অবশেষে আমরা হিন্দুত্বের উদ্যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, এবং বেশ আনন্দের সঙ্গেই রামনবমী নামক এক বিজাতীয় উৎসবকে আপন করে নিতে পারছি! এই যে ‘পারছি’, এর মধ্যে কেউ কেউ ‘সংস্কৃতি সততই পরিবর্তনশীল’, ইত্যাদি বলে এক রকমের ‘কালচারাল রিলেটিভিস্ট’ ব্যাখ্যা আরোপিত করবেন। কেউ বলবেন, এই নব্য হিন্দুত্বের বিরোধিতাই আসলে মৌলবাদী আচরণ। বঙ্গের হিন্দুদের সুরক্ষিত থাকার জন্য এ সব উদ্যাপন জরুরি, মানুষ দিব্যি বুঝে ফেলেছেন। যেমন বুঝেছেন, রামের নামে স্লোগান দেওয়ার সময়ে কাউকে কাউকে টুপি খুলিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো খুব জরুরি।
এই মুহূর্তে বঙ্গে নব্য রামের প্রবেশ ও বাড়বাড়ন্তের বিষয়টি গুরুতর। কে জানে, এর পর হয়তো বঙ্গবাসী ভুলেই যাবেন যে রামছাগল, রামপাঁঠা, হাঁদারাম ইত্যাদি বহুল ব্যবহৃত প্রায়-গালি আমাদের নিত্য জীবনের সঙ্গী (ছিল?)। যেমন আমরা ভুলতে বসেছি মেঘনাদ বধ কাব্য। রামনবমীর এই উদ্যাপনের শুরু ২০১৩-২০১৪ থেকে। এই সময়েই ভারতবর্ষে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটছে, কেন্দ্রে হিন্দুত্বের সরকার আসছে উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে। স্মার্ট সিটি, ডলার মূল্যের হ্রাস, সর্বোপরি দুর্নীতির অবসান, জনমানসে প্রভাব ফেলে। ঠিক এই সময়ে টিমটিম করে শুরু হয় রামনবমী, কিন্তু অচিরেই তার বাড়বাড়ন্ত হয়, এবং গত বছর সম্ভবত প্রতিটি ব্লক স্তরে রামনবমীর মিছিল, অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্র-সহ মিছিল সংগঠিত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই মিছিল যতটা ধর্মীয়, ততটাই শক্তি, আধিপত্য এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের। এই রামনবমী মিছিলকে কেন্দ্র করে প্রাণ গিয়েছে বেশ কয়েক জনের, যার মধ্যে যেমন আছেন হিন্দু যুবক, তেমনই আছেন আসানসোলের ইমামের তরতাজা সন্তান। হিংসা কাউকে রেয়াত করে না, এ কথা হয়তো বোঝেন কেউ কেউ, তাই সেই ইমাম, জানাজা থেকে হিংসা আটকাতে তৎপর হন এবং থামিয়ে দেন একটি প্রায় ঘটে-যাওয়া দাঙ্গা। রামনবমী এবং সংগঠিত হিংসার পরম্পরা পশ্চিমবঙ্গে চলতে থাকে এবং দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো সমেত প্রায় প্রতিটি উৎসবই অতি দ্রুত এই ‘ওরা আমরা’ ‘হিন্দু মুসলমান’ তরজায় ঢুকে যায়।
২০১৬ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গাচিত্র তুলে ধরতে শুরু করে একটি তথ্যানুসন্ধান দল। তারা এই সংক্রান্ত মোট ছ’টি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। প্রতিটির ছত্রে ছত্রে যেমন লেখা রয়েছে গরিব এবং নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষের সব হারানোর কাহিনি, তেমনই দাঙ্গার প্রতিরোধ এবং হিন্দু মুসলিম ঐক্যের কাহিনি। গ্রামস্তরে যেমন বিভাজন সুস্পষ্ট তেমনই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঐক্যের গল্প। পিরের মাজারে যেমন রয়েছে শরিয়াপন্থীদের আক্রমণ, তেমনই রয়েছে প্রতিরোধ ও প্রতিস্পর্ধা।
রিপোর্টগুলি ঘাঁটলে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। প্রথমত, ২০১৪-২০১৫ সাল থেকে অপরায়ণের যে পরম্পরা তৈরি হয়েছে, তা হিন্দুদের করে তুলেছে বেশি বেশি হিন্দু, আর মুসলমানদের বেশি বেশি মুসলমান। এ ক্ষেত্রে রামনবমীর মিছিল যেমন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, অনুরূপ ভাবেই ইসলামিক জলসার ভূমিকাও অনস্বীকার্য।
দ্বিতীয়ত, শুরুর দিকের রামনবমীর মিছিলে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ছবির উপস্থিতি থাকলেও, যত দিন গিয়েছে ততই বাঙালির নিজস্ব পরম্পরা ক্রমাগত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে হয়ে এক সময়ে মিলিয়ে গেছে। সেই জায়গায় উঠে এসেছে আক্রমণাত্মক হনুমান মূর্তি। এমনকি সমসাময়িক গণেশ পুজোতেও দেখা যাচ্ছে সিক্স-প্যাকযুক্ত গণেশ মূর্তি। তৃতীয়ত, রামের পতাকা, রামের স্লোগানে হিন্দির আধিপত্য। চতুর্থত, যদিও রামনবমীর মিছিল শুরু হয়েছিল মূলত হিন্দিভাষীদের নিয়ে, মূলত হিন্দিভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন জুটমিল সংলগ্ন এলাকা, আসানসোল শিল্পাঞ্চল ইত্যাদিতে ২০২৪-২০২৫ সালে এই মিছিলের উপস্থিতি সর্বাত্মক এবং প্রায়-সর্বজনীন।
পঞ্চমত, রামনবমী থেকে ছড়িয়ে পড়া হিংসা সব সময়েই পরিকল্পিত এবং এই অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদি। গবেষকরা দেখিয়েছেন, রামনবমীর মতো উৎসব কী ভাবে নানা প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক প্রয়াসে তৈরি। পশ্চিমবঙ্গে আত্মপরিচয়-কেন্দ্রিক রাজনীতির অবধারিত পরিণতি— এক প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। এই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা দু’রকম ভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে। এক, হিন্দুত্বের সর্বগ্রাসী করাল রূপ রাজ্যের দু’টি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে প্রভাবিত করে ফেলে, ফলত শুরুর দিকে তৃণমূল কংগ্রেস যেমন রামনবমী মিছিল সংগঠিত করতে চেয়েছে, দিশেহারা হয়ে হনুমান জয়ন্তী এবং পরবর্তী কালে ‘গঙ্গা আরতি’-তে মনোনিবেশ করেছে, কিংবা দিঘার মন্দির তৈরি করেছে, তেমনই মুসলমান সমাজ আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চায় শাসক দলকে, যেন এটাই তাদের শেষ আশ্রয়। হিন্দুত্বের বিস্তার, সে যে দলের হাত ধরেই হোক, যে পদ্ধতিতেই হোক, হিন্দুত্বপন্থীদের কাছে তা একান্ত ভাবে কাম্য। এ ক্ষেত্রে যদি বিজেপি ক্ষমতায় না এসেও এর প্রসার ঘটে, তাতে যে তাদের বিশেষ কিছু যায়-আসে না, সেটা পরিষ্কার।
জঙ্গলমহল মডেল আলাদা করে উল্লেখ্য। পশ্চিমবঙ্গের যে অঞ্চলে মুসলমান জুজু দেখানোর সুযোগ সীমিত, সেখানে রামের প্রবেশ কী ভাবে? হনুমানের কাঁধে চেপে। এর সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট উদাহরণ জঙ্গলমহল। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় বিজেপির উত্থান নাটকীয়, এমনকি ২০২৪-এ প্রাপ্ত ভোট কমলেও বিজেপির প্রভাব এবং হিন্দুত্বের ক্রমবর্ধমান উত্থান চোখে পড়ার মতো। এই উত্থানের নেপথ্যে রয়েছে হনুমান মন্দিরের উপস্থিতি, যা আজ জঙ্গলমহলের প্রায় সব গ্রামে বিদ্যমান। এই মন্দির পরিচালনার জন্যে রয়েছে পরিচালন কমিটি, স্থানীয় দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার নেবে পুজোর ভার, আর পরামানিক (নাপিত) পরিবার নেবে ফুল এনে দেওয়া এবং পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব। সন্ধেবেলা রামায়ণ গান কিংবা হনুমান চল্লিশা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে চলে হিন্দু রাজাদের উপর মুসলমান সম্রাটের অত্যাচারের কাহিনি, আর চলে কেন বর্তমানের কেন্দ্রীয় শাসকই পারেন ৮০ কোটি হিন্দুর দায়িত্ব নিতে, সেই ব্যাখ্যান। হনুমান মন্দিরের সূচনা জঙ্গলমহল এলাকায় হলেও, কলকাতা-সহ প্রতিটি শহরে, এমনকি জেলা শহরেও এখন এর উপস্থিতি প্রকট, ক্রমবর্ধমান। হনুমানের মূর্তি ও মন্দির গ্রামে গ্রামে আদি অনন্তকাল ধরে চলে আসা চণ্ডী, শীতলা, মনসা, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে জনজাতি গোষ্ঠীর উপাস্য দেবতাদেরও ছাপিয়ে যাচ্ছে। কারণ? প্রথমত, হনুমানের জন্য তৈরি হয়েছে বেদি, যা অতি দ্রুত পরিবর্ধিত হয়ে যাচ্ছে মন্দিরে, বাকি দেবতার জন্য এ রকম কোনও ব্যবস্থা নেই, দ্বিতীয়ত হনুমান পুজোর জন্যে রয়েছে অর্থ সংস্থান, গ্রাম স্তরে পুজোর বিনিময়ে মাসিক প্রায় ১০০০ টাকা উপার্জনের গুরুত্ব অনেক।
রাজনৈতিক হিসেবটা দেখা যাক। ২০১৪ থেকে ২০১৯-এ বিজেপির জঙ্গলমহলে সাফল্যের খতিয়ান দেখলে দেখা যাবে বাঁকুড়ায় ১৪%, পুরুলিয়ায় ৪২%, বিষ্ণুপুরে ৩২% এবং ঝাড়গ্রামে প্রায় ৩৫% ভোট বৃদ্ধি ঘটেছে। অপর দিকে তৃণমূলের ভোট যে প্রচুর কমে গেছে এমন নয়, বরং ২০১৪ থেকে ২০২৩-এর পর পর ভোটের ফল বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, দু’টি দলেরই ভোট বেড়েছে। বরং কংগ্রেস এবং বামেদের ভোট ক্রমান্বয়ে কমেছে।
এমতাবস্থায় তৃণমূল কংগ্রেসের ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলার মূল দায়ভার তাদের উপরেই বর্তায়— যদিও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে তৃণমূলের নমনীয়তা তাদের রামনবমীর মতো সংগঠিত উদ্যাপন কিংবা ইসলামিক জলসার বিরুদ্ধে কতটা সক্রিয় করতে পারে, তা বড় প্রশ্ন। বাম দলগুলি ও কংগ্রেস তাদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কার্যক্রম দিয়ে এই প্লাবন কতখানি প্রতিহত করতে পারে, দেখা যাক। কিছু কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠান সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী দল কিংবা ইসলামিক মৌলবাদের বৃহৎ সংগঠিত শক্তির কাছে তা নিতান্তই অপ্রতুল।
নৃতত্ত্ব বিভাগ, ড. এ পি জে আবদুল কালাম সরকারি কলেজ