জানতেন প্রকৃত ক্ষমতার ভাষা নির্বাক, মুখ রাখতেন ভাবলেশহীন
Queen Elizabeth II

তিনি সাম্রাজ্যেরই রানি

নিজেদের সাম্রাজ্যের অতীতের অন্ধকার ঘাঁটতে ইংরেজের রুচিতে লাগে, তাই ও-সব তারা এড়িয়ে যায়, এলিজাবেথের মৃত্যুতে এ সব প্রসঙ্গ তোলার প্রশ্নই নেই।

Advertisement

অনিকেত দে

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:১৫
Share:

দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

এলিজ়াবেথের রানি হওয়ার গল্পটা এখন রূপকথা: ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে স্বামী ফিলিপের সঙ্গে কেনিয়ার ট্রিটপ্‌স হোটেলে রাজকুমারী ছুটি কাটাচ্ছিলেন, এমন সময় পিতৃবিয়োগের সংবাদ আসে, গাছ থেকে নামার আগেই মুকুট তাঁর করতলগত হয়। কাহিনিটি বহুকথিত, বহুচিত্রিত, সম্প্রতি দ্য ক্রাউন সিরিজ়ে এই দৃশ্যে অভিনেত্রী ক্লেয়ার ফয়ের অভিব্যক্তিও রূপকথাময়, হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া রাজকুমারীর পৃথিবীর ভার নেওয়ার গল্প। গত কয়েক দিন এই রূপকথাই চোখের জল মেখে ফিরে ফিরে এসেছে, তাঁর সাত দশকের শাসন তাতে নতুন বিস্ময় আর শোকের মাত্রা যোগ করেছে।

Advertisement

কিন্তু বাস্তবের রানিকে রূপকথা করে তুলতে হলে কিছু সত্য গোপন করতে হয়, কিছু তথ্য চেপে যেতে হয়। ১৯৫২ সালে কেনিয়ায় নির্মম বাস্তব ছিল ইংরেজ শাসন, এবং তার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠা মাউ মাউ বিদ্রোহ। তত দিনে ইংরেজ ভারত ছেড়ে গেছে, কিন্তু পূর্ব আফ্রিকায় মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে। তখন তারা মাউ মাউ সন্দেহ করে হাজার হাজার কেনীয়কে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পুরছে, গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নির্বিচারে ফাঁসি দিচ্ছে। গাছ থেকে নেমে যখন রানি প্রাসাদে ফিরে গেলেন, তখন এই হত্যালীলা চলছে, চলবে আরও চার বছর। পরের বছরই রানির প্রমোদ-অরণ্যে মাউ মাউ গেরিলারা আশ্রয় নেয়। পুরো অঞ্চল থেকে কালো চামড়ার মানুষকে নিষিদ্ধ করা হয়, দেখলেই গুলি করার নির্দেশ জারি হয়। জবাবে ট্রিটপ্‌স হোটেলটি গেরিলারা পুড়িয়ে দেয়।

নিজেদের সাম্রাজ্যের অতীতের অন্ধকার ঘাঁটতে ইংরেজের রুচিতে লাগে, তাই ও-সব তারা এড়িয়ে যায়, এলিজ়াবেথের মৃত্যুতে এ সব প্রসঙ্গ তোলার প্রশ্নই তাদের নেই। আর ইংল্যান্ডেশ্বরীর প্রতি দু’শো বছরের ভক্তির অভ্যাসের দরুন বাংলাতেও দেখি কেবল মিষ্টি মিষ্টি স্মৃতিকথা, এক ঝলক দেখার অভিজ্ঞতা, কলকাতায় তাঁর পদচিহ্নের তর্পণ। হয়তো বিশ্বাস করতে ভালবাসি যে, তিনি যখন রানি হয়েছেন তখন ভারত স্বাধীন, অতএব সাম্রাজ্যের দায় তাঁর নয়। বা আরও বড় করে ভাবলে, ইংল্যান্ডের রাজা-রানি কেবলই খাতায়-কলমে, এ সব নিম্নস্তরের মারামারিতে তাঁরা হাত গন্ধ করেন না।

Advertisement

কিন্তু সত্যটা হল এলিজ়াবেথের অভিষেকের পর এক দশক ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কায়েম ছিল, এবং তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকা যা-ই থাক, এই শাসন চলত তাঁর মুকুটেরই নামে। এই সময়েই কোণঠাসা হয়ে ব্রিটিশ সিংহের দাঁত-নখ বেরিয়ে আসে, কেবল কেনিয়ায় নয়, মালয়েও। ইংরেজ ভারত ছেড়ে গেলেও মালয় ছেড়ে যায়নি, কারণ তার রবার খেতে ইংরেজ পুঁজিপতিদের বিরাট বিনিয়োগ ছিল। মালয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ইমার্জেন্সি জারি রাখা হয় এক দশক, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার যে নৃশংসতা সত্তরের দশকে দেখা যায়, পঞ্চাশের দশকেই মালয়ে তার মহড়া হয়ে যায়— রানির শাসনেই, এবং নির্দেশে না হলেও, তাঁর গোচরেই।

তা-ও মেনে নেওয়া যেত, যদি রানি সাম্রাজ্যের অপরাধ স্বীকার করে, নিদেনপক্ষে সামান্য অনুতাপ দেখিয়ে, অন্য দেশগুলিকে ব্রিটেনের সঙ্গে এক মাত্রায় রাখতেন। কিন্তু তা তিনি রাখেননি। ভুলে গেলে চলবে না, এলিজ়াবেথ কেবল ইংল্যান্ডের রানি নন, তিনি ব্রিটিশ ‘কমনওয়েলথ’-এরও মাথা। এই পদাধিকার বলে তিনি এবং ফিলিপ শতাধিক বার পুরনো সাম্রাজ্যের দেশগুলি ভ্রমণ করেন। এই সমস্ত ভ্রমণের সময়ে ছলে, বলে, আচারে, ব্যবহারে নিজের সম্রাজ্ঞী সত্তাটি বেশ বজায় রেখেছিলেন, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে নতুন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগুলির চেয়ে তাঁর আসন খানিক উপরে। ফিলিপের মুখ আলগা ছিল, আলটপকা বর্ণবিদ্বেষী কথা বলে ফেলে রাজপরিবারকে অস্বস্তিতে ফেলতেন, কিন্তু রানি জানতেন প্রকৃত ক্ষমতার ভাষা নির্বাক, তাই মুখ রাখতেন ভাবলেশহীন। কেবল একের পর এক প্রথা— ট্র্যাডিশন, বা রিচুয়ালের নামে— রাজরক্তের শ্রেষ্ঠত্ব বারংবার মনে করিয়ে দেওয়া, রাজপরিবারকে খানিক উপরে রাখা।

কিসের প্রথা, কিসের সংস্কার? ইতিহাসবিদ ডেভিড কানাডাইন দেখান যে, ব্রিটিশ রাজপরিবারের তথাকথিত ‘প্রাচীন’ সব প্রথাই উনিশ শতকের, সাম্রাজ্যের দান। এশিয়ার বিরাট বিরাট সম্রাটের দরবার দেখেই তা নকল করা হয়— লর্ড কার্জ়ন যেমন ইংল্যান্ডের রাজার জন্য দিল্লি দরবার আয়োজন করতেন। অমন দরবারের দিন গিয়েছে, কিন্তু কমনওয়েলথ সফরে প্রথাগুলি ছোটখাটো ভাবে এলিজ়াবেথ বহু দিন বজায় রেখেছিলেন। তার সঙ্গে ছিল কমনওয়েলথের শ্বেতাঙ্গ দেশ কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতি বিশেষ আত্মীয়তা, এবং কৃষ্ণাঙ্গ দেশগুলিকে পদতলে স্থান দেওয়ার পুরনো সাম্রাজ্যবাদী অভ্যেস। যে রানিকে আজ বলা হচ্ছে দক্ষ প্রশাসক, বিনয়ের অবতার, কমনওয়েলথের এই দোষগুলি কাটানোর চেষ্টা তিনি করেননি, ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ সম্মানও দিয়ে গেছেন মহাসমারোহে।

আদতে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সৃষ্টি হয় সাম্রাজ্য পতনের পরেও সাম্রাজ্য ঠারেঠোরে চালানোর জন্য। কিন্তু ষাটের দশক থেকে আমেরিকা-রাশিয়ার উত্থানের পর পৃথিবীর মঞ্চে ব্রিটেনের আর বিশেষ ভূমিকা থাকে না, কমনওয়েলথের কাজ থাকে গরিব ছাত্রদের স্কলারশিপ দেওয়া, খেলাধুলার আয়োজন করার মধ্যে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রানির মুকুট বা সিংহাসনের কোনও মূল্যই ছিল না, কিন্তু সেই মূল্যহীন মুকুটের গৌরব প্রচারেও রানি ও তাঁর পরিবার ছিলেন অনলস, তাঁদের প্রিয় আত্মীয় মাউন্টব্যাটেনের মতোই। যখন আজ বিবিসি বলে যে রানি ছিলেন হাজার পরিবর্তনের মধ্যেও একমাত্র ধ্রুবতারা, তার একটা মানে হয় যে সাম্রাজ্য চলে যাওয়ার পরেও লুপ্ত গৌরব তিনি আঁকড়ে ছিলেন বলেই শোচনীয় সত্যিটা যতটা গায়ে লাগবার ততটা লাগেনি। বহু দিনের দাসবৃত্তির অভ্যাসে, বা অনুদান পাওয়ার লোভে, পুরনো প্রজারাও বিশেষ প্রতিবাদ করেনি, যদিও একটি একটি করে কৃষ্ণাঙ্গ দেশ কমনওয়েলথ ছেড়ে চলে গেছে তিতিবিরক্ত হয়ে।

আর ধনসম্পত্তি? রাজপরিবারের বিপুল সম্পত্তির উৎস কী, তার কতটা সাম্রাজ্য থেকে ডাকাতি করে আনা— কোনও হিসাব নেই। যখনই কোনও বামপন্থী নেতা এর গভীরে ঢুকতে চেয়েছেন, এলিজ়াবেথ নানা রক্ষাকবচ তৈরি করে রাজপরিবারের আর্থিক তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্তে সিলমোহর লাগিয়েছেন। ওই সম্পত্তির হিসাব জানার অধিকার জনগণের নেই, তাঁর বাড়িতে চোরাই মাল থাকলে তল্লাশির ক্ষমতাও পুলিশের নেই। হলফ করে এ বিষয়ে কিছু বলার উপায় নেই, কিন্তু চোখের সামনেই যে রানির অভিষেকে থাকে আফ্রিকা এবং ভারত থেকে চোরাই হিরে, চোখের আড়ালে কী আছে, তা আন্দাজ করা শক্ত নয়। এ নিয়েও রানির বিশেষ গ্লানি দেখা যায়নি কখনও। পৃথিবী জুড়ে যখন লুটের মাল ফেরানোর দাবি উঠেছে, যেমন জার্মানি ফিরিয়েছে উনিশ শতকের বেনিন ব্রোঞ্জ— রানি ও তাঁর পারিষদবর্গ সর্বশক্তি দিয়ে নিজেদের ধনরত্ন আটকে রেখেছেন, উল্টে টাওয়ার অব লন্ডনে কোহিনুর বা স্টার অব আফ্রিকা হিরে দেখার জন্য ত্রিশ পাউন্ডের টিকিট বসিয়েছেন।

এত কিছু সত্ত্বেও রানি এলিজ়াবেথ যে আমাদের চোখে কেবলই স্নিগ্ধ অভিজাত মাতৃমূর্তি হয়ে রইলেন, তার কারণ আর কিছুই না, তাঁর, এবং ইংরেজ সমাজের, চমৎকার বিজ্ঞাপনী শক্তি। রানি ভিক্টোরিয়া এক কালে সগর্বে নিজেকে ভারতসম্রাজ্ঞী বলে ঘোষণা করেছিলেন, রাখ-ঢাকের দরকার হয়নি। কিন্তু পরবর্তী কালে সাম্রাজ্যের ভাব বজায় রাখতে দরকার হয় বিজ্ঞাপন এবং বিনোদনের দুনিয়ার সাহায্য। এলিজ়াবেথ ছিলেন এ বিষয়ে বিশেষ দক্ষ। চার্চিলের মত নস্যাৎ করে নিজের অভিষেক টেলিভিশনে সম্প্রচার করার ব্যবস্থা করেন তিনি। তার পর বিবিসি তথ্যচিত্রে রাজপরিবারের আটপৌরে সংসার দেখানো হয়, টিকিট করে বাকিংহাম-উইনসর-হলিরুডে টুরিস্ট ঢোকানো হয়, চার্লস-ডায়ানা কেট-উইলিয়াম একের পর এক রূপকথার জাল বোনা হয়। এর ফলে রাজপরিবার হঠাৎই অনেকটা নিকটে চলে আসে, যেন আর দশটা পরিবারের মতোই, ডায়ানা কাণ্ডের পরেও রানি জনতার অভিমানী চোখে কঠোর শাশুড়ি মাত্র, সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস থেকে যেন বহু দূরে। তাঁর মৃত্যুর পরে অগণিত ইতিহাস-বিস্মৃত লেখা আর ছবিতেও সেই একই রূপকথার পুনরাবৃত্তি, যেন রাজপরিবার লোভ-হিংসার এই পৃথিবীর বহু ঊর্ধ্বে।

সাম্রাজ্যবাদ চালিয়ে যেতে কেবল গুলি-বন্দুক নয়, একটা রূপকথাও দরকার, এটাই এলিজ়াবেথের সাত দশকের শাসনের অবসানে সবচেয়ে বড়, এবং একেবারে নতুন, ঐতিহাসিক শিক্ষা। আমরা ভুলে থেকেছি রাজপরিবারের মোহে, গোগ্রাসে গিলেছি তাদের অন্তঃসারশূন্য পারিবারিক খুঁটিনাটি। রূপকথার আড়ালে হারিয়ে গেছে খুন আর ডাকাতির ইতিহাস, ঠিক মাউ মাউ সৈনিকদের জ্বালিয়ে দেওয়া ট্রিটপ্‌স হোটেলটার মতো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement