ঠিক কোন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি রাজ্য সরকারের চাইতে বৃহদাকার নেয়? প্রতীকী ছবি
নিখরচায় ‘পাইয়ে দেওয়া’বা ‘ডোল’-এর রাজনীতির সঙ্গে উন্নয়ন খাতে খরচের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বর্তমানে চর্চার বিষয়। এই দ্বন্দ্ব আসলে এমন এক প্রাথমিক সমস্যা হিসেবে অর্থনীতিতে বিবেচিত, যার মোকাবিলা করা আশু প্রয়োজন। আসলে সমস্যাটি সীমাহীন চাহিদা এবং তা মেটানোর সীমিত উপায়ের মধ্যেকার সম্পর্কের ভিতর নিহিত। পরিবর্ত ব্যবহার করে চাহিদা মেটানোর মধ্যে এই সমস্যার শিকড়টি নিহিত রয়েছে। সে দিক থেকে দেখলেকেউ যদি বিদ্যুৎ পরিষেবায় ভর্তুকি নেওয়া ছেড়ে দেন, তা হলে কি সরকারের তরফে বিদ্যালয়গুলিতে সেই বাড়তি টাকা বিনিয়োগ করা হবে— এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। অথবা যদি কেউ স্বাস্থ্যখাতে খরচ কমিয়ে সড়ক নির্মাণে অধিকতর নজর দাবি করেন? এই বিন্দু থেকেই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ডোল’ প্রদানের বিষয়টি উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিখরচায় পণ্য বা পরিষেবা প্রদান বা ‘ডোল’তথা যাকে ‘ফ্রিবিজ’বলে ডাকা হয়, যে বস্তুটি এই মুহূর্তে এ দেশে আকছার দৃশ্যমান। শিক্ষা, কল্যাণমূলক খাতে ব্যয়, সড়কপথ নির্মাণ ইত্যাদির ভিতর এমন কিছু বিষয় বিদ্যমান, যাকে অর্থনীতিবিদরা ‘পজিটিভ এক্সটার্নালিটিজ’বলে অভিহিত করেন। অর্থাৎ, এই সব বিষয়ের মধ্যে এমন এক গণ-উপযোগমুখীনতা রয়েছে যে, তা ব্যক্তিগত স্তরের উপভোক্তার কল্যাণকে ছাড়িয়ে বহুদূর প্রসারিত হয়। সে দিক থেকে বিচার করলেতামিলনাড়ুতে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এমজি রামচন্দ্রন কর্তৃক প্রবর্তিত মিড ডে মিলের মতো বিষয়ের কী হবে?
‘ফ্রিবিজ’-এর সেই ধ্রপদী উদাহরণের অভাবিত ফল ছিল বিদ্যালয়গুলিতে বিদ্যার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতি, যার ফলে আবার সে রাজ্যের শিশুজন্মের হার দ্রুত কমে আসে। সামাজিক স্তরে এই ‘পাইয়ে দেওয়া’নিছক নিখরচার খাদ্যের মূল্যে আটকে থাকে না। তার প্রভাব হয়ে দাঁড়ায় সুদূরপ্রসারী। একই ভাবেবিনামূল্যে শৌচাগার নির্মাণ গণস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। ভর্তুকিপ্রাপ্ত রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। এ ক্ষেত্রে নারীস্বাস্থ্যের উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই সব ‘ডোল’কি কর্মনিযুক্তির নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতির পরিবর্ত হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে?
সুতরাং বিষয়টি নেহাৎ ‘ডোল’বা ‘ফ্রিবিজ’-এর মধ্যে আবদ্ধ থাকে না (প্রত্যেকেই আরও আরও বেশি পরিমাণ দাবি করতে থাকেন)।সমস্যা গিয়ে ঠেকে সাধ্যের সীমাবদ্ধতায়। কোনও সরকারের হাতে যদি টাকা থাকে, তা হলে সে যেমন ইচ্ছা ‘ডোল’প্রদান করতে পারে।যেমন দশকের পর দশক ধরে আরবের শেখরা করে এসেছেন। দিল্লিতে আম আদমি পার্টি (আপ)-র সরকার একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে সরবরাহ করতে পারে এবং বিদ্যালয়গুলিতে অর্থলগ্নি করতে পারে। কারণ, দিল্লির সরকার অর্থাভাবে ভুগছে না। কিন্তু পঞ্জাবের দিকে তাকানো গেলে দেখা যাবে, দেশের মধ্যে সবথেকে ঋণগ্রস্ত রাজ্যটিতে আপ বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি কী ভাবে ব্যাখ্যা করা হবে? ঋণের পরিমাণের দিক থেকে পঞ্জাবের পরেই নাম আসে হিমাচল প্রদেশের। সেখানেও আপ একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এমন অবস্থায় কিন্তু মূল্য চোকাতে হয় অন্য কোনও ক্ষেত্রকে। এক দিকে পরিষেবা দিতে গিয়ে অন্য খাতে বরাদ্দ কমাতে হয়। না হলে ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকে।
উন্নততর অর্থনীতির দেশগুলিতে সামাজিক নিরাপত্তা, বেকার ভাতা ইত্যাদির মতো ‘ট্রান্সফার পেমেন্ট’ (কোনও প্রকার পণ্য বা পরিষেবার বিনিময় ছাড়াই যে অর্থ প্রদত্ত হয়)বাজেটে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। সেখানে পরিকাঠামো নির্মাণ, গবেষণা বা ভবিষ্যতের উন্নতির কথা ভেবে ‘বিনিয়োগ’-এর মতো বিষয়গুলিতে কম অর্থবরাদ্দ হয়। এই বিষয়টিই কল্যাণকর রাষ্ট্রের পক্ষে ক্রমাগত দুর্বহ হয়ে দাঁড়ায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ব্রিটেনে জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছে।
সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বা বলা ভাল সে দেশের রূপকার প্রয়াত লি কুয়ান ইউ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই নীতি নির্ধারণ করেছিলেন যে, কোনও সরকার এমন কোনও খাতে যেন অর্থ ব্যয় না করে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের উপর অতিরিক্ত মাত্রায় গুরুত্ব দিতে থাকেন। যার ফলে সিঙ্গাপুরের বাসিন্দারা সহজে সরকার-প্রদত্ত আবাসনে বাড়ি কিনতে পারেন। তিনি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যখাতে অর্থ বিনিয়োগে নাগরিকদের বাধ্য করেন, যাতে তাঁরা চিকিৎসাখাতে আকস্মিক ব্যয়ের মোকাবিলা করতে পারেন। পরিবর্তে দেশবাসীর জন্য তিনি অন্য পথ উন্মুক্ত রাখেন। দেশবাসীর উপর করের বোঝা হাল্কা রাখা হয়। এই ধরনের ব্যবস্থা কি কোনও গরিব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? ভারতে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ভর্তুকি-সাপেক্ষ। স্বাস্থ্যসুরক্ষা যোজনাও তা-ই। এখন প্রশ্ন, ঠিক কোন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি রাজ্য সরকারের চাইতে বৃহদাকার নেয়?
লি-এর নীতিকে ইউরোপের ইধিকাংশ দেশই আমল দেয়নি। আজীবনের জন্য প্রদেয় কল্যাণকর প্রকল্পের বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ করপ্রদানের বিষয়টি এক সামাজিক চুক্তির রূপ পরিগ্রহ করে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়েও লি-এর উপদেশে কর্ণপাত করা হয়নি। এমনকি, অতিমারির সময়েও নয়। একের পর এক দেশে যথেচ্ছ ভাবে অর্থ ব্যয় করা হতে থাকে।যে অর্থ তাদের নয়। এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর সঙ্গে আনুপাতিক হারে সরকারি ঋণ বাড়তে শুরু করে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা জিডিপি-র দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে ভবিষ্যতে করের পরিমাণ বাড়ে।ফুলে-ফেঁপে ওঠা ঋণের উপর প্রদেয় সুদের বোঝা বৃদ্ধি পায়। বহু দেশই এখন এই অবস্থার শিকার। ভারতও তাদের মধ্যে পড়ে, যেখানে সরকারি ঋণ এবং জিডিপি-র আনুপাতিক ব্যবধান ৮৫ শতাংশেরও বেশি (৬০ শতাংশকে কাঙ্ক্ষিত ব্যবধান বলে ধরা হয়)। যখন এই ঋণের উপর বিদ্যুতে ভর্তুকির বিপুল টাকা বাকি থেকে যায়, তখন প্রধানমন্ত্রীর তরফে সাবধানবাণী উচ্চারণ কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়।
রাজ্য সরকারগুলিতে এক বিপরীত চিত্র দেখা যায়। তারা অর্থনৈতিক সঙ্কোচনের সম্মুখীন হয়। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আদায়ীকৃত রাজস্ব থেকে তাদের যে পরিমাণ দেওয়ার কথা, তা আকস্মিক ভাবে কমে যায়। সংশোধন না করলে ‘ডোল’ বা ‘ফ্রিবিজ’প্রদান করা সম্ভব নয়। এমনকি। যাদের মধ্যে ‘এক্সটার্নালিটি’নেই, তারাও একই নির্দেশের সম্মুখীন হয়। এ জন্য সেই সব ভোটদাতাদের দোষারোপ করা যায়, যাঁরা উন্নততর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মতো সারগর্ভহীন প্রতিশ্রুতি-সমৃদ্ধ নির্বাচনী ইস্তাহারে ভরসা রেখে ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনে বিজয়ীরা যেন বলছেন— যা পাচ্ছতাতে সন্তুষ্ট হও এবং কেটে পড়ো। সুপ্রিম কোর্টের জারি করা কোনও নির্দেশ অথবা সংসদে পাশ হওয়া কোনও আইন এর সমাধান করতে পারে না। রাজকোষের দায়িত্ব সংক্রান্ত আইন (ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি ’ল) এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারেনি। এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী কি খেলার গতিতে পরিবর্তন আনতে পারবেন? তাঁর কি সেই পরিমাণ ধীশক্তি রয়েছে? প্রশ্ন থেকেই যায়।