গত কুড়ি বছরে সুন্দরবন বাস্তুজগতের এক হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ বন, দু’হাজার হেক্টরেরও বেশি পলিতট, আর চব্বিশ হাজার হেক্টরের মতো চাষের জমি চিংড়ির ভেড়িতে পরিবর্তিত হয়েছে। তার মধ্যে দুই-তিন ফসলি জমিও আছে। এই তথ্য জানা গিয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ড ও সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত গবেষণায়। ভেড়িতে চিংড়ি চাষের এই বাড়বাড়ন্তের পিছনে রয়েছে বিশ্ব-বাজারে চিংড়ির চাহিদায় বৃদ্ধি, আর চাষির চটজলদি লাভের তাগিদ। প্রশ্ন হল, এ ভাবে অরণ্য, চাষের জমির ভেড়িতে পরিণতিকে আমরা কী ভাবে বিচার করব? সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বিপন্ন, ভেড়ি চাষ কি তাকে আরও সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তাই ভেড়ির প্রতিরোধ করব? না কি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রের জলস্ফীতি, জলোচ্ছ্বাসে জীবিকা হারিয়ে যে মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত, ভেড়ি চাষ তাঁদের একটা সুযোগ করে দিচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে জীবিকা অর্জনের, তাই ভেড়িকে সমর্থন করব?
সারা পৃথিবীতেই উপকূল জুড়ে নোনা জলের ভেড়িতে চিংড়ি চাষের রমরমা। চিন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশ এই শিল্পে সামনের সারিতে। ২০৩০-এর মধ্যে ‘নীল ফসল’-এর বেশিটাই আসবে এশিয়ার সমুদ্রতট থেকে। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত সুন্দরবনের ব-দ্বীপ অঞ্চল, আঁকাবাঁকা উপকূল নিয়ে দেশের মধ্যে বাগদা উৎপাদনে প্রথম হবে, তা আশ্চর্য কী।
আঠারো শতকের শেষ থেকেই প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পরে ব্রিটিশ সরকার, বাঘ ও ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করে সুন্দরবনে কৃষির পত্তন ও জনপদের বিস্তার করার চেষ্টা করে, যাতে আরও রাজস্ব সংগ্রহ করা যায়। সেই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বেশি দিন না চললেও ম্যানগ্রোভ ধ্বংস কিন্তু কম বেশি চলতেই থাকে স্বাধীনতার পরেও। কখনও চাষের জমি, কখনও ছিন্নমূল মানুষের বাস্তু জমি, কখনও মাছের ভেড়ি তৈরি হয় অরণ্য দখল করে।
বেশ কিছু ভেড়িতে নানা মাছের মিশ্র চাষের চল ছিল। চিংড়ির সঙ্গেই পার্শে, ট্যাংরা, ভাঙর, ভেটকি। কিন্তু নদী খাঁড়ির কূল বরাবর নিচু জলাজমিতে শুধুই বাগদা চাষের রমরমা শুরু হল আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে, যখন বিশ্বায়নের জেরে চিংড়ির চাহিদা এল সুন্দরবনের দোরগোড়ায়। ১৯৯৯ সালে এসে দেখা গেল, বত্রিশ হাজার হেক্টরে শুধুই বাগদা চাষ হচ্ছে। নিবিড় বাগদা চাষ সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের উপর নানা সমস্যা ডেকে আনে। প্রথমত সুন্দরবনে বাগদার চারা প্রজননের ব্যবস্থা নেই। হাজার হাজার মানুষ, প্রধানত মহিলা ও শিশুরা, বাধ্য হন ভেড়ির জন্য চিংড়ির পোনা ধরতে। কখনও গলা জলে কখনও বুক জলে দাঁড়িয়ে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর স্বাস্থ্য ভাঙে, চামড়ার রোগ ধরে, কুমির কামটের কামড়ে প্রাণ যায়। একটা মীন ৫০ পয়সা, শীত কালে এক টাকা। মশারি-জালে ধরা পড়া প্রতিটি মীনের জন্য নষ্ট হয় প্রায় চারশোটির মতো মাছ, চিংড়ি, শামুক বা অন্যান্য প্রজাতির শিশু, এমনকি ডিম। সমুদ্রের মৎস্যজীবীদের জালে মাছের জোগান কমতে থাকে।
এই শতাব্দীর শুরু থেকে ছবিটা আরও পাল্টাতে থাকে। বাড়ছে উত্তাপ, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে বছরে পাঁচ মিলিমিটারের বেশি। ২০০৯-এর সাইক্লোন আয়লার নোনা বন্যায় এক লক্ষ হেক্টরের উপর চাষ জমি ভেসে গেল, বহু জমি লবণাক্ত হল, তাই চাষ বন্ধ হল। ধান জমিতে ভেড়ি বেঁধে চিংড়ি চাষ বাড়তে থাকল লাফিয়ে লাফিয়ে। গত দশ বছরে সাঁইত্রিশ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে ভেড়ি চাষ এখন দখল করেছে একান্ন হাজার হেক্টরেরও বেশি। দ্রুত কমেছে ম্যানগ্রোভ আর চাষ জমি।
কিন্তু জমি লবণাক্ত হওয়াই চিংড়ি চাষের প্রধান কারণ নয়, তার প্রমাণ— বহু ভেড়ি কলকাতার কাছাকাছি, সমুদ্র থেকে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। হাড়োয়া, মিনাখা, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ জুড়ে ভেড়িগুলি বিস্তৃত। বাড়তি লাভের আশাতেই চিংড়ি চাষ বাড়ছে— প্রতি হেক্টর জমিতে দেড় লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা লাভ, প্রতি বছর। অবশ্য ক্ষতির ঝুঁকিও কম নয়।
২০০৯-এর পর থেকেই সুন্দরবনে চিংড়ি ভেড়িতে এসেছে ভিনদেশি সদস্য, সাদা পায়ের চিংড়ি ‘লিটোপিনিয়াস ভেন্নামাই’, সংক্ষেপে ‘ভেনামি’, অনেকটা চাপড়া চিংড়ির মতো দেখতে। বাগদার মতো এক বার নয়, বছরে তিন বার চাষ করা যায়। বাজারে দাম চড়া, লাভও প্রচুর। চারা আসে বিমানে, খাবার, প্রোবায়োটিক, সব অর্ডার-মাফিক, তিন গুণ বেশি মাছের চারা এক সঙ্গে ছাড়া যায়, ফলে নদীর জলে বাড়ে জলদূষণ। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রযুক্তিনির্ভর চিংড়ি চাষ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলেছে বহু গুণ।
বাণিজ্যিক মাছ চাষ বাস্তুতন্ত্রের জন্য অন্য বিপদও আনছে। আর এক নতুন আমদানি আফ্রিকান মাগুর, যা শহরের বাজারে ভাল দাম পায়। মাংসাশী এই মাছের চাষ পুকুরে হয়, কিন্তু ঝড়-জলের দাপটে পুকুর থেকে ভেসে উত্তরে নদীর মিষ্টি জলে মিশে গেলে দেশি মাছেদের নির্বংশ করার ক্ষমতা রাখে।
সুন্দরবন বাস্তুজগতের প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ অধিবাসীর একটি অংশ জীবিকার জন্য ভেড়ির উপর নির্ভরশীল। তাদের জন্য গোটা বাস্তুতন্ত্র কি বিপন্ন হবে? বর্তমান হারে ভূ-রূপান্তর চলতে থাকলে ২০৩০-এর মধ্যে আরও দশ হাজার হেক্টর কৃষি জমি, জলা-জঙ্গল ভেড়ি চাষের আওতায় চলে আসবে। সুন্দরবনে চাষ জমিতে মাছের ভেড়ি করা আইনসম্মত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আর ম্যানগ্রোভ কাটা তো বেআইনি বটেই। তা হলে?
২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর কলকাতা হাই কোর্ট একটি অনন্য রায়ে বলেছিল, সুন্দরবনের জঙ্গল-জমিতে বেআইনি ভেড়ি, হোটেল ইত্যাদি তৈরি বন্ধ করতে হবে। দু’জন আইপিএস অফিসারকে দায়িত্ব দিয়েছিল। তাৎক্ষণিক কিছু কাজ হয়েছিল, জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ইতিমধ্যে আদালতে রিপোর্ট জমা পড়েছে বলে জানা গিয়েছে, কিন্তু তা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। ওই রিপোর্টের তথ্য সামনে এলে বোঝা যেতে পারে, সুন্দরবনে বেআইনি নির্মাণ, বাস্তুর উপর নানা আক্রমণের ভয়াবহতা ঠিক কতখানি। তার পরেও প্রশ্ন থাকে, আগের বেআইনি রূপান্তরগুলিকে নিয়ে আমরা কী করব?
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত ২০ বছরে সুন্দরবন বাস্তুজগতে প্রায় ৮১০০ হেক্টর নতুন ম্যানগ্রোভ সৃজন হয়েছে, এই অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐকান্তিক চেষ্টায়। আমপানের পর বন বিভাগ বছরে পাঁচ কোটি করে নতুন ম্যানগ্রোভ চারা রোপণ করছে সুন্দরবনে। আমরা যদি ভেড়িগুলিতে প্রথাগত মাছ, কাঁকড়ার মিশ্র চাষ ফিরিয়ে আনি, ভেড়ির ভিতরেও ম্যানগ্রোভ লাগাই ভিয়েতনামের মতো, যদি নদী থেকে মীন না ধরে আশপাশের রাজ্য থেকে চিংড়ির পোনা আনা হয়, বৃষ্টির জল ধরে, বা ভৌমজল থেকে লবণ অপসারণের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কৃষিজীবীদের সেচের জল সরবরাহ করতে পারি যাতে কৃষি আবার লাভজনক হয়, তা হলে হয়তো সুন্দরবনের সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যের সঙ্গে মৎস্যজীবীদের জীবিকার বিরোধের মীমাংসার একটা দিশা মিলতে পারে।
সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।