অভিযোগ: রাজভবনের সামনে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ। কলকাতা, ১৩ জুন ২০২২
গত কয়েক মাসে, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ-দুর্নীতির খবর দেখাটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্পষ্টতই, আমাদের দেশে এবং রাজ্যে পলিটিক্যাল করাপশন বা রাজনৈতিক দুর্নীতির কোনও অভাব নেই।
সহজ ভাষায়, রাজনৈতিক দুর্নীতি বলতে বোঝায় সরকারের এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের (যেমন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা, প্রশাসন ইত্যাদি) ভিতরের দুর্নীতিকে। এই ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি যোগ থাকে সরকারি কর্মকর্তাদের। রাজনৈতিক দুর্নীতি প্রাচীন ভারতেও ছিল— কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-তে রাজনৈতিক দুর্নীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে সেটা আমাদের সমাজের সঙ্গে একেবারে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে গেছে। বস্তুত, গত কয়েক দশক ধরে এই গোত্রের এত দুর্নীতির সাক্ষী থেকেছে আমাদের দেশ যে, তার তালিকা করতে বসলে বছর কাবার হয়ে যাবে!
রাজনৈতিক দুর্নীতি খারাপ— এ কথাটা মোটামুটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু, ঠিক কী ভাবে এই ধরনের দুর্নীতি সমাজের ক্ষতি করে? যাঁরা রাজনৈতিক দুর্নীতির সরাসরি শিকার হন, তাঁদের জীবনে স্বভাবতই গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। কিন্তু সামাজিক সমস্যা হিসাবে দুর্নীতি কতটা ভয়াবহ তা নির্ণয় করতে হলে, এঁদের জীবন দুর্নীতির জন্য কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শুধু সেটুকু জানাই যথেষ্ট নয়। এই ধরনের দুর্নীতি বৃহত্তর সমাজ এবং সমাজ কাঠামোর উপর কী অভিঘাত সৃষ্টি করে, সেটা বোঝাটাও জরুরি।
সেটা বুঝতে গেলে সমাজবিজ্ঞানের বহু আলোচিত বিষয় ‘সোশ্যাল ট্রাস্ট’ বা সামাজিক আস্থার কথা বলতে হবে। সামাজিক আস্থা বলতে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যের প্রতি আস্থা বোঝায়। একটা সময় বলা হত যে, আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল শ্রম এবং পুঁজি। ইদানীং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উন্নয়নের জন্য সম্ভবত শ্রম বা পুঁজির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সামাজিক আস্থা। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও বলেছেন, “একটি দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম নির্ধারক যে সামাজিক আস্থা, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।”
যে সামাজিক আস্থা উন্নয়নের অন্যতম নির্ধারক এবং সমাজের ভিত বলে আজ প্রমাণিত, সেই সামাজিক আস্থার মূলেই কুঠারাঘাত করে সমাজকে ভিতর থেকে ফোঁপরা করে দেয় রাজনৈতিক দুর্নীতি। অতএব রাজনৈতিক দুর্নীতির সামাজিক তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তা সামাজিক আস্থাকে বাদ দিয়ে কিছুতেই সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক দুর্নীতি কী ভাবে সামাজিক আস্থায় ফাটল ধরায়? বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপরে আমাদের যে আস্থা, বারে বারে এই ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা টলে যেতে বাধ্য। এর ফল দ্বিমাত্রিক। প্রথমত, এই প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকারিতা এবং প্রাসঙ্গিকতা বিপুল ভাবে হ্রাস পায়। সরকারি স্কুল-কলেজের প্রতি যদি কোনও কারণে বিশ্বাস ধাক্কা খায়, আমরা সন্তানকে কখনও সেই স্কুলে পাঠাব না। যদি সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলি, তা হলে কখনওই সরকারি হাসপাতালের ধার মাড়াব না। দ্বিতীয়ত, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির মান রাজনৈতিক দুর্নীতির ফলে অত্যন্ত সঙ্গিন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা সমূহ। এক জন মেধাবী ছাত্র, স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় সফল হওয়া যাঁর পক্ষে প্রায় নিশ্চিত, যদি বিশ্বাস করেন যে, এই পরীক্ষায় কোনও মতেই সৎ ভাবে পাশ করা যায় না, তবে তিনি হয়তো এই পরীক্ষাটির জন্য তৈরিই হবেন না, অন্য কোনও পেশা বেছে নেবেন। তাতে এক জন ভাল শিক্ষককে হারাবে সমাজ। মেধাবী এবং যোগ্যরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে মুখ ফেরানোর ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি অচিরেই হয়ে ওঠে মধ্যমেধার রাজত্ব।
‘সভ্যতার সংকট’-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্নীতির ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে আস্থা হারানোর সঙ্গে কি আমরা সমাজের অন্যান্য সদস্যের প্রতিও আস্থা হারাই না? যদি বিপুল নিয়োগ-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, সেই প্রতিষ্ঠানে যে পড়শি কিংবা বন্ধু চাকরি করেন, তাঁর দিকে কি আমরা বাঁকা চোখে তাকাই না? তাঁর সম্বন্ধে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি না যে, “দেখো, ও হয়তো ঘুষ দিয়ে চাকরি বাগিয়েছে।”
আর, রাজনৈতিক দুর্নীতির ফলে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের প্রতিই কেবল যে আস্থা হারাই, তা তো নয়। যদি এই ধারণাটা বদ্ধমূল হয় মনে যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, তা হলে সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি যুক্ত নন, তাঁদের অনেককেও অবিশ্বাসের চোখে দেখতে শুরু করি। এক জন সফল ব্যবসায়ীর কথাই ধরা যাক, যিনি সরকার-বিরোধী নন বলেই পরিচিত। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্নীতিগ্রস্ত, এমন একটা ধারণা যদি আমার মনে তৈরি হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে আমার মনে হতেই পারে, সেই ব্যবসায়ী সফল হয়েছেন অসৎ উপায়ে, সরকারি কর্মকর্তাদের ‘সন্তুষ্ট’ করে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ভারতীয়দের একটি বড় অংশ মনে করেন, যে ভারতীয়রা অত্যন্ত সফল, তাঁদের বেশির ভাগই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। অন্তত কিছু মানুষের চোখেও যদি অসৎ ভাবে সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির থেকে সুযোগ-সুবিধে নেওয়া দুর্নীতি বলে প্রতিফলিত হয়, তা হলে এই অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হওয়ার পিছনে রাজনৈতিক দুর্নীতির বড় ভূমিকা আছে বলেই মনে হয়।
রাজনৈতিক দুর্নীতি আরও এক ভাবে আন্তঃব্যক্তিক আস্থায় ঘুণ ধরায়। কোনও অচেনা মানুষকে আমরা কখন বিশ্বাস করতে পারি? যখন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি (বিশেষ করে প্রশাসন) শক্তপোক্ত হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি শক্তপোক্ত হলে অচেনা কাউকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হওয়ার ভয় থাকে না, তা নয়— তবে, প্রতারিত হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারস্থ হলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলি আমাকে সাহায্য করবে, সেই বিশ্বাসটা থাকে। কিন্তু যদি জানি যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিই দুর্নীতির আঁতুড়ঘর, প্রয়োজনে সেখানে গেলেও সমস্যার সুরাহা হবে না, অচেনা কাউকে বিশ্বাস করতে তখন আমাদের একশো বার চিন্তা করতে হয়।
রাজনৈতিক দুর্নীতি আমাদের একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখতে শেখায় বলেই আমাদের মধ্যে এক রকমের আদিম মানসিকতা গড়ে ওঠে, যা সর্ব ক্ষণ প্রতিটি সামাজিক লেনদেনে সতর্ক, স্বার্থপর, আত্মসর্বস্ব হতে বলে। এই ধরনের মানসিকতাই রাজনৈতিক চরমপন্থা, আন্তঃগোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, এবং বিভিন্ন মতাদর্শিক গোষ্ঠীর মধ্যে মেরুকরণের মতো ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধির মূলে।
নদীর পার ভাঙার সঙ্গে আমরা পরিচিত। সেই ভাঙনের ফলে কী ভাবে গ্রাম-জনপদ নদীগর্ভে তলিয়ে যায়, সেটা আমাদের জানা। রাজনৈতিক দুর্নীতিও, নদীর মতোই, আস্তে আস্তে ভাঙন ধরায় সমাজে। তার পর এক দিন গোটা সমাজটাই আকণ্ঠ ডুবে যায় সেই দুর্নীতিতে। সেটা না হতে দিতে চাইলে, রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে জেহাদ ঘোষণা করা ছাড়া উপায় নেই।
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়