প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ
Republic day

সংবিধানের উপর সহস্র কোপ মারার এই পরিকল্পনা বিপজ্জনক

আমাদের সংবিধান তৈরির যে পদ্ধতি, এবং সেই সংবিধান প্রয়োগের যে ইতিহাস, সে বিষয়ে আলোচনা কিন্তু তুলনায় অনেকটাই কম!

Advertisement

রণজয় সেন

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:০৩
Share:

ঐতিহাসিক: ভারতীয় সংবিধানে স্বাক্ষর করছেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের কাছ থেকে যে দিনটিতে দেশকে স্বাধীন করা গিয়েছিল সেটি আমাদের স্বাধীনতা দিবস। প্রজাতন্ত্র দিবসের গুরুত্বটা তা হলে কোথায়? কেবলমাত্র ভারতীয়দের নিয়ে গঠিত একটি সংবিধান-সভার তৈরি সংবিধানকে ঘিরেই এই দিনটির গুরুত্ব— প্রথমে এই কথাটা আমাদের বোঝা দরকার। বোঝা দরকার, এই দিনটির মধ্যে একটি ধ্রুবতারার সন্ধান রয়েছে। ভারতীয়ের হাতে তৈরি ভারতীয় সংবিধান, যা আবার বিশ্বের মধ্যে দীর্ঘতম; আমাদের মনে রাখা দরকার, এটাই কিন্তু ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্র’-এর প্রধান ভিত্তি— ‘কর্নারস্টোন’, যদি আমেরিকান গবেষক গ্রানভিল অস্টিন-এর ভাষা ধার করে বলি।

Advertisement

ইংরেজের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কত বিশদ আলোচনা ও গবেষণা ইতিমধ্যে হয়েছে। অথচ, আমাদের সংবিধান তৈরির যে পদ্ধতি, এবং সেই সংবিধান প্রয়োগের যে ইতিহাস, সে বিষয়ে আলোচনা কিন্তু তুলনায় অনেকটাই কম! ব্রিটিশ ভারতের ‘সাংবিধানিক ইতিহাস’ নিয়ে বেশ কয়েকটি বই আছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিতে স্বাধীন ভারতের সংবিধান নিয়ে পর্যালোচনা অনেক দিন পর্যন্ত আমরা প্রায় পড়তে পাইনি বললেই চলে। গ্রানভিল অস্টিনই হলেন সেই বিশেষজ্ঞ, যিনি এই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন— সংবিধান-পাঠের শুকনো, নীরস, অতি-আইনগত পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এসে একটা অসামান্য গবেষণা আমাদের উপহার দিয়েছিলেন ওয়ার্কিং আ ডেমোক্র্যাটিক কনস্টিটিউশন: আ হিস্ট্রি অব দি ইন্ডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স বইতে, যার প্রথম প্রকাশ ১৯৯৯ সালে। তার পরও কেটে গিয়েছে কিছু সময়। সাম্প্রতিক কালে আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি ভারতীয় সংবিধান নিয়ে নতুন কাজ প্রকাশিত হচ্ছে, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল মাধব খোসলা ও রোহিত দে-র বই দু’টি। আমাদের সংবিধানের উপর উজ্জ্বল একটা আলো ফেলেছেন এঁরা, আলো ফেলেছেন কেবল সংবিধানের উপর নয়, ভারতীয় গণতন্ত্রে বিচারব্যবস্থার উপরও।

সংবিধান ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিয়ে চর্চার এই পুনর্জাগরণের পাশে অবশ্য ব্যবহারিক রাজনীতিতে ৭২ বছরের সংবিধানটিকে ক্রমশই যেন দুর্বল, মলিন দেখাতে শুরু করেছে। ভারতীয় রাজনীতিতে যাঁরা বর্তমান শিরোনেতা, তাঁদের কাছে সাংবিধানিক নৈতিকতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা যে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেটা ইতিমধ্যে যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার। যদিও বেশ কিছু ক্ষেত্রে (যেমন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ) সংসদে যথাযথ আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকার বড় পদক্ষেপ করেছে, তাতেও কিন্তু আমরা বলতে পারি না যে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের লক্ষ্য হল ভারতীয় সংবিধানকে মৌলিক ভাবে পাল্টে ফেলা। ব্যাপারটা ঠিক অতটা সরল নয়। আইনবিশারদ তরুণাভ খৈতান দেখিয়েছেন, সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থার সময়ে যেমন ভারতীয় গণতন্ত্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলির উপর ‘সরাসরি’ আক্রমণ নেমে এসেছিল, এখনকার পরিস্থিতি সে রকম নয়। এখন যেটা হচ্ছে, তাকে বরং আমরা বলতে পারি ‘ক্রমান্বিত’ (‘ইনক্রিমেন্টাল’) ক্ষয়— সংবিধানের উপর ‘সহস্র কোপ’ মারার পদ্ধতি। আমেরিকান সংবিধান-বিশেষজ্ঞ টম গিনসবার্গ এবং আজ়িজ় হক একেই বর্ণনা করেছেন ‘সাংবিধানিক পশ্চাদপসরণ’ হিসাবে— গণতন্ত্রের এক ক্রমান্বিত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৌলিক, অবক্ষয় নিশ্চিত করছে এই ‘পশ্চাদপসরণ’।

Advertisement

এ কথা মানতেই হবে যে, এই প্রবণতা একেবারে নতুন নয়। স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের প্রথম বছরগুলি থেকেই শুরু হয়েছে মৌলিক অধিকারের এই ‘পশ্চাদপসরণ’। আমরা মনে করতে পারি সংবিধানের একেবারে প্রথম সংশোধনটির কথা। প্রভিশনাল পার্লামেন্ট কাজ করছিল তখন, স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন তখনও সামনে। এমন সময়ে ঘটে গেল এই বিপুলপ্রভাব-সম্পন্ন বিতর্কিত ‘সংশোধন’টি। পরবর্তী অনেক সংবিধান সংশোধনের মতোই, এই প্রথম সংশোধনটিরও প্রয়োজন আংশিক ভাবে এসেছিল সরকারের একটা আদর্শ-জনিত উদ্বেগ থেকে, এবং তার পিছনে অংশত ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রকে আগের চেয়ে বেশি দৃঢ় করার লক্ষ্য। এটাও এখানে মনে রাখা দরকার যে, সেই পরিবর্তনটা এসেছিল বিচারবিভাগের বিশেষ কিছু ‘রুলিং’ বা রায়ের বিরোধিতা করার জন্যই। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, বিরক্ত-বিব্রত জওহরলাল নেহরু সেই সময়ে সংসদে বলেছিলেন, “আমাদের নিজেদেরই তৈরি অসামান্য সংবিধানটি যেন আইনজীবীদের হাতসাফাই-এর ফলে চুরি হয়ে গেল।” প্রসঙ্গত, প্রথম সংবিধান সংশোধনীর ফলে বাক্‌স্বাধীনতা হ্রাস হয়েছিল, জাতভিত্তিক সংরক্ষণ চালু হয়েছিল, সম্পত্তির অধিকার কমিয়ে ভূমিসংস্কার চালু হয়েছিল।

আমরা সবাই জানি, ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালেই সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকটি বিরুদ্ধমতাবলম্বী রায়ের ফলে সংবিধানের বড় বড় কিছু সংশোধন হয়। এর মধ্যে ছিল ১৯৭৩ সালের ‘কেশবানন্দ ভারতী রায়’— স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত রায়গুলির একটি। সুপ্রিম কোর্টের সে-যাবৎ সর্বাধিক সংখ্যক তেরো জন বিচারকের বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল। ১১টি আলাদা মত শোনা গিয়েছিল এই রায়ে, এবং প্রথম বারের জন্য এই বেঞ্চ সূচনা করল ‘বেসিক স্ট্রাকচার’ বা ‘মূলগত কাঠামো’ নীতিটির। বলা হল, ভারতীয় সংসদের ‘সংবিধানের
মূলগত কাঠামো পাল্টানোর’ ক্ষমতা বা অধিকার নেই!

অতঃপর, সেই কুখ্যাত জরুরি অবস্থা। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বিচারবিভাগের উপর প্রতি-আক্রমণ শাণাল। ৪২তম সংশোধনী জারি হল, যাতে বলা হল কিছু কিছু সংশোধনী নিয়ে বিচারবিভাগে কোনও মামলা করা যাবে না। এবং সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদীয় ক্ষমতার অধিকার হবে প্রশ্নাতীত। শেষ অবধি, অতি ক্ষণস্থায়ী জনতা সরকারের উপরেই দায়িত্ব পড়ল প্রজাতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে এনে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর।

চার দশক কেটে গিয়েছে তার পর। আমরা আবার এক যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে কর্তৃত্ববাদ, সংখ্যাগুরুবাদ, জনপ্রিয়তাবাদ ইত্যাদি সব মিলেমিশে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র এবং তার সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে বিপদগ্রস্ত করতে শুরু করেছে। অনেকেই এই পরিস্থিতিকে বলেছেন ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’। বাক্‌স্বাধীনতা, সাম্যের অধিকার ইত্যাদি সংবিধান-স্বীকৃত বেশ কিছু মৌলিক অধিকার ইতিমধ্যেই এমন ভাবেই সঙ্কীর্ণ কিংবা লুপ্ত করা হয়েছে, যা এই দেশ আগে কখনও দেখেনি।

আগেকার পর্বের সঙ্গে একটি তফাত অবশ্য আছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির তরফে এবং সরকারি-বহির্ভূত নাগরিক পরিসরে সংবিধানের উপর এই ক্রমান্বিত আক্রমণের বিষয়ে একটা বিরাট অবজ্ঞা আর অবহেলার ভাব এখন। প্রতি ২৬ নভেম্বর ধুমধাম করে সংবিধান দিবস উদ্‌যাপন করা হয় ঠিকই, কিন্তু এই সামাজিক-রাজনৈতিক অবহেলা চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত। আগে সংবিধানের উপর যে কোনও আক্রমণে প্রধান রক্ষকের ভূমিকা নিত আদালত। এখন বিচারবিভাগের সেই ভূমিকার কমতি দেখা যাচ্ছে বার বার।

বর্তমান সরকারের মনোভাবটা ঠিকঠাক ধরা পড়ল এই মাসের প্রথমে, যখন ‘আজ়াদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর উদ্বোধনী ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “গত ৭৫ বছরে আমরা কেবল অধিকারের কথা বলেছি, অধিকারের দাবি নিয়ে লড়াই করে সময় নষ্ট করেছি।” এবং যোগ করলেন, ‘নিজের কর্তব্য ভুলে যাওয়া’র কারণেই ‘ভারত এখনও এত দুর্বল’। ‘অধিকার’-এর উপরে উঠে এল ‘কর্তব্য’, নরেন্দ্র মোদী সরকারের মন্ত্রীরাও সে কথা মুখে মুখে ফেরালেন।

‘অগ্রপশ্চাৎ’ উল্টে দেওয়ার এই পরিকল্পনাকে বিপজ্জনক বললে কম বলা হয়। আইন-গবেষকদের ভাষায় একে বলা যায় ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মৌলিক নৈতিক আদর্শ’-এর সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement