প্রহারেণ: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস-এ প্যালেস্টাইনের সমর্থনে ছাত্রদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও পুলিশ, ২ মে। ছবি: রয়টার্স।
১৯২৯ সালে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ চিন্তক ডুবয়েস রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে একটি দু’-পাতার লেখা প্রকাশ করেন। কবির একটি চিঠি অবলম্বন করে ডুবয়েস আত্মসমীক্ষা করেন: রবীন্দ্রনাথের বিশ্বময় চিন্তাজগতের তুলনায় আমেরিকা কি ক্ষুদ্র, ‘প্রভিনশিয়াল’, ‘সাদা-কালো’ জাতিভেদের খাঁচায় বন্দি? আমেরিকানরা সচরাচর এ জাতীয় আত্মসমালোচনা করেন না; ডুবয়েস করতেন, তিনি স্পষ্ট লেখেন, রবীন্দ্রনাথ আমেরিকাকে এতই ক্ষুদ্র এবং অভদ্র মনে করেন যে, বহু অনুষ্ঠান বাতিল করে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এশীয়দের প্রতি ঘৃণা দেখে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়-সফর সম্পূর্ণ বাতিল করেছিলেন।
এক শতক পরে আমেরিকার শিক্ষাঙ্গনে সেই ঘৃণা পুনঃপ্রকাশ করেছে। এত দিন সেই ঘৃণা নানা ছলনা দিয়ে ঢাকা ছিল; গাজ়ার যুদ্ধের পরে তা একেবারে নগ্ন হয়ে পড়েছে। গত এক বছর ধরে শিক্ষাঙ্গনে এই প্রতিবাদ নিয়ে ঘরে-বাইরে অনেক কথা লেখা হয়েছে। যে প্রসঙ্গটা প্রায়ই বাদ পড়ে গেছে সে কথাটা হল এই প্রতিবাদে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণবিদ্বেষী দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়েছে। এর আগে বহু ক্ষেত্রে মূলত শ্বেতাঙ্গ ছাত্রেরা প্রতিবাদ করেছে, কখনও বেশ উগ্র পদ্ধতিতে। ছাত্রদের ইউনিয়নের দাবিতে ধর্না-ধর্মঘট এখন আমেরিকায় নিত্যকার ঘটনা, পরিবেশবাদীরাও অবস্থাবিশেষে যথেষ্ট জঙ্গি হতে পারে। কখনও কলেজ কর্তৃপক্ষ এমন নির্বিচারে পুলিশ ডাকার কথা ভাবতে পারেননি। অথচ এ বার প্রত্যাঘাত হল দ্রুত এবং নিষ্ঠুর। বার্তা স্পষ্ট: এশীয় ছাত্রদের বুঝিয়ে দাও, তাদের দয়া করে পড়তে দেওয়া হচ্ছে এই ঢের, বেসুরো বাজলে ক্ষমা করা হবে না।
শিক্ষাঙ্গনে গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকার আত্মম্ভরিতার শেষ নেই। ভারতে, চিনে, হংকং-এ বা পূর্ব ইউরোপে ছাত্রদের উপর রাষ্ট্রের আক্রমণ নিয়ে সে দেশের পত্রপত্রিকা নিয়ম করে সমালোচনা করে। উল্টে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন মুক্তচিন্তার আসর, সেখানে সমস্ত মতের সৌহার্দ, তারাই ভিয়েতনামের যুদ্ধ থামিয়েছিল, ইত্যাদি।
এ দিকে আমেরিকার শিক্ষাঙ্গনের দৈন্যদশা প্রকট হয়ে পড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ধনকুবেরদের টাকায় কেনা পুতুলমাত্র, তাও প্রকাশ হয়ে পড়েছে, অঙ্কটা সোজা। যাঁরা পয়সা দেন, তাঁদের ইজ়রায়েলের নিন্দে সইবে না, তার চেয়েও বড় অ-শ্বেতাঙ্গ ছাত্র-অধ্যাপকদের বাড়বাড়ন্ত সইবে না। অতএব তাঁদের খুশি করতে ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকো, সাসপেন্ড করো, যা খুশি। টাকা বড় বালাই, সে দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও (আমেরিকায় বলে ‘প্রেসিডেন্ট’) নিরুপায়। দাতাদের কথা না শুনলে তাঁদেরও পলকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
অধঃপতন এক দিনে ঘটেনি। হার্ভার্ডের কথাই ধরা যাক। তারা বহু দিন ধরে বড় পুঁজির উপাসক। ২০১৮ সালে, প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার চার দিন পর ড্রিউ গিলপিন ফাউস্ট গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর ডিরেক্টর হিসাবে যোগ দেন। কয়েক বছর পর রিপাবলিকান ধনকুবের কেনেথ গ্রিফিনের থেকে তারা এত কোটি টাকা নেয় যে নির্লজ্জ কৃতজ্ঞতায় মূল ডক্টরেট-প্রদানকারী কলেজটাই তাঁর নামে করে দেয়। টাকার লোভে নেতা আর ব্যবসায়ীদের কাছে শিক্ষাঙ্গন বিকিয়ে দিতে দিতে, দানের দেনার ফাঁসে পড়ে আজকে পাপের ভারা পূর্ণ হয়েছে। গত বছর হার্ভার্ডের তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে আমেরিকার কংগ্রেসের ট্রাম্প-পন্থীরা তলব করে গোটা দেশের সামনে হেনস্থা করেন, এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রায় পালিয়ে বাঁচতে হয়। তিনি যে আদতে খুব প্রতিবাদীদের পক্ষে ছিলেন তা কিন্তু নয়; তিনিও নিজের গা বাঁচিয়ে বড় পুঁজির কাজই করছিলেন। কিন্তু নেতারা ক্ষমতা পেলে আরও বেশি ক্ষমতা চান, ব্যবসায়ীরা মুনাফা পেলে আরও বেশি মুনাফা চান। তখন নিজেদের লোককে বলি দিতেও তাঁদের অসুবিধা হয় না।
এই টাকার খেলার সঙ্গে প্রতিবাদ এবং বর্ণবিদ্বেষের কী সম্পর্ক? সোজা কথা, ছাত্ররা যে প্রসঙ্গে বিক্ষোভ করছে, তাদের পিছনে কোনও টাকা বা গোষ্ঠীর সমর্থন নেই, সেটা সরল ভাবেই একটা ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন, এবং এই প্রতিবাদী ছাত্রদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা এটাই। আজকে শ্বেতাঙ্গ ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকলে রিপাবলিকানরা তেড়ে আসবে, কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকলে ডেমোক্র্যাটরা আসবে, কিন্তু গাজ়ার জন্য কথা বলা ছাত্রদের জন্য কেউ নেই। এশিয়ার যে সমস্ত পুঁজিপতিরা টাকা দেন, চিন বা ভারতের শিল্পপতিরা, বা আরবের তৈল-সুলতানরা, তাঁরা এই সমস্ত ঝুটঝামেলায় জড়াবেন না। মিশিগানের আরব-সম্প্রদায় একজোট হয়ে গাজ়া-প্রশ্নে বাইডেনের বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু তাদের ক্ষমতা ওইটুকুই।
৯/১১-র পর থেকে মুসলমান গোষ্ঠী মানেই যে সন্ত্রাসবাদী, সেই কথাটা আমেরিকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই প্যালেস্টাইনপন্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশি দাওয়াইটাই ঠিক বলে অনেকে মনে করেন। ঠিক এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্ভয়ে পুলিশ ডেকেছে; কিছু কিছু প্রশাসক তার জন্য বাহবা এবং পদোন্নতি পেয়েছেন, কেউ কেউ সুবিধামতো পালিয়ে বেঁচেছেন।
গত এক বছরে আমেরিকার সর্বত্র এক নতুন, বাজার-নির্ভর বর্ণবিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। সে দেশে ধ্রুপদী বর্ণবিদ্বেষ সামাজিক, ভারতের জাতিভেদের মতো: সাদা-কালোর দাস-মালিকের সম্পর্ক, তারা ছোঁয়াছুঁয়ি করবে না, ইত্যাদি। এ সবের যুগ গিয়েছে, বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, হয়তো কমলা হ্যারিসও হবেন। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ এঁদের জন্য বাজারি কোনও ক্ষতি হয় না, বরং যে কৃষ্ণাঙ্গ উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণি গত পঞ্চাশ বছরে সৃষ্টি হয়েছে, তাদেরও সমর্থন পাওয়া যায়। গোলমাল বাধে তখন, যখন অশ্বেতাঙ্গ মানুষ এমন কথা বলেন বা কাজ করেন যাতে মুনাফার ক্ষতি হয়।
কলেজের কথাটাই ধরা যাক। যত ক্ষণ সব বর্ণের মানুষ পুঁজির স্বার্থে কাজ করবেন, তাঁদের বাহবা-পুরস্কারে ভরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যদি অশ্বেতাঙ্গ শিক্ষক-ছাত্ররা এমন কিছু কাজ করেন যাতে ধনী দাতাদের গোসা হয়, সে কাজের মান বা নীতি যতই ভাল হোক না কেন, পুলিশ পর্যন্ত ডাকা হতে পারে।
শিক্ষাঙ্গনে এই বাজার-নির্ভরতা শুরু হয় ২০০৮ সালের মন্দার পর, এবং তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে কোভিডের পর। এর মধ্যে আবার ছিল ট্রাম্প যুগ, যখন কলেজে কলেজে ট্রাম্প-বিরোধিতা শুরু হয়, এবং ট্রাম্প শোধ নেওয়ার জন্য তাদের ভাতে মারেন। একের পর এক সরকারি সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। কিছু রাজ্যে তো অধ্যাপকদের পাকা চাকরির ব্যবস্থাই তুলে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। সরকারি সাহায্য পেতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বাজার-নির্ভরতা আরও বাড়ে। খুদকুঁড়ো যা পাওয়া যায়, তা-ই সই, এই মন্ত্র নিয়ে চলছে তারা, এবং জ্ঞানচর্চা বা মুক্তচিন্তার ঔদার্যের মতো বাজে কারণে তারা অর্থসাহায্য হারাবার অবস্থায় নেই।
১৯২০-র দশকে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার শিক্ষাঙ্গনে যে অসহিষ্ণুতা এবং ক্ষুদ্রতা দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন, ২০২০-র দশকে তা নতুন, বাজারি বর্ণবিদ্বেষ হয়ে ফিরে এসেছে। আমেরিকায় শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে, কলেজ-প্রশাসকরা ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন, আবার বুঝি এই সব অহেতুক ঝামেলায় কিছু টাকা গলে যায়। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথা মিনুশ শফিক, যিনি বিশ্ব ব্যাঙ্কে কাজ করার অভিজ্ঞতা দেখিয়ে গত বছর চাকরিটি পেয়েছিলেন এবং সুযোগ বুঝে নিজেদের অধ্যাপক ও ছাত্রদের নাম বলে এসেছিলেন পুলিশের কাছে, বছর শুরু হওয়ার আগেই ছুতো দেখিয়ে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় নির্দেশিকা জারি করছে, কী কী ভাবে প্রতিবাদ করা যাবে না। বেশ কিছু জায়গায় নতুন প্রশাসক এসেছেন, যাঁরা পুরনো চাকরিতে ছাত্র পিটিয়ে বেশ নাম করেছেন। এক জায়গায় তো খোদ এক জাঁদরেল সেনানায়ককে বসানো হয়েছে, কলেজে নিয়ম-কানুন ফেরানোর জন্য। এত দিন আমেরিকান কাগজপত্র এই জাতীয় ঘটনার উল্লেখ করে নিন্দা করত এশিয়ার কলেজগুলির, যা তাদের বিচারে ছিল অ-গণতান্ত্রিক। এখন আমেরিকার কলেজের দমবন্ধ পরিস্থিতির বিষয়ে তারা কতটা সরব হয় সেটাই দেখার।
বাজার-নির্ভরতার মূল সমস্যা হল বাজার নিম্নমুখী হলে মৃত্যু রোখা যায় না। আমেরিকার এক শ্রেণির মানুষ সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলে এবং বাজার ধসে পড়লে নিঃস্ব হয়। একদা পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এখন সেই অভ্যাসে পড়েছে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথা হিসাবে বসানো হয়েছে বাজারি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকেদের। ফল অনিবার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গৌরব অতীত: তারা এখন ক্ষয়িষ্ণু। এই ক্ষয় বাড়তে থাকবে, কারণ জ্ঞানের উৎকর্ষের চেয়ে মুনাফার লোভ বেশি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করা যায় এই ঘটনা থেকে শিক্ষা ও মুক্তচিন্তা বিষয়ে আমেরিকান ঔদ্ধত্য খানিক খর্ব হবে, এবং ডুবয়েসের মতো সে-দেশের কিছু চিন্তক আত্মসমীক্ষা করার অবকাশ পাবেন।