COVID19

এর পরও অবাক হচ্ছি না কেন

সংক্রমণের ঢেউগুলো যথাসময়ে স্তিমিত হল, কিন্তু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দিল যে, জনস্বাস্থ্যের কাঠামো কত ভঙ্গুর, কত অগোছালো।

Advertisement

স্থবির দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২১ ০৫:২৩
Share:

ভাইরাসের এক-একটা আবক্রপথ থাকে, ‘ট্র্যাজেক্টরি’। ঢেউয়ের পরে ঢেউ, ছোট-বড়-মাঝারি, সমুদ্রের জলরাশির মতো। ‘নতুন’ করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

Advertisement

কিন্তু এই ভাইরাস ভারতে আসতেই আমরা অবাক হয়ে গেলাম। সরকারের প্রেরণায় আমাদের বিশেষজ্ঞরা এবং তাঁদের অনুপ্রেরণায় সংবাদমাধ্যম জানাল যে, সারা দুনিয়ার অবস্থা মর্মান্তিক— চলমান জীবন থেমে গিয়েছে; আমাদের দেশেও ধ্বংসলীলা আগতপ্রায়, আমাদেরও থেমে যেতে হবে। আমরা নিজ-নিজ সুখী-দুঃখী গৃহকোণে নির্বাসিত হলাম। ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিরোধে স্বঘোষিত নির্বাসনের মতো এমন অসামান্য অস্ত্র যে ডাক্তারি বিজ্ঞানের ঝুলিতে ছিল, তা আমাদের জানা ছিল না; ভাইরাস ‘নির্মূল’ করে ফেলার যে-যে উপায় বাতলানো হল, তা-ও আমাদের অধীত বিদ্যার সঙ্গে মিলল না।

গত বছর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকা এবং ইউরোপের কোনও কোনও দেশে যখন কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রতি দশ লক্ষ মানুষের মধ্যে ২০০ থেকে ৫০০, তখন ভারতে সংখ্যাটা ছিল ১— এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও ছিল খুবই কম। অথচ, জনমানুষের ভিড়েই তো শ্বাসতন্ত্রীয় ভাইরাস রসদ পায়। ভিড়ের নিরিখে আমাদের সঙ্গে পাল্লা দেবে কোন দেশ! তা হলে কেন উল্টো ফল? অগস্ট নাগাদ মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল দশ লক্ষে ২৬, পশ্চিমের তুলনায় তখনও খুবই কম। তখন সংক্রমণ-জনিত মৃত্যুর হার ছিল ০.০৮%; তার মানে, প্রায় ৯৯.৯৯% সংক্রমিত মানুষ সেরে উঠছেন।

Advertisement

পরের মাসে দেখা গেল, কোভিডে অসুস্থের সংখ্যা বেড়েছে, মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় প্রতি দিন ১২০০। বছরের শেষে আর নতুন বছরের শুরুতে কোভিড হাওয়ার বেগ কমল। জাতীয় স্তরে হিসেবনিকেশ করে বলা হল, প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সংক্রমিত এবং তাঁদের মধ্যে মৃত্যুহার ০.০৫%। আমাদের উত্তরোত্তর অবাক হওয়ার পালা, কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী এখানে মিলল না। এই দেশ কি এতই ঈর্ষণীয় রকমের নিরাপদ?

কিন্তু না! এই বছর মার্চ থেকে সংক্রমণ আবার বাড়ল, দ্রুত গতিতে; শুরু হল পরিত্রাহী সঙ্কট এবং একই সঙ্গে দোষারোপের তরজা। ‘দ্বিতীয় ঢেউ’-এর কার্যকারণ নিয়ে তরজা যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই, মে মাসের শেষের দিকে দেখা গেল, সংক্রমণ আবার কমতির দিকে।

কেউ কেউ বললেন, এটা টিকারই জাদু। আমরা আর এক প্রস্ত অবাক, কেননা তখন পর্যন্ত মোটে ৩.৫% মানুষের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। আপাতত আমরা অবাক হয়ে আছি ‘তৃতীয় ঢেউ’-এর আগমনবার্তা নিয়ে।

আসলে কিন্তু অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। অতিমারি প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে হাঁটেনি। বরং তার স্বচ্ছন্দ গতি রুদ্ধ হয়েছে ‘লকডাউন’ নামে এক উদ্ভট ঝামেলায়। সংক্রমণ এক বার ঘটে গেলে কোনও সামাজিক বিধিনিষেধ যে তাকে আর প্রতিরোধ করতে পারে না, সে কথা ডাক্তারি বিজ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দলবদ্ধ হুহুঙ্কারে বিজ্ঞানের সেই পাঠ এখন নিতান্ত কোণঠাসা। সংক্রমণের প্রকোপ কমা (‘ফ্ল্যাট কার্ভ’) মানে ভাইরাস ‘নির্মূল’ হয়ে যাওয়া, এমন শিক্ষা ডাক্তারি বিদ্যা দেয়নি।

অতিমারির প্রথম ঢেউয়ের মূর্ছনা কিছু মানুষকে বিপদে ফেলেছিল; বাকিরা ভেবেছিলেন যে, ‘কোভিড বিধি অনুসারী’ জীবনযাপন করতে পারলেই নির্বিপাকে থাকা যাবে। সে ছিল নিরাপত্তার মায়া! দ্বিতীয় ঢেউ যাঁদের দোরে আছড়ে পড়েছে তাঁদের ৭০ শতাংশই ছিলেন মায়াচ্ছন্ন; কঠোর ‘নিয়ম’ মেনেও তাঁরাই বিপদে পড়লেন বেশি। অন্যদের বাঁচাল জৈবিকতার অমোঘ ধর্ম, ‘ইমিউনিটি’।

দ্বিতীয় ঢেউয়ে ‘নতুন’ করোনার কিছু নতুন সংস্করণও (‘স্ট্রেন’) আবির্ভূত হয়েছিল, হয়তো লকডাউনের পরোক্ষ পরিণতিতে অথবা ‘নতুন’ ভাইরাস নিত্যপ্রসবিনী বলে। এরা যতটা সংক্রামক হয়, ততটা হন্তারক না। তাই সংক্রমণের সংখ্যা তখন বেড়েছে, যে সংখ্যা প্রচারিত হয়েছে আসল সংখ্যা সম্ভবত তার ৩০ গুণ বেশি; কিন্তু মৃত্যুর হার কমেছে। আমরা সংখ্যা দেখে বিহ্বল, মৃত্যুর হার খেয়াল করিনি। তার ফল দু’মুখো, এক দিকে হাসপাতালে সঙ্কট আর অন্য দিকে জনমানুষের মধ্যে স্বাভাবিক জৈবিক প্রতিরোধের জন্ম। এশিয়া-আফ্রিকার নানান দেশের মতো আমাদেরও জনঘনত্ব বেশি, কিন্তু পৃথুলতা কম, বৃদ্ধ-অশক্ত লোকের সংখ্যাও কম, তাই এখানে স্বাভাবিক সংক্রমণই জনপ্রতিরোধের জৈবিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়— ‘হার্ড ইমিউনিটি’। আর, ‘পুরনো’ করোনাগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার অভিজ্ঞতাও আমাদের বেশি; তাই ‘নতুন’-কে চিনতে ভুল হয় না— ‘ক্রস ইমিউনিটি’।

ভাইরাসের কর্মসূচি থাকে। তাই দ্বিতীয় ঢেউ তিথি না মেনে যেমন হুট করে চলে আসে না; তেমনই সে হঠাৎ চলেও যায় না, লক্ষ্য মিটলেই ক্ষান্ত হয়। এই ধরনের সংক্রমণে টিকার যুক্তি আছে, কিন্তু তা সীমিত। টিকার চেয়ে অনেক বেশি দরকার ছিল সুচিকিৎসার উপায় খোঁজা, মৃত্যুর সংখ্যা কমানো; সেই পথের হদিস করাই হল না।

তাই সংক্রমণের ঢেউগুলো যথাসময়ে স্তিমিত হল, কিন্তু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দিল যে, জনস্বাস্থ্যের কাঠামো কত ভঙ্গুর, কত অগোছালো। অসীম নির্বুদ্ধিতা, ঔদ্ধত্য আর উদাসীনতা দিয়ে সেই ফাঁক ভরাট করা যায় না। আমরা জনসংখ্যার বহর দেখে আর্তনাদ করি, কিন্তু সম্পদের অসম বণ্টনের কথা ভেবে দেখি না।

স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও একই কথা; অভাব শুধু পরিকাঠামো আর অবকাঠামোতে নেই, আছে বণ্টন ব্যবস্থাতেও। বড় বড় শহরে অতিকায়, সুরম্য হাসপাতাল আপৎকালে যে কোনও সুরক্ষা দেয় না, বরং আতঙ্ক বাড়ায়, সে কথা আর কত বার বললে গ্রাহ্য হবে? তার উপর আছে ‘কোভিড’ চিকিৎসায় অবিমৃশ্যকারিতা, ক্রমশ তা স্পষ্ট হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের পাণ্ডিত্যের হাল দেখে মনে হয়, অতিমারির চেয়ে অতিমারি-সৃষ্ট আহাম্মকির ওজনই যেন অনেক বেশি।

তাতে অবশ্য আর অবাক হই না। বাল্যকালে এক জ্ঞানবৃদ্ধ বলেছিলেন, “বড় হয়ে তুই ডাক্তার হবি, হয়তো ইঞ্জিনিয়ার, নয়তো ব্যারিস্টার; কিন্তু একটা জিনিস কখনও হবি না।” কী হব না, দাদু? “কখনও অবাক হবি না!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement