গত দেড় বছরে খুব ছোট হয়ে গুটিয়ে এল কি চার পাশটা? বোজা দেওয়াল, বোবা ঘর। অবকাশ নেই, বাইরেটাই যেন গায়েব হয়ে গিয়েছে বেশিরভাগ কচিকাঁচার জীবন থেকে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, ধুলোমাখা চেয়ার-টেবিল আর আগাছা-জঙ্গল নিয়ে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে ইতস্তত। ছেলেমেয়েদের মাথা তোলবার আকাশটা বেমালুম উধাও। দিন কয়েক অনেকেই তাই চিন্তা করে চলেছেন এই অসাক্ষাৎ ভার্চুয়াল পড়াশোনার অসারতা নিয়ে। স্কুল-কলেজে পৌঁছতে পারছে না যারা, তাদের বোঝবার সুযোগ হল না, জ্ঞান জিনিসটা টেবিলের ও-পার থেকে গড়িয়ে আসে না নীচে, বরং সবাই মিলে প্রতি মুহূর্তে তা সৃষ্টি করে। মাস্টারমশাই, দিদিমণি, ছাত্রছাত্রী, বন্ধুবান্ধব— শিক্ষাঙ্গনের সমস্তটাই ভালবাসা দিয়ে তর্ক-সংঘর্ষ দিয়ে সর্বক্ষণ গড়েপিটে চলেছে নানা বিদ্যার বিচিত্র সম্ভাবনা। সেইটাই শিক্ষার সবচেয়ে বড় জায়গা। সেইটাই আমাদের নিজেদের বেড়ে চলা আকাশ। গত কয়েক বছরে, সেই আকাশে ক্ষতচিহ্নের মতো যে-মাস্টারমশাইদের পায়ের ছাপ হারিয়ে ফেলেছি, তাঁদের বৃত্তান্ত খুব সুদূর ঠেকলেও সে-সব কাল্পনিক রূপকথা নয়। এই সে দিনও তাঁরা আমাদের আশেপাশে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শহর, গ্রাম আর মফস্সলে রাস্তাঘাটে মানুষের মধ্যে তাঁদের চলাফেরা ছিল স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক।
কলকাতার বেথুন কলেজের যে কোনও সমাবেশেই দেখা যেত শীর্ণ কিন্তু দৃপ্ত এক মহিলাকে। তাঁর শরীরটা নানা ব্যাধিতে নুয়ে আছে, কোমর, পাঁজর স্টিলের পাতে মোড়া কিন্তু প্রায়শ সিঁড়ি ভেঙে তিনি উঠে আসেন দোতলা কিংবা তিন তলায়। তখনই গোটা ঘরটার মন চলে যায় তাঁরই দিকে। নন্দিনী রাহা অবশ্য তাতে খুব একটা কেয়ার করেন না। মূর্তিমান উৎসাহ হয়ে শোনেন সব কিছু। প্রেসিডেন্সির ফিজ়িক্স বিভাগের ল্যাবরেটরিতেও ভরসন্ধে অবধি কাজ করে যান একমনে। কলেজবাড়িটা যে একটা ইট-কাঠের স্তূপ নয়, জলজ্যান্ত অস্তিত্ব আছে পরিসরটুকুর, সেই সত্যিটা নিয়মিত দাখিল করার জন্যই যেন তিনি এসে দাঁড়াতেন সবার সামনে, নিজের স্বাস্থ্যবিধি তুচ্ছ করে। বছর দুই আগে সেই অশীতিপর কিশোরী, রিকশা-ট্যাক্সি কিছুই না পেয়ে, আস্ত একটা ভ্যান পাকড়ালেন। “দিদি এ তো কয়লার ভ্যান”, তাজ্জব হয়ে বলেই ফেলে এক ছাত্রী। “আমরাও এক রকমের কয়লা, নাও, চলো তো এখন, খামোকা দেরি হয়ে যাচ্ছে।” এই হলেন ভৌতবিজ্ঞানের বিদুষী শিক্ষিকা নন্দিনী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শরীর আর শিক্ষকের শরীরে যেন কোনও ভেদ ছিল না সে দিন। যারা পড়তে আসে আর পড়াতে আসে, তাদের মিশে থাকার কথা এই রকমই। হয় কি সেটা যখন তখন?
আমার স্কুল, আমার কলেজ, একটা বিভাগ, কয়েকটা ঘর, মাঠ আর বাগান, এও যেমন শরীরে মনে এক হয়ে যায়, তেমনই আবার হাজারদুয়ার, জানলা-খোলা মানুষ আসেন আমাকে তেপান্তরে ছড়িয়ে দিতে। যেমন এসেছিলেন মানববাবু। যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্যের করিডরে লম্বাটে ঘরে রঙিন জামা গায়ে, ফুট-পাঁচেক ছোটখাটো চেহারা, কিন্তু বিপুল মনের সেই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছাত্রছাত্রীদের জন্য গোটা ভুবনটাকেই নামিয়ে আনতে পারতেন। শিকড়ের ডানা গজাত, খুলে যেত তৃতীয় বিশ্বের জানলা। ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ভেঙে পড়ছে যখন, মানববাবুর নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকদের দু’এক জন মিলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লবিতেই বানিয়ে তোলেন এক প্রতীকী বাবরি মসজিদ। না, ধর্ম নয়, বরং গান দিয়েই তাকে ঘিরে রেখেছিল ছাত্রছাত্রীর দল। পড়াশোনার পালার পর এই ভাবে সে দিন সন্ধে-বিকেলের অস্তরাগে বিশ্বে পৌঁছতে পেরেছিল বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ।
সমসময়ের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার ভারটুকুই যে কেবল এঁরা তুলে নিতেন, তা তো নয়। এক দিন সদ্য পড়াতে আসা পুরনো ছাত্র বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস অনুবাদ নিয়ে নানা প্রশ্ন করে বসে। উত্তর না দিয়ে পাল্টা তাকেই ঘুরিয়ে শুধোন মানবেন্দ্র, “বিদ্যাসাগর শকুন্তলা আর সীতাকেই বেছে নিলেন কেন বলতো?” তাই তো, এ কথাটা খেয়াল করা উচিত ছিল। “কেন?” “কেননা, দু’জনকেই তাদের বর তাড়িয়ে দিয়েছিল। এবং দু’জনেই প্রসূতি। এর চেয়ে করুণ দশা আর কী হবে? যিনি বিধবাদের বিয়ের ব্যবস্থা করছেন, তিনি কি ব্রিটানিকা অনুবাদ করবেন?” দূর-সময়ের ধূসর পলস্তারায় যে কোনও ঘটনাই জুড়ে আছে অদৃশ্য সমাজ-রাজনীতি আর ইতিহাসের শৃঙ্খলসূত্রে— এই কথাটা গল্পচ্ছলে শেখাতে পারতেন তিনি। তাই, খেলা থেকে শুরু করে খোলাবাজার, সমস্তই আমাদের পাঠ্য, ভাষাটা রপ্ত হলেই চিচিংফাঁক।
কোথায় তৈরি হয় ভাষা? কোথায় দেখা দেয় দৃশ্য? রাস্তায়। ট্রেনে। বাসে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো কবিতা-বই চর্যাগীতিকোষে একটা চমৎকার কবিতায় আছে: “গুরু আমাকে এই দীক্ষা দিয়ে যান/ আহার প্রত্যাশে আকাশ প্রস্থান।” এই আকাশ-চর্চার গূঢ় অর্থ সহজ করে বাংলার ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন পথিক মাস্টারমশাই সুধীর চক্রবর্তী। গ্রাম-গঞ্জ-সদর-মফস্সলে ঘুরে ঘুরে এই বানিয়ে-তোলা সমাজটার চাদরের কোনা ধরে তুলে দেখাতেন তিনি। অক্লেশে বলতেন, এই যে রাজমিস্ত্রি, সে কিন্তু হাটের দিনে সহজ ধর্মের কথা শোনাবে, সেখানে ও গুরুঠাকুর। এই যে এন্টালি বাজারে আলুর দোকান, সেখানে অপূর্ব বৈষ্ণবলীলা সে শ্রোতা-বিহীন একাই বলে যায়। মানুষের দিকে তাকানোটাই এই ভাবে বদলে দিতে পারতেন গভীর নির্জন পথের এই মাস্টারমশাই। বলে দিতেন, সব বড় ধুলোমাখা, পরিচ্ছন্ন করা চাই মন। যে কোনও ঝঞ্ঝাটে আকাশে চাও, কিছু না কিছু উত্তর সহজে মিলবেই।
শেখা আর শেখানো তা হলে বন্ধ ঘরের কাজ নয় কেবল। বাইরে যে চার পাশটা বেবল্গা ছুটে চলেছে তার সঙ্গে তাল রেখে তো চলতে হবে। কিন্তু কাকে বলে জানা, আর কোনটাই বা শেখা? এই সারাক্ষণই জায়মান যে ঘটনা ঘটে রাস্তা-পথে, তাকে কি আর জ্ঞান বলা যায়?— হ্যাঁ, বলাই যায়। সব কিছুকেই শামিল করে তুলতে পারো মনে। এ রকম ভাবতেন প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য। তাঁর কাছে অনেক সময় পড়তে আসতেন এক তুখোড় লেখক, যিনি কলকাতার অন্ধকার জগৎটার হালহকিকত একেবারে নিজস্ব ভাষায় খুব ভাল করে ধরতে পারতেন। অথচ, লেখালিখির দুনিয়ায় চার পাশে জ্ঞানের ছটা দেখে প্রথমটায় একটু ধাঁধিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, মনে হচ্ছিল তাঁর, এই সব তত্ত্বতালাশ হাসিল করে তবেই বুঝি লিখতে হবে। মাস্টারমশাই প্রদ্যুম্ন তাঁকে মৃদু হেসে বলেছিলেন, “পার্ক সার্কাস ট্রামগুমটি থেকে ঠিক ক’টা ট্রাম সারা দিনে বেরোয় আর কত দিক ঘুরে, কখন ফিরে আসে সেটা যদি সম্পূর্ণ জানা থাকে তোমার, তাকেই বা কেন জ্ঞান বলা যাবে না?” তাই তো, জানার কোনও ছকে-বাঁধা চেহারা তো নেই কোথাও। কথাটা যে শুধু সেই লেখককেই বলেছিলেন তা নয়। সারা জীবনের লেখা আর কাজের মধ্যে দিয়ে সর্বত্রপ্রসারী এই লোকবিদ্যার মুক্তক্ষেত্রটিতে আমাদের সবাইকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন প্রদ্যুম্নবাবু। বিদ্যা তো মুক্তই করে।
কিন্তু কেমন হতে পারে সবার জন্য সে মুক্তির কাঙ্ক্ষিত আদল? সে খবর জানতেন প্রদ্যুম্নরই পরম বন্ধু। সাড়ে চার মাস আগে সূর্যাস্তের মুহূর্তে আমাদের ভাবনা-চিন্তার সেই ভরকেন্দ্রটি মিশে গিয়েছে অথৈ গঙ্গার জলে। শঙ্খ ঘোষের কথা, তাঁর পড়ানোর কথা নতুন করে বলতে বসা কঠিন। বলব কেবল, কত সহজেই তাঁর ছাত্রদের, বন্ধুদের বলতে পারতেন তিনি তাদের প্রত্যেকের কাছে নিজের কিছু-না-কিছু শেখার খবর। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পড়াতে এসে খুব খুশি এক তরুণ সে দিন বলতে শুরু করেছেন নতুন ক্লাসের অভিজ্ঞতা। গভীর মনোযোগে শঙ্খবাবু জানতে চান, “কী বলছে ছেলেমেয়েরা?” খানিক গর্বিত মুখে উত্তর আসে, “মেসমেরাইজ়ড হয়ে যাচ্ছে!” উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে বলেন তিনি, “সেটা কি খুব ভাল?” ভাল নয়। মুগ্ধতা আর নিজের ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীর আমূল সমর্পণ কখনও ভাল নয়। শিক্ষকের কাজ শুধু নতুন প্রশ্নের দিকে তরতাজা মনগুলিকে এগিয়ে দেওয়া, যাতে তাদের কাছেও শিখতে পারেন শিক্ষক স্বয়ং। শঙ্খ ঘোষের কবিতার দুই চরিত্র আরুণি আর সত্যকাম, এদের কাছে শিক্ষক নিজেই নতজানু।
ভয়াবহতার নানা আয়োজনে ভরা গত কয়েক বছরে সত্যিকারের শেখার মতো প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এই দেশের ছাত্রছাত্রীরাই। তারাই আজ আমাদের শিক্ষক। এই ভূমিকা বদলের শিক্ষাই শেষ পর্যন্ত বিদ্যার মুক্তি। কেউ-না-কেউ কোথাও-না-কোথাও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চালিয়ে নিয়ে চলেছে। ঘরে-বাইরে সঙ্কট সময়ে মাস্টারমশাইদের যেন খুঁজে পাই আমরা মনে। মুখে মুখে চলা অভিজ্ঞতাতেও যেন বেঁচে থাকে, শেখা আর শেখানোর গগনমণ্ডল। উন্মাদের পাঠ্যক্রমে সেটাই একমাত্র মুক্তি।