দামোদরের উপরে বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা আজও অসম্পূর্ণ
Damodar River

বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য

বন্যার জল বাঁকা, বেহুলা, গাঙুর, ঘিয়া, কুন্তি, কানা দামোদর ইত্যাদি শাখানদী ধরে হুগলি ও বর্ধমানের কৃষিজমিতে ছড়িয়ে যেত। এ ছাড়া কৃষকরা শাখানদীর পাড় কেটে বন্যার জল কৃষিজমিতে নিয়ে যেতেন।

Advertisement

কল্যাণ রুদ্র

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:৩৯
Share:

দামোদর এমন এক বিরল নদী অববাহিকা, যার উজানের অংশ কয়লা, মাইকা, বক্সাইট ইত্যাদি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ; আর ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে নেমে বন্যার জল ও পলিতে লালিত নিম্ন-দামোদর অববাহিকা এত উর্বর যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বর্ধমান জেলা ছিল কৃষি উৎপাদনে ভারতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বন্যার জল বাঁকা, বেহুলা, গাঙুর, ঘিয়া, কুন্তি, কানা দামোদর ইত্যাদি শাখানদী ধরে হুগলি ও বর্ধমানের কৃষিজমিতে ছড়িয়ে যেত। এ ছাড়া কৃষকরা শাখানদীর পাড় কেটে বন্যার জল কৃষিজমিতে নিয়ে যেতেন। বন্যার জল-পলি ব্যবহারের এই ব্যবস্থাকে বলা হত প্লাবনসেচ। যে নদী একদা অকাতরে সমৃদ্ধি বিলিয়েছিল, সেই নদীকেই সাহেবরা নাম দিয়েছিল ‘বাংলার দুঃখ’; স্বাধীনতার আট দশক পরেও স্কুল-পাঠ্য ভূগোল বইতে সেই ঔপনিবেশিক ভ্রান্ত শিক্ষা অব্যাহত।

Advertisement

দামোদরের জলে প্রায় প্রতি বছর প্লাবিত হত জিটি রোড, বিচ্ছিন্ন হত রেললাইন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দামোদরের দুই পাড় বরাবর মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছিল বর্ধমানে রাজার শাসন কালে— রাজবাঁধ নামে স্থানটি আজও সেই ইতিহাস বহন করে চলেছে। দামোদর নদীর বিপুল জলস্রোত দুই পাড়ের বাঁধের মধ্যে বন্দি রাখা অসম্ভব বুঝে ১৮৫৬-১৮৭০ সালে ডান পাড়ের প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, এবং একই সঙ্গে বাম পাড়ের বাঁধকে আরও মজবুত করা হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তের পর জিটি রোড, রেললাইন, পানাগড় সেনা ছাউনি ও বর্ধমান শহর কিছুটা সুরক্ষিত হলেও ঘাটাল, খানাকুল, গোঘাট ইত্যাদি এলাকার দুর্দশা বাড়ল। যে বন্যার স্রোত এক সময় সাতটি শাখানদী ধরে পূর্ব বর্ধমান ও হুগলির দিকে বয়ে যেত, সেই ধারাই দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নতুন পথ করে নিল মুণ্ডেশ্বরী নদীর পথ ধরে।

১৯৩৯-১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পর পর তিনটি ভয়াবহ বন্যার (১৯৪১, ১৯৪২, ১৯৪৩) পরে দামোদরের বন্যা নিয়ন্ত্রণের নতুন ভাবনা শুরু হল। বর্ধমানের মহারাজা উদয়চাঁদ মেহতাবের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল এক বন্যা অনুসন্ধান কমিটি, যার সদস্য ছিলেন মেঘনাদ সাহাও। ১৯৪৪ সালে কমিটির সেই রিপোর্ট বহুমুখী দামোদর পরিকল্পনার রূপরেখার সূচনা করেছিল। স্বাধীনতার পরে সেই কমিটির সুপারিশ মাথায় রেখে দামোদর পরিকল্পনার একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি হল। এ বার পরিকল্পনার রূপরেখা রচনা করলেন ডব্লিউ এল ভুরডুইন। যে চারটি বিষয়ের উপরে গুরুত্ব দেওয়া হল, সেগুলি হল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ব্যবস্থার প্রসার, শক্তি উৎপাদন এবং নৌপরিবহণ। অনুসন্ধান ও গবেষণা করে ভুরডুইন দেখলেন যে, অববাহিকায় ১৩৫ ইঞ্চি (৩৪৩ মিলিমিটার) বৃষ্টি হলে বর্ধমানের রন্ডিয়াতে ১০ লক্ষ কিউসেক জল প্রবাহিত হবে। তিনি সুপারিশ করলেন, অববাহিকার উজানে সাতটি জলাধারে ৪৭ লক্ষ একর-ফিট জল সংরক্ষণ করলে ওই প্রবাহকে ২.৫০ লক্ষ কিউসেক-এ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, এবং ওই পরিমাণ জল দামোদর ধারণ করতে পারবে। দু’কূল ছাপিয়ে বন্যা হবে না। আরও ভাবা হয়েছিল যে, জলাধার প্রত্যাশা অনুসারে জল ধারণ করলে শেষ বা প্রান্তিক জলাধারটি থেকে কোনও অবস্থাতেই ২০ হাজার কিউসেক-এর বেশি জল ছাড়তে হবে না। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ভারত সরকার ভুরডুইনের পরামর্শ একাধিক পর্যায়ে রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম পর্যায়ে তিলাইয়া, কোনার, মাইথন এবং পাঞ্চেত-এ চারটি বাঁধ-জলাধার নির্মাণ করা হয়; পরে বিহার সরকার তেনুঘাটে আরও একটি জলাধার নির্মাণ করে। ভুরডুইনের পরিকল্পনা অনুসারে অন্য তিনটি জলাধার আজ পর্যন্ত নির্মিত হয়নি।

Advertisement

১৯৫৩-১৯৫৯ সালের মধ্যে দামোদর পরিকল্পনার আংশিক রূপায়ণের পরেও বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছে। চারটি জলাধার নির্মাণের ঠিক পরেই ১৯৫৯ সালের বন্যা জলাধার-নির্ভর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গলদ প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিল। তখন জলাধারে এত পলি জমেনি; তবু জলাধার থেকে ছাড়া জল আর ভাটির দিকে জমা বৃষ্টির জল মিশে প্লাবিত করছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। জন্মলগ্নে ডিভিসি-র চারটি জলাধার অববাহিকার উজানের ১৭,২৬০ বর্গকিমি এলাকা থেকে নেমে আসা ৩৫৫ কোটি ঘনমিটার জল ধারণ করতে পারত; কিন্তু অববাহিকার নিম্নাংশের ৪,৭৫৫ বর্গকিমি এলাকার বৃষ্টির জলের উপরে ডিভিসি-র কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না, এখনও নেই। প্রস্তাবিত সাতটি জলাধারের মোট ধারণক্ষমতা হত প্রায় ৫৮০ কোটি ঘনমিটার জল।

দুর্গাপুর ব্যারাজের নীচে দামোদর এখন মাত্র ৭০-৮০ হাজার কিউসেক জল ধারণ করতে পারে। এক দিকে যেমন নদীর ধারণক্ষমতা কমেছে, অন্য দিকে চারটি জলাধারে পলি জমছে ক্রমাগত। যে-হেতু শুখা মরসুমে রবি ও বোরো চাষে সেচের জল দেওয়া ডিভিসি-র দায়িত্ব, তাই অগস্ট মাসের মধ্যেই জলাধারগুলি পূর্ণ করে রাখার চেষ্টা করা হয়। সেপ্টেম্বরে অতিবৃষ্টি হলে সেই জল ধারণ করা যায় না; জলাধার থেকে ছাড়া জল ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ জলাধার থেকে নেমে এসেছিল ২.৭৫ লক্ষ কিউসেক জল। পরিণতি আমাদের সকলের জানা।

ডিভিসি-র অন্য দু’টি লক্ষ্য ছিল সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু একই জলাধারে সংরক্ষিত জল ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের ব্যবস্থা করা যায় না। সেচের জন্য বর্ষার জল জমিয়ে রাখতে হয় শুখা মরসুম পর্যন্ত; জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জলাধার থেকে ক্রমাগত জল ছাড়তে হয়। এখন ডিভিসি নিম্ন দামোদর অববাহিকায় ৬৯,৭৯০ হেক্টর বোরো ধানের জমিতে এবং ১৮,৪৫০ হেক্টর রবি ফসলের জমিতে সেচের জল দেয়। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অক্ষমতার কথা বুঝে ১৯৯০-এর দশকে ভাবনা বদলায়। এখন ডিভিসি প্রতি বছর ৬,৫৪০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ এবং মাত্র ১৪৭ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

রাজ্য অর্থনীতিতে ডিভিসি-র উৎপাদিত তাপবিদ্যুৎ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ডিভিসি-র বিদ্যুৎ ব্যবহার করে দিল্লি, হরিয়ানা, পঞ্জাব, কর্নাটক, কেরলের মতো রাজ্য, এবং ভারতীয় রেল-সহ আরও অনেক উপভোক্তা। ডিভিসি-র পরিষেবার ক্ষেত্র বহু দূর বিস্তৃত, কিন্তু পরিবেশের অবক্ষয়ের আঘাত লেগেছে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডে। তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসংলগ্ন ছাই পুকুর উপচে কখনও পাশের কৃষিজমিতে ছড়িয়ে যায়, আবার বাতাসকেও দূষিত করে। সবচেয়ে বড় সঙ্কট হল, দুর্গাপুর ব্যারাজের ভাটিতে একদা বহমান দামোদর নদীর খাতে বালি জমে মরুভূমির রূপ নিয়েছে।

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের সব নদী পরিকল্পনার দু’টি মুখ— এক দিকে ইতিবাচক; অন্য দিকে পরিবেশের অবক্ষয়। শক্তি উৎপাদন ও শিল্পায়ন এমন যুগান্তকারী ভূমিকা পালনের পরও বানভাসিদের চোখে ডিভিসি নিতান্তই খলনায়ক। এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব নয়। নিম্ন দামোদর অববাহিকাকে সম্পূর্ণ বন্যা-মুক্ত করা না গেলেও মানুষের দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব। প্রয়োজন ভারতীয় আবহাওয়া দফতর, রাজ্য সেচ দফতরের সঙ্গে মিলে একটি আধুনিক বন্যা মোকাবিলা কর্মসূচি রূপায়ণ। এই কাজে ডিভিসি এগিয়ে আসুক, এটাই সময়ের দাবি।

সভাপতি, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement