁছেছেন, নতুন করে সেই আলোচনা অর্থহীন।

তবে এর অপর একটি দিক আছে। সেখানে সাফল্য ও প্রশংসার পাশাপাশি ব্যর্থতা, নিন্দাবাদ ইত্যাদিরও মূল দায় মমতাকেই বইতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কারণ, একক কর্তৃত্বের দলে সেটা এড়ানো মুশকিল। ফলে সর্বময় নেত্রী হিসাবে সেই অবস্থানে পৌঁছে তিনি লোকচক্ষে যেমন ‘সৎ’-এর দিদি, তেমন ‘অসৎ’-এরও দিদি! রাজ্য রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষিতে যা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক এবং অর্থবহ। কিছুটা চাপেরও বটে।

ঠিক এই সময়েই আবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দিয়ে শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ‘নতুন তৃণমূল’-এর ঘোষণা। কলকাতা ছাড়িয়ে সেই হোর্ডিং এখন জেলামুখী। তাতে বলা হয়েছে, ছ’মাসের মধ্যে ‘মানুষ যেমন চায়’ তেমন তৃণমূল তৈরি হবে।

মমতার পরিবারে তাঁর পরে রাজনীতিতে যিনি প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছেন তিনি অভিষেক। মধ্য তিরিশের এই যুবক শুধু সাংসদ বা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকই নন, তৃণমূলে তিনি ‘নব’ প্রজন্মের অগ্রদূত হিসাবেও ইতিমধ্যে স্বীকৃত হয়ে গিয়েছেন। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের সময় থেকে তাঁর উত্থানের গতি দ্রুত বেড়েছে।

এর পিছনেও নির্দিষ্ট ভাবে মমতার ভূমিকা, বলা ভাল পরিকল্পিত পদক্ষেপ, অস্বীকার করা যাবে না। সাতাশে পা দেওয়ার আগেই মমতা তাঁকে প্রথম বার সাংসদ হিসাবে লোকসভায় যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। রাজ্য তৃণমূলের যুব সংগঠনে নেতৃত্বের ভারও তিনি তুলে দিয়েছিলেন অভিষেকের হাতে। এ বার দলে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অভিষেককে দিয়েছেন মমতা। ধাপে ধাপে অভিষেককে তিনিই এগিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর ধরে।

সময়ের সঙ্গে তৃণমূলের অন্তঃপুরে এটাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে যে, সংগঠনে অভিষেকের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা আজ কারও চেয়ে কম নয়। এটা ভাল বা মন্দ, দলের ক’জন এটা মানেন অথবা মানেন না— সে সব ভিন্ন বিতর্ক। মোদ্দা কথাটি হল, সংগঠনের রাশ অভিষেক কার্যত হাতে তুলে নিয়েছেন। এখন জেলাগুলির সঙ্গে সাংগঠনিক বৈঠকও তিনিই করেন।

সে দিক থেকে বিচার করলে অভিষেকের ছবি দিয়ে ‘নতুন তৃণমূল’ তৈরির সাম্প্রতিক উদ্যোগ তারই একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। বিষয়টি সম্পর্কে মমতা ‘অবহিত’ নন ভেবে নেওয়াও তাই বোধ হয় অতিসরলীকরণ হতে পারে। বরং ধরে নেওয়া যাক, এ-নিয়ে কোথাও ‘অসম্মতি’র প্রকাশ ঘটেনি। অন্তত চোখের সামনে তেমন প্রমাণ নেই। আসলে আজ হোক বা কাল, এটা যে অনিবার্য তা মমতার চেয়ে ভাল আর কেউ বোঝেন বলে মনে হয় না। দলে নতুন প্রজন্মের উঠে আসা নিয়ে তিনি নিজেই যথেষ্ট আশাবাদী। অভিষেককে নেতৃত্বে তুলে আনার সঙ্গে মমতার ওই ভাবনা সঙ্গতিপূর্ণ।

পর্যবেক্ষকদের আরও ধারণা, পার্থ-কাণ্ডের পর থেকে প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয়েছে। মন্ত্রিসভার রদবদলে এবং সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে অপেক্ষাকৃত নতুনদের হাতে দায়িত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার নির্দিষ্ট সঙ্কেত দেওয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে।

অনেকের মনে আছে, গত মে মাসে দলের এক কর্মী-সম্মেলনে মমতা জেলাস্তরে সাংগঠনিক রদবদল করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সেই সময় বিভিন্ন জেলায় একাধিক পুরনো নেতা সম্পর্কে মমতার ‘ইতিবাচক’ মনোভাবও নজর এড়ায়নি। কিন্তু এখন জেলাগুলির সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাসে ‘নতুন’দের প্রাধান্য মোটামুটি পরিষ্কার।

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিন্যাসের অন্যতম কারিগর। এতে একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে যাচ্ছে। যুক্তি বলে, এই ‘টিম’ নিয়েই তৃণমূল পঞ্চায়েত ভোটে নামবে। সেটা হয়তো হবে ‘নতুন’ তৃণমূলের প্রথম পরীক্ষা।

মাস দেড়েক আগে উত্তরবঙ্গে গিয়ে অভিষেক ঘোষণা করেছিলেন, ছ’মাসের মধ্যে ‘নতুন’ তৃণমূল দেখতে পাওয়া যাবে। সেই তৃণমূলের অবয়ব সে-দিন যথেষ্ট খোলসা হয়নি। তবে সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টনের নিরিখে দলের মধ্যে দুই প্রজন্মের সূক্ষ্ম ভেদরেখাটি ক্রমশ স্থূল হয়ে উঠছে।

তা হলে কেমন হতে পারে ‘নতুন’ তৃণমূলের চেহারা? সকলের মনে পড়বে, ক্ষমতায় থাকাকালীন বাম নেতারা মাঝে মাঝেই ‘উন্নততর’ বামফ্রন্টের কথা বলতেন। মাখন পাল, অশোক ঘোষের মতো প্রবীণ শরিক নেতারা বোঝাতেন, নিজেদের ‘ছোটখাট’ বিবাদ সত্ত্বেও বামফ্রন্টের ঐক্যকে ‘চোখের মণির মতো’ রক্ষা করতে হবে।

সিপিএমের দাপটে কুঁকড়ে থাকা ওই মেজো-সেজো দলগুলির কাছে সেই সব কথা আসলে ছিল অক্সিজেন খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা। কারণ তাঁরা জানতেন ফ্রন্ট মানে ‘ক্ষমতা’ এবং ক্ষমতা মানে টিকে থাকার রসদ। গদি-হারানো বামফ্রন্ট এখন ও-সব ভুলেও বলে না!

অভিষেকের ছবি-সহ ‘নতুন’ তৃণমূলের হোর্ডিং অবশ্য ‘উন্নততর’ তৃণমূল জাতীয় কোনও দার্শনিক তত্ত্ব শোনায়নি। বরং সোজাসাপ্টা জানিয়েছে, ‘মানুষ যেমন চায়’ দল হবে সেই রকম। কথাটির একটি সহজ ব্যাখ্যা হল, এখনকার মতো তৃণমূল মানুষ চায় না। মমতার দলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই রকম কোনও ধারণা তৈরি হতে থাকলে দলের ভিতরে ও বাইরে তার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। বিশেষ করে তৃণমূল এখন শাসক দল। তাই জনগণের মধ্যেও এর প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।

সন্দেহ নেই, মানুষ কখনও পার্থ-অনুব্রত ‘খচিত’ তৃণমূল দেখতে চাইবে না। বস্তুত কোনও রাজনৈতিক দলেই এমন ‘নেতা’দের সমাহার মানুষের সমর্থন পেতে পারে না। ‘নতুন তৃণমূল’-এর বার্তা নিঃসন্দেহে সেই দূরত্ব রচনার একটি কৌশল। তবে ‘স্বচ্ছতা’ প্রমাণের দায় থাকে সেখানেও।

এটা বহুপরীক্ষিত সত্য যে, দুর্নীতির অভিযোগ, তদন্ত, ধরপাকড় সত্ত্বেও দিনের শেষে মমতার দল ভোটে জিতে আসে। তার পিছনে এখনও তাঁর মুখ তৃণমূলের সবচেয়ে বড় পুঁজি ও ভরসা। অন্য কারও নয়। তাই ‘নতুন তৃণমূল’ নেতৃত্ব দলের দখলদারি পেতে পারলেও ভোটে জেতার চাবি বাঁধা থাকবে মমতার আঁচলে। জিতলে ‘তিনি’ জিতবেন।

অবশ্যই এ নিয়ে তৃণমূলে কোনও মতভেদ নেই। পুরনো, নতুন, প্রান্তিক, উঠতি সবাই একবাক্যে তা মানেন। কিন্তু ‘নতুন’-এর প্রতাপে পুরনোদের অস্তিত্ব-সঙ্কট তৈরি হলে ‘স্বাস্থ্যহানি’র শঙ্কা থাকবে!

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ঘুঁটে মহাশয় মস্ত লোক হইতে পারেন তাই বলিয়া যে গোবরের সঙ্গে আদান প্রদান একেবারেই বন্ধ করিয়া দিবেন, ইহা তাঁহার মত উন্নতিশীলের নিতান্ত অনুপযুক্ত কাজ!” মমতার গড়া দলে এই ভাবনাটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement