নির্দেশ: বাজেট পেশ করার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। ছবি: সুমন বল্লভ।
১২ ফেব্রুয়ারি বিধানসভায় পেশ করা পশ্চিমবঙ্গের বাজেটে অনেক কথাই বলা হল। কিন্তু ১২৭ পাতার বিবৃতির পরও রয়ে গেল অনেক না-বলা বাণী। যেমন, কয়েক বছর ধরে তৃণমূল সরকার দাবি করছে যে, ‘উন্নয়নে এগিয়ে বাংলা’। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ, মাথাপিছু আয়ের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে ২০১১-১২ সালে ছিল ১৮তম স্থানে, ২০২২-২৩ সালে ২১ নম্বরে নেমেছে। নিশ্চিত ভাবেই দেশে আমাদের থেকেও অনগ্রসর রাজ্য রয়েছে, তার ফলে সমগ্র দেশের উন্নয়নের গড় গতি এ রাজ্যের তুলনায় কম হতে পারে। কিন্তু, দেশের অগ্রণী রাজ্যগুলির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনার উপরে কি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে?
দ্বিতীয়ত, সরকারের দাবি যে, পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার দেশের বেকারত্বের হারের প্রায় অর্ধেক। তা হলে এ রাজ্য থেকে দেশের বিভিন্ন অগ্রণী রাজ্যগুলিতে যে বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক যান— শুধু ঝকঝকে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় নয়, দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মতো শহরে গৃহস্থালিতে রান্না, ঘরবাড়ি পরিষ্কারের কর্মী থেকে বিভিন্ন রাজ্যে খেতমজুর বা নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে— তাঁরা কি দেশভ্রমণে গিয়েছেন?
তৃতীয়ত, তৃণমূল সরকার নিজেদের অভিনন্দন জানিয়েছে যে, রাজ্যের নিজস্ব কর-বাবদ আয় চার গুণের বেশি বেড়ে ২০২৩-২৪ সালে ৯০,০০০ কোটি টাকা হয়েছে। কিন্তু তৃণমূলের প্রায় দেড় দশক শাসনের পরেও এ রাজ্যের নিজস্ব আয় রাজ্যের রাজস্ব ব্যয়ের মাত্র ৪০%— সেখানে হরিয়ানা, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা ও ওড়িশায় এই পরিমাপ ৬৫ শতাংশের উপরে। আবারও প্রশ্ন, আমরা কি দেশের অগ্রণী রাজ্যগুলির সঙ্গে তুলনা করার কথা ভুলে যাব?
চতুর্থত, এই বাজেটের সংশোধিত অনুমানে দেখা যাচ্ছে, চলতি আর্থিক বছরে (২০২৪-২৫) রাজস্ব খাতে আদায় দাঁড়াবে ২,২৭,৫৯১ কোটি টাকা— গত বাজেটে অনুমান ছিল, অঙ্কটি হবে ২,৩৬,২৫১ কোটি। অর্থাৎ, বাজেট তৈরির সময় সরকার যা আশা করেছিল, এখন হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে রাজস্ব খাতে আদায়ের পরিমাণ তার তুলনায় ৮,৬৬০ কোটি কম। ঘটনাটি শুধু এ বছরই ঘটছে না— ২০১৬-১৭ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব আদায়ের বাজেট অনুমানের চেয়ে সংশোধিত অনুমানের পরিমাণ কম; আবার সংশোধিত অনুমানের চেয়েও কম আদায়ের প্রকৃত অঙ্কটি। কেন?
সরকার কি বাজেটে আমাদের অনেক রাজস্ব আদায়ের স্বপ্ন দেখায়, যাতে বাজেট পেশ করার সময় বলা যায় যে, অতিরিক্ত ঋণ না করে, বা রাজকোষ ঘাটতি না বাড়িয়েই কল্যাণ খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে চলা যাবে? তার পর, রাজস্বের স্বপ্ন যখন ভেঙে যায়, তখন সরকার বাজেট অনুমানের চেয়ে কম খরচ করে, তা-ও মূলত মূলধনি খাতে। যেমন ধরুন, ২০২৪-২৫’এর বাজেটে সরকার উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের জন্য স্টেট ডেভলপমেন্ট স্কিম-এ ৮৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করবে বলেছিল— এই বাজেটের সংশোধিত অনুমানে অঙ্কটি প্রায় ৪০% কমে ৫৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দু’-এক বছর রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত অনুমানের পরিমাণ বাজেট অনুমানের চেয়ে কম হতেই পারে— কিন্তু প্রায় প্রত্যেক বছর সেটা হলে সন্দেহ হয় যে, সরকার সচেতন ভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
রাজ্যের আর্থিক সঙ্গিন অবস্থা সম্বন্ধে বাজেট নীরব। ২০১১-১২ সালে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭,৭০৫ কোটি টাকা; ২০২৪-২৫’এর সংশোধিত অনুমানে তা ৭৩,০১৮ কোটি, এবং ২০২৫-২৬’এর জন্য বাজেট অনুমান ৭৩,১৭৭ কোটি। রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিএসডিপি) অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ২০২৩-২৪ সালের ৩.২৭% এবং ২০২৪-২৫’এর বাজেট অনুমান ৩.৭৬% থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫’এর সংশোধিত অনুমানে দাঁড়িয়েছে ৪.০২%; ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতির বাজেট অনুমান ৩.৬০%। অর্থাৎ, দেড় দশকের তৃণমূল শাসনের পরেও ২০২৫-২৬’এ রাজকোষ ঘাটতির বাজেট অনুমান ২০১১-১২ সালের ৩.৪০ শতাংশের চেয়ে বেশি।
সরকারি দেনার ভার ২০১১-১২ সালের ১,৮৭,৩৮৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে, ২০২৪-২৫’এর সংশোধিত অনুমানে ৭,০৬৫,৩২ কোটি টাকা, এবং ২০২৫-২৬’এর বাজেট অনুমানে ৭,৭১,৬৭০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর আগে সরকার প্রবোধ দিত যে, জিএসডিপি-র অনুপাতে দেনার ভার কমছে। কিন্তু, সেই ভরসাও ভেঙে গেছে। জিএসডিপি-র অনুপাতে দেনা ২০১১-১২ সালের ৩৯.৯১% থেকে কমে ২০১৮-১৯ সালে হয়েছিল ৩৫.৬৯%; তা আবার বেড়ে ২০২৪-২৫’এর সংশোধিত অনুমানে ৩৮.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২৫-২৬’এ এই অনুপাত কমে ৩৭.৯৮ শতাংশে দাঁড়াবে বলে সরকার আশ্বাস দিচ্ছে বটে, কিন্তু এত আশাভঙ্গের পরে কি ফের নতুন করে ভরসা করার সাহস হয়?
বাজেটে খরচের যে প্রতিশ্রুতি সরকার দেয়, প্রকৃতপক্ষে সে খরচ সরকার করতে পারছে না, করছেও না। শুধু প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। দু’টি উদাহরণ দিই। প্রথম উদাহরণ: সরকারের দাবি, রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪২। তারই মধ্যে একটি দক্ষিণ দিনাজপুর বিশ্ববিদ্যালয়। এটি স্থাপিত হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু আজও তার নেই কোনও ক্যাম্পাস, কোনও ক্লাসরুম, শিক্ষক, বা পাঠাগার।
দ্বিতীয় উদাহরণ: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অষ্টম বেঙ্গল গ্লোবাল বিজ়নেস সামিটে বিপুল বিনিয়োগের প্রস্তাব (৪,৪০,৫৯৫ কোটি টাকা) এবং ২১২টি সমঝোতাপত্র ও লেটার অব ইনটেন্ট স্বাক্ষর। আগের সাতটি সম্মেলনের প্রস্তাবগুলির, এবং সমঝোতাপত্র ও লেটার অব ইনটেন্টগুলির কী হল? কেউই কি সে খবর জানেন? এ বারে ঘোষিত ১,২৪০ মিলিয়ন টন কয়লা ও ২,৬০০ মিলিয়ন টন ব্যাসল্টে সমৃদ্ধ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক ডেউচা পাঁচামির কথাই ধরুন। সরকার ঘোষণা করেছে যে, অতিরিক্ত কয়লা নিষ্কাশনের অংশ হিসাবে ব্যাসল্ট মাইনিংয়ের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিভ্রাট শেষ হয়নি। উপরন্তু, এই বিশাল প্রকল্পের মূলধন কোথা থেকে আসবে, এবং ব্যবসায়িক সঙ্গী কে হবে এবং কী শর্তসাপেক্ষে, সে সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ তো ছেড়েই দিন, আমরা বিষয়করাও কিছুই জানি না। ডেউচা পাঁচামিও কি শুধু প্রতিশ্রুতিই থেকে যাবে?
সরকার যে অনুদান প্রকল্পগুলির উপরে জোর দিয়েছে, সেগুলি কিছু দরিদ্রকে সাময়িক সাহায্য করেছে, কিন্তু স্থায়ী ভাবে দারিদ্রের সমস্যার সমাধান করেনি। বেলাগাম দুর্নীতি হয়েছে, টাকা তছরুপ হয়েছে, অনেক অযোগ্য প্রার্থী সুবিধা পেয়েছেন, আর যোগ্যরা বঞ্চিত হয়েছেন। চাহিদা বাড়ার ফলে উৎপাদন বেড়েছে— কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নয়, বেড়েছে দেশের অন্যান্য অগ্রণী রাজ্যে। বর্ধিত চাহিদা মেটাতে হয়তো গুজরাত কিংবা তামিলনাড়ুর কোনও কারখানা মাল জোগান দিচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের আয় এবং উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন জোগান-নির্ভর নীতি। চাই গভীর সমুদ্র বন্দর, যানজটমুক্ত হাইওয়ে, সুলভ বিদ্যুৎ, এবং সুপরিকল্পিত বড় আধুনিক শহর এবং শিল্প পার্ক। তৃণমূল সরকার খেলা-মেলার হুজুগে এই নীতিগুলির উপরে জোর দিচ্ছে না। মূলধনি ব্যয় পুরো ব্যয়ের মাত্র ৩.৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পরিকাঠামোয় এত কম বিনিয়োগ করলে উন্নয়ন কী করে হবে? অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখুন, পশ্চিমবঙ্গ অনেক পিছিয়ে। ২০২৩-২৪’এর বাজেট অনুমানে উত্তরপ্রদেশে এই অনুপাত ১৭.৬%, মহারাষ্ট্রে ১০.৮%, গুজরাতে ৭.৯%, কর্নাটকে ৬.৬%, মধ্যপ্রদেশে ৬.১%, ওড়িশায় ৫.৮%, এবং তামিলনাড়ুতে ৫.১%। এর পরও কি এই সব অগ্রণী রাজ্যের রাস্তাঘাট, বন্দর, শহর দেখে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনা করে বিস্মিত হবেন?
রাজ্যের কৃষি সেচ, সার এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষমাণ। এখনও একরপ্রতি উৎপাদনশীলতায় পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে। বাঙালি ভিটে ছেড়ে চলে যাচ্ছে দূরান্তে— শুধু কর্মসংস্থানের জন্য নয়; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার জন্যেও। সরকারকে অনুরোধ: প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন; এবং যে প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়ে পূরণ করতে পারেননি, তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন, এবং আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া বন্ধ করুন।
বিধায়ক, বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গ